ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

খা খা খা বক্কিলারে খা ...

সাজিদুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১২
খা খা খা বক্কিলারে খা ...

ঢাকা: পৃথিবীতে রয়েছে তিন সহস্রাধিক প্রজাতির সাপ। প্রাগৈতিহাসিক যুগের ডাইনোসরাসের দাপুটে আমল থেকেই সাপের বিচরণ পাওয়া গেছে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।



এসব সাপের দৈহিক কাঠামো যেমন বৈচিত্রময়, তেমনি বিচিত্র বর্ণের বটে। আবার কোন কোনটির শরীরী অবয়বকে রীতিমতো কিম্ভূতকিমাকারই বলা যায়।

খাদ্যাভাসও এক নয় সব সাপের। এক নয় শিকার ধরার কৌশলও। হেরফের আছে বিষদাঁত আর বিষেও।

এমনই কিছু বিরল সাপের বিচিত্র জীবন নিয়েই এ লেখার অবতারণা।

05হাতি শুঁড় সাপ (Elephant trunk snake)
নাম শুনলেই বোঝা যায় এ সাপটি অদ্ভুত না হয়ে যায় না। হাতির শুঁড়ের মতো বেঢপ আর ভাঁজ পড়া ত্বকের কারণেই সাপটির এ ধরনের নাম। ইন্দোনেশিয়ায় বসবাস হলেও অস্ট্রেলিয়ায় এদের কিছু আত্মীয় খুঁজে পাওয়া যায়।

এদের আঁশের ধরনও অদ্ভূত। বড় ও গিটযুক্ত আঁশের কারণে এ সাপের আরেক নাম ‘আঁচিল সাপ’। এরা সাধারণত আড়াই মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। হাতি শুঁড় সাপেরা পুরোপুরিভাবেই পানিতে বসবাস করে। মাটিতে এরা একদমই থাকতে পারে না।

অন্যান্য সাপের মতো পেটের নীচে বড় আঁশ না থাকায় এরা মাটিতে পিছলে চলতে পারে না। ক্যাট ফিস ও বাইন মাছ এদের প্রিয় খাদ্য। গিঁটযুক্ত আঁশের কারণে এরা পানির ভেতরেই পিচ্ছিল মাছগুলোকে সহজে ধরে পিষে মেরে ফেলতে পারে।

07শুঁড় ওয়ালা সাপ (Tentacled snake)
পানিতে বসবাসকারী এই সাপটি তার প্রজাতির টিকে থাকা সর্বশেষ সদস্য। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাসিন্দা এ সাপটি তার সুঁচালো নাকের ওপর বসানো দুটি শুঁড়ের জন্য অনন্য একটি প্রজাতি। এর শুঁড়গুলি খুবই সংবেদনশীল। শিকার ধরার জন্য শুড় দু’টিকে অ্যান্টেনা হিসেবে ব্যবহার করে থাকে এ সাপ। আশপাশের দুর্ভাগা কোনো মাছ চলাফেরা করলে এ অ্যান্টেনা খবর পৌঁছে দেয় সাপটির কাছে।

অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে শিকার ধরতে পারা এ শুঁড়ওয়ালা সাপের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। শিকার ধরার জন্য এ সাপ মাত্র ১৫ মিলি সেকেন্ড (১ মিলি সেকেন্ড = ১ সেকেন্ডের ১ হাজার ভাগের ১ ভাগ) সময় নিয়ে থাকে।

মাছেরা অনেক সময়ই শুঁড়ওয়ালা সাপের গতিকে হারিয়ে দেয়। এজন্য সাপটি খুবই চতুর একটি পন্থা অবলম্বন করে। মাছেরা যাতে দ্রুত চলে যেতে না পরে এজন্য এরা মাছের দিকে শরীর ঘুরিয়ে খুবই আস্তে আস্তে নাড়তে থাকে। এটা দেখে খাদ্য হতে যাওয়া মাছটি দ্রুত বিপরীত দিকে চলে যায়। আর এটার অপেক্ষাতেই থাকে শুঁড় ওয়ালা সাপ। কৌণিকভাবে রাখা এর মাথারদিকে মাছ যখন দ্রুত চলতে থাকে তখন সহজেই সেটি সাপের চোয়ালে ঢুকে যায়।

