ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

জোয়ারের পানিতে পূর্বপুরুষের জীবিকা হারা লাখো মানুষ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৩
জোয়ারের পানিতে পূর্বপুরুষের জীবিকা হারা লাখো মানুষ

ভোলা: বারবার মেঘনা থেকে উপচে পড়া জোয়ারের পানি বদলে দিচ্ছে ভোলার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা। দিন দিন যেমন পানির চাপ বাড়ছে, একই সঙ্গে বাড়ছে পানি জমে থাকার স্থায়িত্বকালও।



জোয়ারের পানির প্রবল চাপে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে, প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। জোয়ারের চাপে নতুন নতুন নালা তৈরি হওয়ায় যেসব গ্রামে আগে কখনো পানি ঢোকেনি সেখানেও এখন পানি ঢুকছে অনায়াসে।

প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ জেলার বহু মানুষকে নিঃস্ব করেছে, পথে বসিয়েছে অনেককেই। চলতি মৌসুমে অন্তত লক্ষাধিক মানুষ তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন শুধু জোয়ারের প্লাবনের কারণেই।

জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাস থেকেই বেড়েছে জোয়ারের পানির চাপ। জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে বাড়িঘর, ফসলি মাঠ, স্কুলের আঙিনা, ডোবা নালায়। লবণাক্ত পানি জমে থাকে দীর্ঘদিন। ফলে জোয়ার শেষ হলেও শেষ হয় না মানুষের দুর্ভোগ।

পায়ে হেঁটে মেঘনা তীরের ধ্বংসপ্রায় বেড়িবাঁধ দিয়ে দৌলতখান উপজেলার ভবানীপুর থেকে সৈয়দপুর যেতে সবখানেই চোখে পড়লো একই চিত্র। তিন কিলোমিটার পথের দু’ধারে দুর্ভোগের যেন শেষ নেই মানুষের। বাঁধের একপাশ ভাঙছে মেঘনা, আবার অন্যপাশে স্কুল, বাড়িঘর, ফসলি জমি আর বাগানে জমে আছে জোয়ারের পানি।

বহুদিন আগে প্রবেশ করলেও নোনা পানি এখনও নেমে যায়নি পুরোপুরি। জোয়ারের পানিতে বিধ্বস্ত ঘরটিই মাচা পেতে উঁচু করে নিয়েছেন অনেকেই।
img
জোয়ারে পানিতে নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার কথা জানালেন এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা। তাদের মতে, আগে জোয়ার এলেও তাতে এতটা সমস্যা হতো না। এখন জোয়ারই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে ভাঙ্গন তো আছেই।

চলতি বছর ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ও পক্ষিয়া, দৌলতখানের সৈয়দপুর এবং ভোলা সদরের ধনিয়া, কাচিয়া ও পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি ছিলেন প্রায় ৪ মাস। এ সময় মানবেতর জীবন কেটেছে তাদের। এমনকি বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদরের অনেক অংশই এবার নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।

এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লাগাতার জলাবদ্ধতা ও জোয়ার-ভাটার কারণে ভাঙন এলাকায় নতুন খালের সৃষ্টি হয়েছে। বোরহানউদ্দিনের বড় মানিকা ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাদশা মিঝির ছেলে আবদুল মান্নান জানান, এ বছর মে মাসের পূর্ণিমার জোয়ারে একদিনে আলিমউদ্দিন বাজারের দক্ষিণ পাশের জমির উপর দিয়ে প্রায় ২০০ গজ প্রশস্ত আধা কিলোমিটার লম্বা একটি খালের সৃষ্টি হয়েছে। দিনের পর দিন খালটি দীর্ঘ হচ্ছে। এছাড়া ভোলা সদরের কাছিয়া ঘাটের পূর্বদিকে সরু একটি নালা খালের রূপ নিয়েছে। এ রকম অসংখ্য নতুন নতুন খালের সৃষ্টি হয়েছে এলাকায়।

