ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

রফতানির লক্ষ্যে কুড়িগ্রামে হচ্ছে ‘ভুট্টা হাব’

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৮
রফতানির লক্ষ্যে কুড়িগ্রামে হচ্ছে ‘ভুট্টা হাব’ ভুট্টা চাষে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার (ফাইল ফটো)

ঢাকা: রফতানির জন্য ভুট্টা চাষকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। আর উত্তরবঙ্গকেই এ ফসল আবাদের আদর্শ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কুড়িগ্রাম জেলাকে ভুট্টা চাষের একটি ‘হাব’ (কেন্দ্রস্থল) হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পর্যায়ক্রমে তা রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলায়ও সম্প্রসারণ করা হবে।
 
 

পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাংলানিউজকে সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শ ও নির্দেশনায়ই এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

 

কৃষি মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। দ্রুতই এ বিষয়ে পরিকল্পনা ঠিক করতে পরিকল্পনা কমিশনের একটি প্রতিনিধি দলের কুড়িগ্রাম সফরের কথা রয়েছে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সরাসরি এই প্রকল্পটি দেখভাল করবেন।
 
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী চান দ্রুত সময়ের মধ্যে ভুট্টা রফতানি শুরু করতে। এজন্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কাছে একটি প্রস্তাবনা চেয়েছিলাম। মন্ত্রী আমাকে বলেছেন, ভুট্টা চাষ দ্রুতই বিস্তার লাভ করছে। প্রতিবছর এ ফসলের আবাদের প্রবৃদ্ধি ১৫ ভাগের ওপরে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিন বছরের মধ্যেই ফসলটি রফতানি করা সম্ভব। আমরা আগামী দুই বছরের মধ্যেই এটা করতে চাই। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব কিছু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
 
আ হ ম মুস্তফা কামাল  বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- এক সময়ের অভাবপীড়িত বা ধারাবাহিক মঙ্গাক্রান্ত উত্তরের জনপদে এখন মানুষ তিন বেলা খেতে পান। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতি শক্ত ভীত পেয়েছে। এই মানুষগুলোর অর্থনৈতিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনার জন্য দরকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম। এজন্য এই অঞ্চলের জন্য নানা ধরনের প্রকল্প নেওয়া দরকার। কেউ যেনো পিছিয়ে না থাকে। আমরা সেখানকার মানুষকে মঙ্গা থেকে মুক্তি দিয়েছি। কিন্তু অর্থনীতির কাজে হাত দেওয়া হয়নি। এর মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা সক্রিয় হবে। ’ 
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (ফাইল ফটো)ভুট্টা বা মেইজ এক দানা খাদ্যশস্য। যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় ভুট্টা ‘কর্ন’ নামে পরিচিত এবং এটি সেখানকার অন্যতম প্রধান দানা ফসল। ‘মেইজ’ শব্দের উৎপত্তি ভারতীয় আরাওয়াক শব্দ মা-ইজ থেকে। স্প্যানিশ ভাষায় একে মেইজ বলা হয় এবং এ শব্দ আমেরিকার স্প্যানিশ ভাষা-ভাষীদের মধ্যে এখনো চালু আছে। পশ্চিম গোলার্ধে ইউরোপিয়ানদের পৌঁছানোর আগেই আমেরিকায় ভুট্টার চাষাবাদ শুরু হয়। মেক্সিকো অথবা মধ্য আমেরিকা ভুট্টা উদ্ভবের কেন্দ্রস্থল বলে মনে করা হয় এবং সেখান থেকে পরবর্তীতে পৃথিবীর নানা দেশে এটি ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর বহুদেশে এখন ভুট্টার চাষ হয়। এশিয়ার প্রধান ভুট্টা চাষের দেশগুলোর মধ্যে ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, চীন, ভারত এবং পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য। ইউরোপেও অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য ভুট্টা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, খাদ্য হিসেবে বাংলাদেশে ভুট্টার ব্যবহার বেড়েছে। যদিও মাছ এবং পোল্ট্রি খাদ্য হিসেবেই তা বেশি ব্যবহার হচ্ছে। বাজারে চাহিদা বাড়ায় গত পাঁচ বছরে ভুট্টার আবাদ বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ।
 
