ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

এজিএম’র সহায়তায় ক্যাশিয়ারের পকেটে গ্রাহকের ৬০ লাখ টাকা!

বেলাল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
এজিএম’র সহায়তায় ক্যাশিয়ারের পকেটে গ্রাহকের ৬০ লাখ টাকা! ছবি: প্রতীকী

বগুড়া: আমানুর রহমান। ব্যাংকের প্রধান ক্যাশিয়ার।

ক্যাশিয়ারের অ্যাটর্নি অ্যাসিসটেন্ট ইনছান। নিজ একাউন্টে রাখতে গ্রাহক তাদের কাছে টাকা জমা দেন। টাকা বুঝে নেওয়ার পর সই সিল দিয়ে গ্রাহকের হাতে জমা রশিদ তুলে দেন তারা।

কিন্তু টাকা গ্রাহকের একাউন্টে জমা হয় না। সেই টাকা জমতে থাকে তাদের পকেটে। এভাবে তারা দু’জন মিলে গ্রাহকের প্রায় ৬০ লাখ টাকা নিজেদের পকেটে ভরেছেন বলে অভিযোগ।

বিষয়টি ধরা পড়ে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে। এক গ্রাহক তার জমানো টাকা উত্তোলনের জন্য চেক জমা দিলে দেখা যায় তার একাউন্টে কোনো টাকা নেই। তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি তিনি শাখা ব্যবস্থাপককে জানান। শাখা ব্যবস্থাপক তৎক্ষণাৎ বিষয়টি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঘটনাটি ধামাচাপা দেন। বিনিময়ে তিনি অভিযুক্ত দুইজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অনৈতিক ‍সুবিধা নেন। শুধু তাই নয় বেটার পোস্টিং দিয়ে তাদের ‍অন্য শাখায় বদলি করেন।

বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় অবস্থিত অগ্রণী ব্যাংকের সোনাতলা শাখায় দুই ক্যাশিয়ার হাতে দিয়ে এ ভয়াবহ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। আর মোটা অঙ্কের অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের বগুড়া জেলার উত্তর জোনের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. শহীদুল্লাহ ও একই কার্যালয়ের সিনিয়র অফিসার আব্দুল হাকিম ঘটনা ধামাচাপা দেন।

একইভাবে শাখা ব্যবস্থাপকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অনৈতিক সুবিধা নিয়ে উত্তর জোনের এই দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অগ্রণী ব্যাংক তালোড়া শাখা, রাজা বাজার শাখা, দুপচাঁচিয়া শাখা ও পোড়াদহ হাট শাখার নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি বাংলানিউজের বগুড়া অফিসের ঠিকানায় এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগপত্রের অনুলিপি আসে।

অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, বগুড়া উত্তর অঞ্চলের অঞ্চল প্রধানের ছত্রছায়ায় ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় অনিয়মের বিষয়টি জানিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান বরাবর মূল অভিযোগপত্রটি পাঠিয়েছেন ভুক্তভোগী গ্রাহক।

অভিযোগের অনুলিপি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সচিব, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মহাব্যস্থাপকের অভিযোগ সেল ও অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের ইন্টারনাল কন্ট্রোল এন্ড কমপ্লায়েন্স’র মহাব্যবস্থাপক বরাবর পাঠানো হয়েছে।

ওই অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের সোনাতলা শাখায় প্রায় এক বছর ধরে পকেট ব্যাংকিং চলে আসছিল। ব্যাংকের ক্যাশিয়ার আমানুর রহমান ও ক্যাশিয়ারের অ্যাটর্নি অ্যাসিসটেন্ট ইনছান গ্রাহকের টাকা ব্যাংকে জমা না করে নিজেদের পকেটে ভরান।

আত্মসাৎকৃত টাকার অঙ্ক প্রায় ৬০ লাখ টাকা বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা।

ঘটনাটি ব্যাংকের গ্রাহকদের কাছে ধরা পড়ে। কিন্তু পানি বেশি দূর গড়ানোর আগেই উত্তর জোন প্রধান সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. শহীদুল্লাহ ও সিনিয়র অফিসার আব্দুল হাকিম তড়িঘড়ি করে বিষয়টি ধামাচাপা দেন।