স্থানীয় লোকজন জানান, বোরহানউদ্দিনের বাটামারা থেকে দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের সরকারি দিঘির পাড় পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার বাঁধ নদীতে বিলীন হয়েছে। একই অবস্থা ভোলা সদরের ধনিয়া থেকে পূর্ব ইলিশার গাজীপুর বাজার পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার বাঁধের। তজুমুদ্দিনের কেয়ামুল¬্যা, চরফ্যাশনের বেতুয়ায়ও একই চিত্র।

দৌলতখান ও ভোলা সদরের কয়েকটি এলাকার লোকজন জানান, জোয়ার আর ভাঙনে বহু মানুষ পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। শহরে কাজের সন্ধানে ছুটছেন বহু মানুষ। নদী ভাঙন নিয়ে কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোস্ট ট্রাস্টের দাবি, ভাঙন এলাকায় অন্তত লক্ষাধিক লোকের পেশা বদল হয়েছে। তারা বিভিন্ন বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন অথবা কাজের সন্ধানে গেছেন এলাকার বাইরে কোথাও।    

বড়মানিকার খাক কাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আখতার হোসেন জানান, জলাবদ্ধতার কারণে ইতিমধ্যেই বোরহানউদ্দিনের বড় মানিকা ও পক্ষিয়া ইউনিয়ন দু’টির প্রায় ৪০ শতাংশ লোক সপরিবারে এলাকা ছেড়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলে গেছেন। কাজের সন্ধানে ইউনিয়ন দু’টির প্রায় ৮০ শতাংশ পুরুষ কাজের খোঁজে এলাকা ছেড়েছেন। জানা গেছে, মহানগরী ও বন্দরনগরীতে চলে গেছেন ভাগ্যবিড়ম্বিত এসব মানুষ।

বড় মানিকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সালাউদ্দিন জানান, জলাবদ্ধতায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। কৃষি কাজ ছাড়া অন্য কাজ না জানা থাকায় কোথাও যেতে পারছেন না তারা। আবার চক্ষুলজ্জা ও মান সম্মানের কথা ভেবে ত্রাণ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।

বড় মানিকার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আ. রশিদ, আ. হাসিম, জসিম, মোশাররফ  এবং ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আ. খালেকসহ অনেকের অভিযোগ, এবার সবচেয়ে বেশিদিন প্রায় চারমাস জলাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সরকারি-বেসরকারি কোনো তরফেই তেমন কোনো সাহায্য-সহযোগিতা তেমন মেলেনি।
   
সূত্র বলছে, জলাবদ্ধতার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি হ্রাস পেয়েছে। বড় মানিকার খাককাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আখতার হোসেন জানান, বড় মানিকা ইউনিয়নে পনোরোটি সরকারি ও ৮টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ৯০-৯৫ শতাংশ থাকলেও জলাবদ্ধতা কারণে এ হার নেমে আসে ৩০ শতাংশে।

বড়মানিকার নয়ামিয়ার বাজারের পল্ল¬ী চিকিৎসক শাহ আলমগীর বলেন, কাদা-পানিতে ডুবে বানভাসিদের মধ্যে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট-সর্দি, নিউমোনিয়া, কলেরা, আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগ বেড়েছে।

এলাকার সবক‘টি কাঁচা পাকা টয়লেটের ট্যাংকি পানিতে ডুবে যাওয়ায় অনেকেই খোলা পানিতে সারতে বাধ্য হচ্ছেন প্রাকৃতিক কাজ। ফলে দূষিত হয়ে পড়েছে পরিবেশ।

আবার জলাবদ্ধতায় ডুবে যাওয়া অনেক নলকূপ এখনও অকেজো। দূর থেকে অনেক কষ্টে খাবার পানি সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও হাড়ি পাতিল, থালা-বাসন সহ ধোয়া মোছার প্রায় সব কাজ চালাতে হয় ময়লা পানিতে।

