ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

ভারতীয় নারীর রূপবদল

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১২
ভারতীয় নারীর রূপবদল

কলকাতা: আজমির শহরজুড়েই গাধা আর খচ্চরের উটকো গন্ধ। আজমির শরিফের একটু দূরেই হোটেল স্বরাটের পাশ থেকেই বালু বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল পাঁচটি গাধা।

প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে পাহাড়ে বানানো হচ্ছে একটি বাড়ি। সেখানেই বালু বয়ে নিচ্ছে গাধাগুলো। গাধার পিঠে এমনভাবে বস্তা রাখা হয়েছে যে, পিঠের দুদিকেই হয়েছে ভারসাম্য রক্ষা। একবার রেখে এসেই আবারো লাইন ধরে ফিরে আসছে গাধার দল। শীতের কনকনে এ সকালে যে নারী এ গাধাগুলোর তত্ত্বাবধান করছেন, তার মুখবয়ব দেখার উপায় নেই।

পুরো মুখ লাল ওড়নায় ঢাকা। পরা ঢোলা লেহেঙ্গা। এর ওপর আবার মাথা থেকে লম্বা ওড়না ঝোলানো শরীরের সামনে পেছনে দুদিকেই। আরেকটু হলেই ওড়না ছুঁয়ে যেতো মাটি।

হিন্দি ভাষার ওপর নিজের ক্ষুদ্র দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এ কর্মজীবী নারীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তার অপ্রস্তুত দৃষ্টি আমাকে ফিরিয়ে দেয়।

নোংরা শহর আজমির। যেখানে সেখানে গাধা আর ঘোড়ার মলমূত্র পড়ে রয়েছে। এসবের মাঝ দিয়েই স্কুটিতে নিজের দুই বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যায় আরেক আজমিরের রমণী। স্কুটির সামনে ৫/৬ বছরের শিশুর কান্নায় হৃদয় গলছে না মায়ের। কম করেও ৪০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলছে সন্তানদের স্কুলের দিকে। শাড়ি পরাটা কোনো সমস্যা করছে না মোটরসাইকেল চালাতে এ মায়ের। পুরানো ঢাকার শাখারিবাজারের মতোই সরু গলির শহর আজমির। শহরের এক গলি থেকে আরেক গলিতে ঢুকে পড়ে স্কুটি।

আজমির রেলওয়ে জংশনের সামনে থেকেই শুরু হয়েছে অফিস পাড়া। বাসে, ঘোড়ার গাড়িতে নারীদের ব্যস্ততামাখা মুখে কোনো সংকোচ নেই। ১১ ডিসেম্বরের এ সকালেই আজমির শরিফের ভেতর দেখা যায়, দরগার পবিত্র কাপড়ের নিচে শতশত নারী মাথা গুঁজেছে। খাজা নিজামউদ্দিন চিশতীর প্রতি সন্মান প্রদর্শনের অংশ এটি।

রাজস্থানের নারীদের মতোই নয়াদিল্লীর স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা সাধনা ব্যানার্জীর কর্মব্যস্ত ভোর। সাধনা খুব ভোরে উঠেই জগিং সেরে নেয়। তারপর নিজের নাস্তা নিজে তৈরি করে খান। এরপর রেডি হওয়া এবং নিজেই গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাওয়া। সালোয়ার কামিজ বা শাড়ির চেয়ে শার্ট এবং প্যান্টকেই বেশি প্রাধান্য দেন সাধনা। লোদি রোডের ব্যস্ত অফিসগুলোতে যেসব নারীদের দেখা যায় তাদের পোশাকে ভারতীয় ছাপ নেই বললেই চলে।

যে নারী বাম হাত গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে থাকে, আর ডান হাতের আঙুল ছুঁড়ে ফেলে সিগারেটের পোড়া ফিল্টার, সেখানে ভারতবর্ষের নারীদের হাজার বছরের সংকোচিত মনোভাব হয় পদদলিত।

পশ্চিমের শহর রাজধানী দিল্লিতে শীত একটু বেশি। উত্তর-পশ্চিমে কালকা বা মানালির দিকে এগুলে শীত বাড়বে আরো। এই শীতে অনেকেই এখন জিন্সের সঙ্গে পরছে লম্বা বুটও।

হাতে গ্লাভস, হালকা রোদে বড় ফ্রেমের সানগ্লাস, মাথায় উলের টুপি, প্যান্ট আর রংবেরঙের সুয়েটার, জ্যাকেটে তরুণী হিন্দী মেয়েদের দেখায় সুন্দর। চলাফেরা, ভাবভঙ্গি আর পোশাকে দিল্লির তরুণীরা মিশ্রণ ঘটিয়েছে পূর্ব ও পশ্চিমের। এসব রমনীরা যখন দিল্লির শপিংমলগুলোতে কথা বলেন, সেখানে হিন্দির চেয়ে ইংরেজি উচ্চারণ শোনা যায় বেশি।

