ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ পৌষ ১৪৩১, ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮ রজব ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ক্ষেতে পচছে ফুলকপি, চরছে ছাগল

জুলফিকার আলী কানন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২৫
ক্ষেতে পচছে ফুলকপি, চরছে ছাগল

মেহেরপুর: মেহেরপুরের শত শত বিঘা জমির ফুলকপি ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। দাম ও ক্রেতা না থাকায় ক্ষেত থেকে তোলা হচ্ছে না ফুলকপি।

ফলে গোখাদ্য হিসেবে মাঠ থেকে ফুল কপি নিচ্ছেন স্থানীয় লোকজন।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে শীতকালীন সবজি ফুলকপি চাষ করেছিলেন অনেকে। কিন্তু এখন সেই ফুলকপি গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষকদের কাছে। অনেকে ঋণ করে ফুলকপি চাষ করেছেন। কিন্তু লাভের মুখ দেখেননি। একদিকে লোকসান, অন্যদিকে ঋণের বোঝা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন জেলার কৃষকরা।


মেহেরপুরের বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা ফুলকপি বিক্রি করতে না পেরে কেটে ফেলে দিচ্ছেন। ক্ষেতেই পড়ে থাকা ফুলকপি গরু ছাগলকে খেতে দেখা গেছে।  

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, জেলায় এ বছর ফুলকপির চাষ হয়েছে এক হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে, বাঁধাকপির আবাদ হয়েছে এক হাজার ৬০ হেক্টর জমিতে।

কৃষকরা জানিয়েছেন, স্বল্প খরচে বেশি মুনাফা পাওয়ার আশা নিয়ে রোপণ করা ফুলকপি এখন লোকসানে ফেলেছে কৃষকদের। প্রতি বছর শীতকালীন সবজি হিসেবে ফুলকপির চাহিদা থাকে, দামও ভালো পান তারা। লাভের আশায় চলতি মৌসুমে অনেকেই ফুলকপি চাষ করেছেন। কিন্তু এ বছর নানান জাতের সবজিতে বাজার ভরে যাওয়ায় উৎপাদন ভালো হলেও মুনাফার অঙ্ক শূন্যের ঘরে।

তারা জানান, প্রতিটি কপির উৎপাদন খরচ পড়ে সাত/আট টাকা। সেখানে বর্তমানে বাজারে প্রতি পিস ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে দুই/তিন টাকায়। ফলে উৎপাদন খরচের অর্ধেকও উঠছে না। এছাড়া চাষিদের পারিশ্রমিকও প্রায় শূন্য।

জেলার সবজি গ্রাম খ্যাত সাহারবাটির বিস্তীর্ণ মাঠে দেখা গেছে ফুলকপি। এছাড়া সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়ও প্রচুর ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ হয়েছে। সাধারণত জেলার চাহিদা মিটিয়ে মেহেরপুরের চাষিদের উৎপাদিত ফুলকপি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়। জেলার চাষিরা ক্ষেত থেকেই এসব ফসল বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে। পাইকাররা ট্রাক বোঝাই করে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করে থাকেন সবজি। অন্যান্য বছর মেহেরপুর থেকে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। অথচ এ বছর ট্রাক ভাড়া না ওঠায় দু-একটা করে ট্রাক যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ফেনি ও সিলেট জেলায়।

গাংনীর বাঁশবাড়িয়া কলোণীপাড়া গ্রামের চাষি রেজাউল ইসলাম বলেন, আমি এ বছর পাঁচ বিঘা জমিতে ফুলকপি আবাদ করেছি। ফুলকপি প্রথম দিকে ভালো দামে বিক্রি করতে পারলেও শেষ দিকে এসে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। এখন বাজারে দুই/তিন টাকা একেকটি ফুলকপির দাম। তাই এগুলো আর বিক্রি হচ্ছে না। জমিতেই সব কপি নষ্ট হয়ে গেছে।

