ঢাকা: মাত্র ১০ শতাংশ লোকের কাছেই দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদ বলে জানিয়েছে অর্থনেতিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্রের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়।
কমিটির প্রধান ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ তছরুপ হয়েছে। দেশের ১০ শতাংশ মানুষ ৮৫ শতাংশ লোকের কর্তৃত্ব করছে। এই ১০ শতাংশ লোক ৮৫ শতাংশ লোকের সম্পদ ভোগ করছেন।
শ্বেতপত্র তিনি বলেন, আমরা যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি এখানে ব্যক্তির দোষ খোঁজা নয়, আমরা একটা প্রক্রিয়াকে তুলে ধরেছি। আমাদের কাজ চোর ধরা না, আমরা চোরের বর্ণনা দিয়েছি। এই শ্বেতপত্রটি গবেষণা পদ্ধতির বাইরে গিয়ে আমরা করেছি। এই দলিল করতে গিয়ে যেই তথ্য-উপাত্ত প্রাসঙ্গিক হিসেবে পাওয়া যায়, সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। দেশি-বিদেশিদের সঙ্গে আলোচনাও আমরা করেছি। এই গ্রন্থসত্ত্ব আমাদের কাছে নয়, এটা সরকারের কাছে থাকবে।
তিনি বলেন, চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল পুরো কাঠামো। এর উৎস ছিল ২০১৮-এর নির্বাচন। পরবর্তী সময়ে যে ভোট হয়েছে সেখানে স্বচ্ছতার জায়গা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারের জবাবদিহিতাও নষ্ট করা হয়েছে। জাতিসংঘ এখনো মনে করছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে কোনো বাধা নেই।
আগামী ৬ মাস দেশ ও জাতির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, এই ৬ মাসের জন্য কী কী পরিকল্পনা নেওয়া হবে সেটা একত্রিতভাবে জনগণের কাছে প্রত্যক্ষভাবে তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনাও দিতে হবে। এই সরকার পাঁচ বছর না থাক, যদি দুই বছর মেয়াদী হয়, তার একটা পরিকল্পনা দিতে হবে। আমাদের বিগত ছয় মাসের হিসাব দরকার এবং আগামী ছয় মাসের পরিকল্পনাও লাগবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চারটি সেক্টরে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত প্রথম, এরপর অবকাঠামো, জ্বালানি ও আইসিটি খাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে।
কমিটির সদস্য ড. এ কে এনামুল হক বলেন, দেশের উন্নয়ন প্রকল্প মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ ব্যয় তছরুপ বা লুটপাট করা হয়েছে।
কমিটির আরেক সদস্য ড. আবু ইউসুফ বলেন, রাজস্ব বোর্ড যে পরিমাণ টিন সার্টিফিকেট থাকার দাবি করে, সেই পরিমাণ রাজস্ব আহরণ হয় না। এমনকি কেউ মারা গেলে সেই সার্টিফিকেট বা নাম্বার কী হবে, সেটির কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া নেই। রাজস্ব বোর্ড সেটা কমিটিকে দিতে পারেনি। কীভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা খাতকে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে তার কোনো সঠিক কাঠামো নেই।
কমিটির সদস্য ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, অভিবাসনের জন্য মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়েছে। অভিবাসনের মাধ্যমেও অর্থপাচার হয়েছে।
কমিটির আরেক সদস্য ড. সেলিম রায়হান বলেন, যেসব খাতে সংস্কার দরকার সেখানে শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে হবে। পরপর তিনটি নির্বাচন চরম ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে, এখন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার।
সদস্য ড. ইমরান মতিন বলেন, টোকা দিলে যে দারিদ্র্য বিমোচন হয়ে যাবে, সেটিকে কার্যকর উদ্যোগ না। দুর্নীতিবাজরা যাতে পুনর্বাসিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
কমিটির সদস্য ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব টাকা লোপাট করা হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে সেই বোঝা থেকে যাচ্ছে। অর্থপাচার ধরা কঠিন, তবে আমরা এটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়েছে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হবে। জবাবদিহিমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা বলতাম মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি আছে, কিন্তু এখন আমরা সেই ফাঁদেই আছি।
গত রোববার (১ ডিসেম্বর) ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে।
এর আগে দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে অন্তর্বর্তী সরকার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের সময়ে গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে প্রতিটি খাতে লুটপাট ও দুর্নীতির চিত্রও উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০২৪
এসএমএকে/এইচএ/