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে, চলতি অর্থবছরে ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ লাখ ৭২ হাজার টন। এর মধ্যে শীতকালে ৩ লাখ হেক্টর ও গ্রীষ্মকালে ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা আবাদ হচ্ছে। গত বছর ৩ লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ ৬১ হাজার টন ভুট্টা। ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে ২ লাখ ২৭ হাজার হেক্টরে ভুট্টা চাষ হয়। আর ২০০২-০৩ সালে দেশে মোট ভুট্টার উৎপাদন ছিল মাত্র ১ লাখ ৭৫ হাজার টন। বর্তমানে দেশে ভুট্টার চাহিদা আনুমানিক ৫০ লাখ টন। বিদেশ থেকে ভুট্টা আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়ে থাকে।
 
গত এক দশকে দেশে ভুট্টার আবাদি এলাকা, উৎপাদন ও হেক্টরপ্রতি ফলন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। দানাদার খাদ্যশস্যের মধ্যে হেক্টরপ্রতি ফলনের দিক থেকে ভুট্টার স্থান প্রথম সারিতেই। যদিও আবাদি এলাকা ও মোট উৎপাদনের দিক থেকে এটি এখনও ধান এবং গমের পরে রয়েছে।
 
দেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখায় অবদান রাখছে ভুট্টা। আগে এটিকে মাইনর শস্য হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এখন জাতীয় আয়ের হিসাব নির্ধারণে এটিকে মেজর বা প্রধান শস্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কৃষি খাতের জিডিপি গণনায় বিবেচিত ১২৮টি ফসলের মধ্যে আগে প্রধান শস্য হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হতো গম, পাট, আলু, আউশ, আমন ও বোরো ধানকে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভুট্টা।
 
উৎপাদনশীলতায় বাংলাদেশের ভুট্টা উৎপাদন এখন বৈশ্বিক গড়ের তুলনায়ও এগিয়ে। বর্তমানে ভুট্টার বৈশ্বিক হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ৫ দশমিক ১২ টন, যেখানে বাংলাদেশে এর গড় উৎপাদন ৬ দশমিক ৯৮ টন। এ উৎপাদনশীলতায় এখন বাংলাদেশের ওপরের অবস্থানে রয়েছে কেবল যুক্তরাষ্ট্র।
 
ভুট্টা উৎপাদনে এ অগ্রসর অবস্থান অর্জনের পেছনে কৃষক ছাড়াও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ কাজ করেছে। বীজ, সারসহ অন্যান্য উপকরণপ্রাপ্তিতে কৃষকদের সহায়তা দান, বাস্তবমুখী নীতিমালা প্রণয়ন ও সেগুলোকে কৃষক পর্যায়ে দ্রুত বাস্তবায়ন ও ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে সামনের দিনগুলোয় ভুট্টা উৎপাদন আরও বাড়বে বলে আশাবাদ সংশ্লিষ্টদের।  

সম্প্রতি গম ও ভুট্টা উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এ নিয়ে গবেষণার জন্য ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সংসদে বিল পাস হয়েছে। এ আইনের আওতায় দিনাজপুরের সদর উপজেলার নশিপুরে গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে। বিলে বলা হয়েছে, গম ও ভুট্টার উন্নয়ন ও উৎপাদন-সংক্রান্ত বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, এ-সংক্রান্ত গবেষণা, জার্ম প্লাজম সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি, কৃষকদের প্রশিক্ষণ, প্রকল্প গ্রহণ এবং স্নাতকোত্তর গবেষণার ব্যবস্থা করবে ইনস্টিটিউটটি।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৮
আরএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।