সাপের মধ্যে একমাত্র এরাই আগে থেকে শিকারের আচরণ বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী আচরণ করে থাকে।

টেনটাকলড স্নেকরা বিষধর হলেও মানুষের জন্য এটি বিপজ্জনক নয়। এ সাপটি সাধারণত ৯০ সে. মি পর্যন্ত লম্বা হয়। হাতি শুঁড় সাপের মতো এরাও পানিতে বাস করে। মাটিতে এদের দেখা পাওয়াই মুশকিল।

02লম্বা নাকের লতা সাপ (Long nosed vine snake)
তীক্ষ্ণ বাইনোকুলার ভিশনের (দূরের বস্তু কাছের দেখার ক্ষমতা) জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গাছে থাকা এ সাপটি অন্যদের চেয়ে আলাদা। দূরের বস্তু দেখার ক্ষমতার জন্যই এরা নিখুঁতভাবে শিকারকে আঘাত করতে পারে। অনুভূমিক চোখ এবং চাবির ছিদ্রের আকৃতির চোখের মনি এদের অন্য সাপের চেয়ে আলাদা করে রেখেছে।

লতার মতো শরীরের কারণে এরা শিকার ও শিকারী উভয়ের কাছ থেকেই লুকিয়ে থাকতে পারে। এদের জিভও হালকা সবুজ। ওজনে হালকা হওয়ায় অর্ধেক শরীর শূন্যে রেখে এরা গাছের পত্ররাজি এবং শাখা-প্রশাখায় দ্রুত যেতে পারে। টিকটিকি প্রজাতির প্রাণি ও ব্যাং এদের প্রিয় খাবার। বিষধর হলেও এদের কামড়ে মানুষের খুব একটা ক্ষতি হয় না। লং নোজ ভাইন ¯েœক এর কামড়ে শরীরে ব্যাথা ও ফুলে গেলেও কয়েকদিনের মধ্যে তা সেরে যায়।

01পাতা নাক সাপ (Langaha nasuta)
এটি পৃথিবীর অদ্ভূত সরিসৃপদের মধ্যে অন্যতম একটি সাপ। এশিয়ান ভাইন ¯েœক বা এশীয় লতা সাপের মতো এরাও গাছে বাস করে এবং টিকিটিকি জাতীয় প্রাণী খেয়ে থাকে।

অদ্ভূত ধরনের শিং বা শুঁড়ের প্রদর্শনই এর সবচেয়ে মজার বৈশিষ্ট্য। পুরুষ ও নারী দুই ধরনের সাপেরই এ শুঁড় রয়েছে। তবে পুরুষের ত্বকের রঙ একটু হলদেটে এবং মসৃণ। এদের শুঁড় খুব খাড়া। অন্যদিকে নারীদের চেহারা একটু রুক্ষ এবং আঁশ বাদামি রঙের। পুরুষের শুঁড় খাড়া হলেও নারীদেরটা চ্যাপ্টা ও খাঁজ কাটা।

মাদাগাস্কারের বিপন্ন রেইন ফরেস্ট এলাকায় পাতা নাক সাপদের বসবাস। বিষধর হলেও এদের কামড় মরণঘাতী নয়। তবে কামড় দিলে মানুষের শরীরে তীব্র ব্যাথার সৃষ্টি হয়।

04পাখাওয়ালা ট্রি ভাইপার (Atheris hispida)   
মধ্য আফ্রিকার রেইন ফরেস্টে ছোট এই সাপের বাস। মারাত্মক বিষধর এ সাপের বড়  ও শান্ত চোখ এবং খাড়া (ব্রাসের বিসলের মতো) আঁশের কারণে এদের চোখে পড়ে। খাড়া আঁশের কারণেই এদের পাখাওয়ালা ট্রি ভাইপার নামেও ডাকা হয়।

এ প্রজাতিটি ৭৫ সে.মি পর্যন্ত লম্বা হয়। অন্য সাপদের চেয়ে আলাদা এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো অ্যাথেরিস পুরুষ সাপ মেয়ে সাপের চেয়ে লম্বা হয়। এ সাপের উপরের চোয়ালে সঙ্কোচনযোগ্য বিষদাঁত রয়েছে।

