ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন ও ২৮ বছরে শাবিপ্রবি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯
সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন ও ২৮ বছরে শাবিপ্রবি

১৮৭৪ সালে আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হলো বৃহত্তর বাংলার তিনটি জেলা-সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া নিয়ে। খুব বেশি সময় যেতে না যেতে এই প্রদেশ পরিচিত হয়ে উঠলো ‘চা প্রদেশ’ হিসেবে।

রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সিলেটের বাঙালিরা অনেক বেশি এগিয়ে ছিল আসামের মানুষদের চেয়ে। সিলেটের আসাম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়া অনেক সিলেটি ও আসামিরা মেনে নিতে পারেনি।

বিশেষ করে সিলেটি বাঙালিরা অনুভব করতে পেরেছিল আসামের সঙ্গে সিলেট একীভূত হওয়ার পেছনে কিছু উদ্দেশ্য ছিল যা তাদের অর্থনীতি ও শিক্ষার বিকাশে অন্তরায় হতে পারে।

১৯০৫ সালে সিলেটকে আবার বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে যুক্ত করা হয় এবং ১৯১২ সালে পুনরায় আসামের সঙ্গে একীভূত করা হয়। ১৯২০ সালের দিকে সিলেটের বাংলায় ফিরে যাওয়া নিয়ে হিন্দু-মুসলিম একীভূত হতে থাকে। কারণ অনেকেই সংশয় প্রকাশ করে যে, সিলেট যদি আসামের সঙ্গে যুক্ত থাকে তবে তার শিক্ষা, অর্থনীতি প্রভৃতি মর্যাদাপূর্ণ বিষয়ে প্রভাব পড়তে পারে। তখনকার সময়ই আসামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল যা নিয়ে হিন্দু-মুসলিম অনেকের মধ্যেই উদ্বেগ ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী যিনি আসাম আইনসভার সদস্য ছিলেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আসামের জন্য যে অর্থ ব্যয় হবে সিলেটিরা কেন সে খরচ বহন করবে আর সিলেটিরা কোন শর্তে সিলেটের পরিবর্তে আসামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সম্মত হবে।

সিলেট একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল। তারপরও একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তাদের লড়াই করতে হয়েছে মোটামুটি ৭০ বছরের বেশি। ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সময় থেকেই আসাম প্রদেশের মানুষ বিশেষ করে সিলেটের মানুষরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। ১৯২৫ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেও তা সফল করা যায়নি। ১৯৪০ সালের পর তখনকার শিক্ষামন্ত্রী মুনাওর আলী ‘শ্রীহট্ট বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। কিন্তু কিছু অসমিয়রা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং তা নাকচ করে দেয়। ১৯৪৬ সালের শেষ পর্যন্ত অনেক নাটকীয় পর্বের শেষে তা আসাম ব্যবস্থাপনা পরিষদে গৃহীত ও পাস হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় সিলেটি বাঙালিদের জন্য।

পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় রাজশাহীতে, তখনকার সময় খাজা নাজিম উদ্দিন তার দেওয়া আশ্বাস রাখেননি। ১৯৬২ সালের শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আন্দোলন অব্যাহত থাকে। সিরাজুন্নেসা চৌধুরী (প্রয়াত স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর মা) এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন তরফ থেকে আশস্ত করার পর ও ১৯৬৪ সালে ফজলুর কাদের চৌধুরীর ইশারায় বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্টগ্রামে স্থাপন করা হয়।

১৯৬২ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গেছে পূর্ব পাকিস্তানের এই অংশে (সিলেট), বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবে আসেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা যখন নিজস্ব ভূখণ্ড পেলাম তখন আবারও উচ্চারিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। আশির দশকে জিয়াউর রহমান সিলেট সফরে এলে সিলেটবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কিন্তু তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সিলেটে এক জনসভায় ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার।

১৯৮৬ সালের ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা ও স্থান নির্ধারণ করে গঠিত কমিটি রিপোর্ট করে। ১৯৮৬ সালের ৩০ এপ্রিল এরশাদ সিলেট সফরে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি (১৩৯৭ বঙ্গাব্দের ১ ফাল্গুন) তিনটি বিভাগ, ১৩ জন শিক্ষক ও ১২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষা কার্যক্রম। সিলেটে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলন ও কাঠখড় পোহাতে হয়েছে বাংলাদেশের আর অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তা হয়নি।

২৮ বছরে শাবিপ্রবির অর্জন লিখে শেষ করার মতো না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার এক যুগান্তকারী রোল মডেল হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে শাবিপ্রবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একনিষ্ঠ গবেষকরা দেশ-বিদেশের সুনাম কুড়িয়েছেন এবং এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগ অল্প কয়েক মিনিটে শনাক্তকরণ, মোবাইলে খুদে বার্তায় ভর্তি প্রক্রিয়া, পিপীলিকা নামক বাংলা সার্চ ইঞ্জিন, ড্রোনসহ আরও অনেক যুগোপযোগী গবেষণা হয়েছে শাবিপ্রবিতে।

তবে শাবিপ্রবিতে এখনও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেকগুলো বিভাগ খোলা হয়নি। বর্তমান প্রশাসন আশা করি এদিকে নজর দেবেন। বর্তমান প্রশাসন শাবিপ্রবিকে অত্যাধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করবেন এই প্রত্যাশা রইলো।

শুভ জন্মদিন, ৩২০ একরের সবুজ ভূমি শাবিপ্রবি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জিওগ্রাফী এন্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯
আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।