ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিনোদন

এ ‘মণিহার’ আমায় নাহি সাজে!

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫
এ ‘মণিহার’ আমায় নাহি সাজে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

যশোর থেকে ফিরে: ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে!’ মণিহার সিনেমা হল নিয়ে এখন সে কথাটাই বুঝি বলা সাজে। হলটির মুখে কথা থাকলে রবি ঠাকুরের এ গানের কলিই হয়তো বাজতো।

কারণ বিশ্বকবির এই গান এখন সত্য হয়ে উঠেছে যশোরের রবীন্দ্রনাথ সড়কের উপর ৩৩ বছর আগে গড়ে ওঠা মণিহার সিনেমা হলের ক্ষেত্রে।

বৃহস্পতিবার (২৪ ডিসেম্বর) রাত নয়টার শো তখন শুরু হয়ে গেছে। টিকিট বিক্রি শেষ করে কাউন্টার কক্ষে আড্ডা জমিয়েছেন কাউন্টার মাস্টার ওমর খসরু। হলের ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেনও সেখানে। একজন ব্যবসায়ী বন্ধুও হাজির হয়েছেন। আড্ডায় শামিল হতে। হলের ভেতরের দিক দিয়ে কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চেয়ে সহজেই মিললো। সাংবাদিক পরিচয়ে প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে দ্রুতই স্বাভাবিক হলেন। আর নস্টালজিকও হয়ে পড়লেন।

সেটা ১৯৮৩ সাল। ৮ ডিসেম্বর সাড়ম্বরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়ে গেলো মণিহার সিনেমা হলের। ৯ ডিসেম্বর প্রথম শো। সিনেমার নাম ‘জনি’। সোহেল রানা আর ববিতার সাড়া জাগানো হিট ছবি। টিকিট কাউন্টারে বসেন খসরু ও তোফাজ্জল (বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার)। বাইরে হাজারো সিনেমাপ্রেমীর ভিড়। মাত্র আধাঘণ্টায় দু’জন মিলে বিক্রি করে ফেললেন ১৪২৭টি টিকিট।   এর মধ্যে ৫৩৫টি আসন ড্রেস সার্কেল (ডিসি), আর ৮৭২টি শোভন শ্রেণীর। এছাড়া বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত ১৮টি আসন। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে, শুরু হলো মণিহার সিনেমা হলের প্রথম শো।

আজ এই শোতে কতজন দর্শক রয়েছে? স্মৃতিকাতর ওমর খসরুর কাতরতা যেনো শতগুণে বেড়ে গেলো সেই প্রশ্নে। বললেন, ভিতরে গিয়েই দেখে আসেন। শ’ খানেক হয়তো হবে।

আবারও হারানো গৌরবের কথাই বলতে চান মণিহারে ৩৩ বছর কাটিয়ে দেওয়া এই কর্মী। বললেন, একেকটা শো চলার সময় এমন হতো, সব টিকিট বিক্রি শেষ করে বাইরে তাকিয়ে দেখতাম আরও একটি পুরো শো’র দর্শক তখনও বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে। তিন ঘণ্টা তাদের এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে পরের শোর টিকিট পেতে, তা নিয়ে কষ্টবোধ নয়, আনন্দই হতো। কারণ তারা এই সিনেমা হলের দর্শক। এভাবেই চলেছে বছরের পর বছর। কখনো কখনো দর্শকের চাপে বাড়তি টিকিট দিয়ে হলে বেঞ্চ পাততে হতো।

কি এমন হলো যে সব হারিয়ে মণিহারের জৌলুস এখন শূন্যের কোটায়? সে প্রশ্নে আহত হলেন এই কাউন্টার মাস্টার। বললেন, সব হারিয়ে যায়নি। মণিহার এখনো সেরা। কেবল সিনেমা হলের প্রতি দর্শকরা মুখ ফিরিয়েছে বলেই আজ এই দশা।