দু:সংবাদ হচ্ছে এ সাপের বিষের কোনো প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি। এর কামড়ে রক্ত জমাট বাঁধতে অসুবিধা হয়। এছাড়া ফুলে যাওয়া ও মৃত্যুও ঘটে থাকে। তবে ভয়ের কিছু নেই- মানব বসতি থেকে এ সাপ অনেক দূরে থাকে এবং এদের কামড়ানোর ঘটনাও খুব দুর্লভ।

03শিং ওয়ালা ভাইপার (Horned viper)
গ্রিক পুরাণের সিরাসটিস দৈত্যের কথা আমরা অনেকেই জানি। সাপের মতো দেখতে ওই দৈত্য মরুভূমির বালির নিচে লুকিয়ে থেকে তার শিং দিয়ে প্রলুব্ধ করে আক্রমণ করতো। এই সিরাসটিসের সঙ্গে শিং ওয়ালা ভাইপারের অনেক মিল রয়েছে। হয়তো এই সাপের বাস্তব রূপ দেখেই মানুষ পৌরাণিক সিরাসটিস চরিত্র তৈরি করেছে।

১৭৬৮ সালে অস্ট্রিয়ান প্রকৃতিবিদ নিকোলাস লরেনটি শিং ওয়ালা ভাইপার এর আনুষ্ঠানিক নাম দেন ‘সিরাসটিস সিরাসটিস’। গ্রিক পুরাণ রচনাকারীরা হয়তো এ ভাইপারের আকার বড় ও এর বিপদের দিকটা বাড়িয়ে তুলে পৌরাণিক চরিত্রটি তৈরি করেছে। বাস্তবে শিং ওয়ালা ভাইপারও বালির নীচে লুকিয়ে থেকে শিকার করে। লুকানোর সময় এদের শিং, চোখ ও নাক উপরে তুলে রাখে। যদিও তাদের শিং আসলে শিকারকে প্রলুব্ধ করার জন্য ব্যবহার করা হয় বলে বর্তমান সময়ে মনে করা হয় না। নিকোলাস লরেনটি হয়তো নামকরণের সময় পৌরাণিক চরিত্রটির কথাই মাথায় রেখেছিলেন।

উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য প্রাচ্যের এ ভাইপারটি সাধারণত ৫০ সে.মি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। চোখের ওপর এক জোড়া শিং থাকলেও এদের অনেকেরই আবার সেটা থাকে না। একারণে অনেকেই অন্য ভাইপারের একে মিলিয়ে ফেলে। বিষধর হলেও এদের বিষ মানুষের জন্য মারাত্মক নয়। আক্রমনের আগে আগে শিং ওয়ালা ভাইপার শরীরকে গুটিয়ে ফেলে একধরনের শব্দ তৈরি করে থাকে। ইদুর ও টিকটিকি জাতীয় প্রাণীই এরা বেশি শিকার করে থাকে।

aspগর্তে থাকা বিষধর সাপ (Burrowing asp)
‘গর্তে থাকা বিষধর সাপ’ বাদ দিয়ে অস্বাভাবিক বা অদ্ভূত সাপের তালিকা তৈরি করা যাবে না। ছোট আকৃতির এ সাপটির বসবাস আফ্রিকায়। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই এরা গর্তে কাটিয়ে দেয়। গর্তে থাকার কারণে ইদুর জাতীয় প্রাণিই এদের প্রধান খাদ্য।

এদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো- এরা মুখ না খুলেই শিকারকে কামড়ে ধরে রাখতে পারে। কারণ এদের বিষদাঁত মুখের বাইরে বেরিয়ে থাকে। এই দাঁতের জন্যই শিকারের সঙ্গে ধস্তা-ধস্তির সময় বাইরের ময়লা সাপের মুখে ঢোকে না। এছাড়া এ সাপের বিষদাঁত দুটো এরা ইচ্ছা মতো নাড়াতে পারে।

বিষধর এ সাপের বিষ শিশুদের জন্য প্রাণঘাতী হলেও প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ক্ষতিকারক নয়। তবে এই সাপের বিষে কিছু উপাদান মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। অন্য যে কোন সাপের চেয়ে এরা শিকারের শরীরের গভীরে বিষ ঢুকিয়ে দেয়। এ কারণেই প্রকৃতিবিদরা এদের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১২
এসএইচ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।