এছাড়া এই দুই ক্যাশিয়ারের বিরুদ্ধে কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিয়ে টাকার বিনিময়ে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তাদের দু’জনের বেটার পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করেন ওই দুই কর্মকর্তা।

২০১৫ সালের ৩১ আগস্ট অ্যাটর্নি অ্যাসিসটেন্ট ইনছানকে শহরের চেলোপাড়া ও ১৭ সেপ্টেম্বর ক্যাশিয়ার আমানুর রহমানকে তালোড়া শাখায় বদলি করা হয়।

ক্যাশিয়ার ও এজিএম দু’জনেরই বাড়ি নাটোরে হওয়ার কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যে আমানুরকে আরো বেটার পোস্টিং দিয়ে বগুড়া শহরের তিনমাথা শাখায় বদলি করা হয়।

এদিকে এসব অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করতে ব্যাংকের ইন্টারন্যাল কন্ট্রোল এন্ড কমপ্লায়েন্স (আইসিস) ডিভিশনের দুই সদস্যের একটি দল বগুড়ায় আসেন। অডিট ডিভিশনের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) সাবদার রহমানের নেতৃত্বে এই তদন্ত দলের অপর সদস্য ছিলেন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও) মো. ফারুক হোসেন।

তারা ২০১৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথমে অগ্রণী ব্যাংক সোনাতলার শাখায় যান। সেখানে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অনিয়মের তদন্ত করেন। টানা পাঁচদিন পাঁচটি শাখায় তদন্ত শেষে দলটি ঢাকায় চলে যান।  

অগ্রণী ব্যাংক সোনাতলা শাখার ব্যবস্থাপক সিনিয়র কর্মকর্তা জাহিনুর রহমান বাংলানিউজকে তদন্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এই দুইজনের বদলির ব্যাপারে তিনি জানান, হঠাৎ করে তাদের দু’জনের স্ট্যান্ড রিলিজ তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এর বাইরে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) অভিযুক্ত ক্যাশিয়ার আমানুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। আরেক অভিযুক্ত অ্যাটর্নি অ্যাসিসটেন্ট ইনছান মোবাইল ফোন রিসিভ করলেও এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। কেবল দেখা করার কথা বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন।

মঙ্গলবার (১২জানুয়ারি) অগ্রণী ব্যাংক উত্তর জোন প্রধান সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. শহীদুল্লাহ অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলানিউজকে জানান, উচ্চ পর্যায়ের দুই সদস্যের তদন্ত দল পাঁচটি শাখায় তদন্ত করেছেন। তবে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। এটা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাই তদন্ত প্রতিবেদনের ফলাফল না জানা পর্যন্ত ঘটনাগুলো নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করা সম্ভব নয়।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অভিযোগ ওঠায় ওই দুই জনকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। তাই বেটার পোস্টিং দেওয়ার কোন কারণ নেই। তারা দোষী প্রমাণিত হলে উপযুক্ত শাস্তি পাবেন। তবে ক্যাশিয়ার আমানুর ও তার বাড়ি নাটোর জেলায় বলে তিনি স্বীকার করেন।
 
মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) বিকেলে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ের ইন্টারনাল কন্ট্রোল এন্ড কমপ্লায়েন্স’র (আইসিসি) ডিভিশনের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) ও তদন্ত দলের প্রধান সাবদার রহমান বাংলানিউজকে জানান, অভিযোগের অনেক সত্যতা পাওয়া গেছে। সোনাতলা শাখায় মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া অন্যান্য শাখায় সহনীয় ও অসহনীয় মাত্রার অনিয়ম রয়েছে। তবে বিষয়গুলো গোপনীয় হওয়ায় সবকিছু জানানো সম্ভব নয়। আত্মসাতকৃত টাকার পরিমাণ জানাতেও তিনি অস্বীকার করেন।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা জানান, তারা প্রায় এক সপ্তাহ আগে সংশ্লিষ্ট (আইসিসি) শাখার মহাব্যবস্থাপকের (জিএম) কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এখন তিনি প্রতিবেদন ব্যাংকের টপ ম্যানেজমেন্টের কাছে জমা দেবেন। এই বাইরে আর কোন কিছু বলা সম্ভব নয় বলে এই কর্মকর্তা জানান।
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
এমবিএইচ/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।