মুখ কেনো ফিরিয়েছে? তার উত্তরে বললেন, প্রথম কামড়টা বসে ১৯৮৭-৮৮’র দিকেই। ভিসিপি’র আগমনে। মণিহারের তখন চার-পাঁচ বছর বয়স। দেশ জুড়েই এর পরিচিতি। রেডিও’র প্রোগ্রামে মণিহার সিনেমা হল নিয়ে স্বনামধন্য উপস্থাপক নাজমুল হোসাইনের সেই ভরাট কণ্ঠ কে না শুনেছে! তাতে এই হলের সিনেমাটি নিয়ে বর্ণনা যেমন থাকতো, তেমনি থাকতো হলের বর্ণনা। ঘোরানো প্যাঁচানো সিঁড়ি, ফোয়ারা, হলের সাউন্ড সিস্টেম, ৪০ ফুট প্রশস্ত ৩০ ফুট উঁচু বিশাল পর্দার কথা তার মুখ দিয়েই মানুষ জানতে পারে।

হলটির স্থপতি ছিলেন কাজী মোহাম্মদ হানিফ। চার তলাবিশিষ্ট এ সিনেমা হলের পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ঝাড়বাতি, নানা কারুকাজ, নায়ক-নায়িকাদের ছবি দিয়ে নান্দনিকভাবে সাজানো। আর আধুনিক সাজজ্জার এ হলে একটি সিনেমা দেখার জন্য সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ছুটে আসতো। বিদেশ থেকেও অনেকে এখানে এসে সিনেমা দেখেছে। কিন্তু হঠাৎ ভিসিপি’র আগমনে একটা আঘাত সিনেমা হলগুলোর ওপর পড়লো।

তোফাজ্জল বলেন, মণিহার তখন সামান্যই এর প্রভাব দেখেছে, তবে একেবারে দেখেনি সে কথা বলা যাবে না। তখনই দর্শক পড়তে শুরু করে। কারণ মানুষ সিনেমা হলে না গিয়ে পাড়ায় মহল্লায় ভিসিপি ভাড়া করে সিনেমা দেখতে শুরু করে।

এর যে একটি রাজনৈতিক দিক ছিলো তাও জানা এই দুই হল কর্মীর। বললেন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ওই সময়ে পাড়ায়-মহল্লায়-গঞ্জে- নগরের অলিতে গলিতে এই ভিসিপি সহজলভ্য করে দেওয়া হয়। আর তাতে সাধারণ সিনেমার বাইরে নীল (অশ্লীল) ছবি দেখারও সুযোগ করে দেওয়া হয়। যাতে তরুণ সমাজ এতে মজে যায়। রাজনৈতিকভাবে সে কৌশল সফল হতে না পারলেও মানুষের কাছে সিনেমা দেখার একটি বিকল্প পন্থা হিসেবে ভিসিপি জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। আর তাতে অন্য শত শত সিনেমা হলের মতো মণিহারও দর্শক হারালো।

এরপর অবশ্য কিছু ভালো ভালো ছবি এলে পরিস্থিতি পাল্টায়। মানুষ আবারও হলমুখী হয়। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের প্রথমভাগে দেশে প্রথম আসে ডিস অ্যান্টেনা। তাতে সিনেমার দর্শকদের মধ্য থেকে অভিজাত ও ধনিক শ্রেণী বাদ পড়ে যায় আর তারও একটু পরে এসে পড়ে কেবল টেলিভিশন। যাতে ঘরেই আটকে পড়ে দর্শকরা। বিনোদনের নানা দিক একই পর্দায় তাদের সামনে উন্মোচন হয়ে যায়। হোক ছোটপর্দা, তাতেই খুশি থেকে দর্শক বড় পর্দার প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকে।

এই সময়ে সিনেমায় ঢুকে পড়ে অশ্লীলতা। আর তাতে শিক্ষিত শ্রেণী সিনেমা হলের প্রতি আগ্রহ চূড়ান্তভাবে হারায়। তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মণিহার সিনেমা হল অশ্লীল ছবি প্রচারে বিমুখ থাকায় এর দর্শক আরও কমতে থাকে।