মেঘনা তীরবর্তী এলাকার মানুষ বলছেন, জলাবদ্ধতার সময় বড়মানিকা ও পক্ষিয়া ইউনিয়ন দু’টিতে প্রায় লক্ষাধিক লোক পানির উপরে মাচা বানিয়ে বসবাস করেছেন। ভোলা-চরফ্যাশন মহাসড়ক ব্যতীত গ্রামের অনেক আধা-পাকা ও পাকা রাস্তা পানিতে ডুবে গিয়েছিলো। কৃষকরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছিলেন তাদের গবাদি পশু নিয়ে। পানিতে চারদিক ডুবে থাকায় অভাব দেখা যায় সবুজ ঘাসের। আবার বসত বাড়িতে পানি ওঠায় নষ্ট হয়ে যায় জমিয়ে রাখা খড়-কুটো।

জানা গেছে, খাদ্যাভাব ও শুকনো জায়গার অভাবে অনেক গৃহস্থই তাদের গৃহপালিত মুরগি, গরু ও ছাগল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। পক্ষিয়া ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাদশা, সফিজল, হারুন মিয়া, সিরাজ মিয়া জানান, খাদ্য ও শুকনো জায়গার অভাবে তারা গরু,ছাগল বিক্রি করে দিয়েছেন।

কোরবানির হাটে ভালো দাম পাওয়ার আশায় একটি গরু পালন করছিলেন সিরাজ মিয়া। জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর ডুবে না গেলে গরুটির বর্তমান মূল্য ছিল ২০ হাজার টাকা। কিন্তু পানির কারণে তা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন মাত্র ১৩ হাজার টাকায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ (ভোলা, দৌলতখান এবং বোরহানউদ্দিন) এর নির্বাহী প্রকৌশলী আ. হান্নান জানান, মোট ৪৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে বোরহানউদ্দিনে সাড়ে চার এবং ভোলা সদরে পাঁচ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নদীগর্ভে চলে গেছে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারের সময়গুলোতে এ সব খোলা জায়গা দিয়ে পানি ঢুকে পড়ে।

বেড়িবাঁধের জন্য জমি অধিগ্রহণে পাউবো’র কোন বাজেট নাই বলে জানালেন তিনি। সাধারণত এলাকার জনগণই বেড়িবাঁধের জন্য নিজেদের জমি দিয়ে থাকেন। কিন্তু বারবার নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় বোরহানউদ্দিন এলাকার লোক জমি না দেওয়ায় এবার আর নতুন বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

তিনি জানান, জোয়ারের পানির তীব্রতা যে এতটা প্রবল হবে, তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেননি। তবে পরিস্থিতি অনুধাবন করে অবশেষে বেড়িবাঁধের জন্য জমি দিতে রাজি হয়েছেন অনেকেই।

জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভোলার রাস্তাঘাটগুলো সাধারণত কম উচ্চতায় তৈরি। পক্ষান্তরে কালভার্ট ও ব্রিজগুলো অনেক উঁচু। ফলে জোয়ারে অধিকাংশ এপ্রোচ রোড ভেঙ্গে কালভার্ট ও ব্রিজগুলো  অকেজো হয়ে পড়েছে। রাস্তার উচ্চতা কম থাকায় এবং বেড়িবাঁধ ভাঙনের ফলে অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় জোয়ারের পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে। আবার ভাটার সময় রাস্তার উচ্চতার সমপরিমাণ পানি লোকালয়ে থেকে যায়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক কালভার্টের অভাবে পানি দ্রুত সরতে না পারায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার।

নদী ভাঙন থেকে রক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভোলা রক্ষা না হলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে। সবুজ বনভূমি নষ্ট হলে পরিবেশের ভারসাম্য থাকবে না। বেড়িবাঁধ রক্ষা না হলে গ্যাস, বিদ্যুত, কৃষি, মৎস্য যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, এমনকি ভিটা পর্যন্ত থাকবে না। সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। ভোলা রক্ষায় নদী ভাঙন রোধে বাজেটে আলাদা বরাদ্দ থাকতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০২১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৩
আরআই/আরকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।