সাহারবাটি গ্রামের কৃষক তহশিন মেম্বার, ভাটপাড়া গ্রামের আনারুল ইসলাম ও নওপাড়া গ্রামের কৃষক লাভলু বলেন, দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি আবাদ করেছিলাম। একেকটি কপির ওজন হয়েছিল দেড় থেকে দুই কেজি। ক্রেতা নাই, তাই জমি ছেড়ে চলে এসেছি। অনেকেই গরু ছাগলের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। সার ও কীটনাশকের দোকানের বকেয়া, জমির লিজ খরচের টাকা নিয়ে খুব বিপদে আছি।

সাহারবাটি গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি আবাদ করেছিলাম। পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। দুই বিঘা জমিতে চাষ করতে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সব টাকাই লোকসান। পরে জমি পরিষ্কার করতেও শ্রমিক খরচ হয়েছে। ফুলকপি বিক্রি না হওয়ায় জমিতেই ছাগল গরু দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছি।

একই কথা জানালেন কলোনিপাড়ার কৃষক শরিফুল ইসলাম ও মোশাররফ হোসেন। তারা বলেন, সাহারবাটি মাঠে শত শত বিঘা জমির ফুলকপি বিক্রি করতে না পেরে জমিতেই ফেলে রাখা হয়েছে। নেওয়ার লোক নাই, খাওয়ারও মানুষ নাই।

সাহারবাটির আজিজুল বলেন, ৩০ শতাংশ জমিতে ফুলকপির চাষ করেছি। এ জমিতে রোপণ করা পাঁচ হাজার চারায় উৎপাদন খরচ পড়েছে প্রতি পিস সাত/আট টাকা। এটা এমন ফসল, পরিপক্ব হলে আর খেতে রাখা যায় না। রাখলে খেতেই নষ্ট হয়ে যায়। উৎপাদন খরচই পাচ্ছি না। এর ওপর ঋণের বোঝা রয়েছে। ঋণ পরিশোধ করব কী দিয়ে, আবার পরিবারের খরচসহ আগামীতে ফসল উৎপাদনের টাকাও রইল না। বেশি দামে বীজ-সার কিনে কম দামে ফসল বিক্রি করলে তো মূলধন হারিয়ে যাচ্ছে।

ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী বলেন, আমরা যে দামে কপি কিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নিয়ে যাচ্ছি, তাতে ভাড়ার টাকা হচ্ছে না। দুবার লোকসান দিতে হয়েছে।
শ্রমিক সর্দার মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রতিবছর এসময় ট্রাকে কপি লোড করে ৫০/৬০ হাজার টাকা আয় করতাম। এ বছর কাজ করছি কিন্তু কপি চাষিরা শ্রমিক খরচ দিতে পারছেন না।  

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুলকপি চাষে এক বিঘা জমিতে ১৮ থেকে ২০ হাজার খরচ হয়। প্রথম দিকে ৫০/৬০ টাকা কেজি দরে ফুলকপি বিক্রি হয়েছে। তাতে খরচ বাদ দিয়ে বিঘা প্রতি ৩০/৪০ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখেছিলেন চাষিরা। কিন্তু হঠাৎ দরপতনে চাষিদের প্রত্যাশায় ভাটা পড়েছে।

মেহেরপুর সদর উপজেলার শালিকা, শ্যামপুর, হরিরামপুর, ঝাঁঝা, ইছাখালি, নতুনগ্রাম, মদনা, বেলতলাপাড়া, হিতিমপাড়া, কালিগাংনী, গাংনী উপজেলার সাহারবাটি, ভাটপাড়া, নওপাড়া, আযান, জুগিন্দা, গাঁড়াডোব, মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান, শিবপুর, মহাজনপুরসহ বিভিন্ন এলাকার ক্ষেতে কৃষকরা ফুলকপি কেটে স্তুপ করে রাখতে দেখা গেছে।

জেলা কৃষি বিপণন অনুসন্ধান কর্মকর্তা জিব্রাইল হোসেন বলেন, বর্তমানে বাজারে ফুলকপির সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা কমে গেছে। যার কারণে কৃষকরা লোকসানে পড়েছেন।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, প্রতিবছর এ মৌসুমে মেহেরপুরে ব্যাপকভাবে বাঁধাকপি ও ফুলকপির আবাদ হয়। হঠাৎ দরপতন হয়েছে। ফুলকপিগুলো বাইরের বাজারে পাঠানোর চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২৫
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।