এরপর এসে পড়ে ইন্টারনেটের যুগ। এখন কম্পিউটারে, মোবাইল ফোনে সব দেখা যায়। এসব কিছুই টেনে নিয়েছে যুব শ্রেণীকে, তারুণ্যকে। ফলে সিনেমা হলে দর্শক আসবে কি করে।

সবচেয়ে বড় আঘাতটি পেলাম একদিন হলের ভেতরে দেখি টিকিট কেটে ঢুকে দুই তরুণ তাদের মোবাইল ফোনে অশ্লীল সব কিছু দেখছে। ওসব দেখতে সিনেমা হলকে নিরাপদ আর নিরিবিলি স্থান বলেই বেছে নিয়েছে তারা, এর চেয়ে আর ভয়াবহ কি হতে পারে? আক্ষেপের সুরে বলছিলেন ম্যানেজার তোফাজ্জল।

এক একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এ হলের অর্থনীতি এখন পুরোই ভঙ্গুর। শতাধিক কর্মী এক সময় এখানে কাজ করতেন। তাদের মধ্যে জনা ত্রিশেক এখন টিকে রয়েছেন। তবে বেতন ভাতা নিয়মিত হয় বলেই জানালেন তারা। আর বেতনও এখন কিছুটা বেড়েছে। কত বেতন সে উত্তর না দিয়ে দু’জনই বললেন, যা পাই তাতে আমাদের সংসার ভালো মতোই চলে।

এটা মালিকের বদান্যতা। হলের টিকিট বিক্রি দিয়ে এই কর্মীদের বেতন দেওয়া সম্ভব নয়, সেটা এখন সবারই জানা। তবে কর্মী যারা রয়েছেন তাদের অন্য ব্যবসা থেকে অর্থ এনে বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়। মণিহার সিনেমা হলের উপরের অংশে বড় আবাসিক হোটেলটি বেশ লাভজনক বলেই জানান সংশ্লিষ্টরা। হলটির প্রতিষ্ঠাতা মালিক ছিলেন মরহুম সিরাজুল ইসলাম। বর্তমান মালিক তার ছেলে জিয়াউল ইসলাম মিঠু। কর্মীদের মাঝে যিনি অত্যন্ত সজ্জন মানুষ বলেই পরিচিত।  

তবে মণিহারকে আরও কিছু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ২০১২ সালে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে এক দফা টানা বিশ দিন হলটি বন্ধও করে রাখতে বাধ্য হন মালিকপক্ষ। পরে কর্মীদের পরিবারের দিকে তাকিয়ে তা আবার খুলে দেওয়া হয়।

দেশে যেসব চলচ্চিত্র মুক্তি পায় তার মধ্যে সেরাগুলোই চালানো হয় মণিহার সিনেমা হলে। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। দর্শক হারানোর পাশাপাশি ধীরে ধীরে মনিহার তার সব জৌলুসই হারিয়েছে।

রাতের শোতে ভেতরে ঢুকে দেখা গেলো পুরোই ফাঁকা। ডিসিতে জনা দশেক আর শোভনে জনা বিশেক হবেন দর্শক বসে ‘এপাড়-ওপাড়’ সিনেমায় নায়ক নায়িকার প্রেমকাণ্ড দেখছেন।

কাউন্টার মাস্টারের দাবি ছিলো ‘শ-খানেক টিকিট বিক্রি হয়েছে’। এতো কষ্টের মাঝে এটুকু মিথ্যায় সামান্য প্রশান্তি যদি মেলে তাতে ক্ষতি নেই।

শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন: যশোরের যশ, খেজুরের রস
শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন: ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল’
সুন্দরবন এক্সপ্রেস থেকে: আউশের চিড়া ও তার কারিগরের গল্প

বাংলাদেশ সময়: ০৭২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫
এমএমকে/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।