তবে দিল্লিতে স্কুটি চালানো মেয়ের সংখ্যা কলকাতা বা রাজস্থানের চেয়ে চোখে পড়ে কম। এখানে প্রাইভেট কারের ড্রাইভিং সিটে মেয়েদের স্বাচ্ছন্দ্য যেন বেশি।

৮ ডিসেম্বর দিল্লির লোদি রোডে কথা হয় মধ্য প্রদেশের লতিফপুরের স্বাস্থ্যকর্মী অরুণার সঙ্গে। তিনি খুব গর্ব করেন ভারতীয় নারীদের নিয়ে। নিজে সবসময় স্কুটি চালিয়ে যান মাঠ পরিদর্শনে। ভাল বাংলায় বলেন, “ভারতীয় মেয়েরা এখন কম সংকোচিত। অফিস, আদালত, ব্যবসা সবখানেই নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। গেলো মেট্রিকুলেশনেও ছেলেদের চেয়ে পাশের হার মেয়েদের বেশি ছিল। ”

তিনি বলেন, “উই থিংক উই আর ফ্রি, সো উই আর ফ্রি। উই থিংক উই ক্যান, সো উই ক্যান। ”

১১ ডিসেম্বর আজমির থেকে জয়পুর যাওয়ার পথের দুপাশেই শুধু মাঠ, আর পাথরের পাহাড়। মাঠে অনেক দূর পর পর কিছুটা ঝোপঝাড়। সেসব ঝোপ থেকেই বের হয়ে আসে ময়ূর। তার পেছন পেছন ছোটে রাজস্থানী নারী, যে জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়েছিল সেই ঝোপে।

পিংক সিটি জয়পুর। পুরো শহরের রং গোলাপী। অফিস আদালত, ব্যাংক পাড়া, মানুষের বাসাবাড়ি, শপিং মল বেশিরভাগ জায়গাতেই গোলাপী রঙের বাহার। যে বাড়ি দেখা যায়, সেটিকেই মনে হয় মোঘল আমলের।

রাজা মানসিংহের প্রাসাদ, হাওয়া মহল, জল মহলের শহর জয়পুর। তবে সব বাড়ি মোঘল আমলের নয়। নতুন বাড়িগুলোও পুরানো নকশায় নির্মাণ করা হয়েছে। আর মোঘলদের নকশার মতো রেডিমেড কিনতে পাওয়া যায় বাড়িতে স্থাপনের জন্যে মিনার আর গম্বুজ।

জয়পুরের নারীদের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, কি কারণে এ জায়গা বিখ্যাত। সব বয়সের নারীদের হাতভর্তি চুড়ি। কাচ, পাথর, চুমকি সবই ব্যবহৃত হয়েছে চুড়িতে। জয়পুরের শাড়িও বিখ্যাত। বাহারি শাড়ির মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছে কলাপাতা আর বাশপাতার শাড়ি। শাড়িগুলোর নকশা, বুনন সবকিছুই প্রশংসনীয়।

জয়পুরের নারীদের সাজিয়ে রেখেছে শাড়ি, চুড়ি, গলার মালা, নাকের নথ, কানের দুল, হাতের বাজু, পায়ের নুপুরসহ হরেক রকমের অলংকার।

অন্য রাজস্থানী নারীদের মতো জয়পুরের নারীরাও ঘোমটায় মোড়া থাকে। তবে ঘোমটা দেওয়া ওড়নাটাতেও আছে কারুকার্য আর নকশা। পাগড়ি যেমন প্রকাশ করে পুরুষের জ্ঞান বা শৌর্যবীর্য, তেমনি ঘোমটার ওড়না প্রকাশ করে জয়পুরের নারীর পারিবারিক বিত্ত।

জয়পুর থেকে আগ্রা যাওয়ার পথে দুপাশের শস্যক্ষেতগুলোতে নারীদের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। ধুলো মাখা পথ দিয়ে নারীরা শস্য মাথায় করে নিয়ে যায়। তাদের পায়ের নুপুর ঝিকমিক করে রোদের ঝলকানিতে।

৫ ডিসেম্বর কলকাতার হাওড়া স্টেশনে যে তরুণী মোটর সাইকেলে করে নিজের বাবাকে নামিয়ে দিয়ে যায়, তার সঙ্গে রাজস্থানের এসব নারীদের মেলানো দায়। হাওড়া স্টেশনে মোটর সাইকেল থেকে নেমে হেলমেট খুললেই কেবল বোঝা যায় চালক তরুণী।

হাওড়া থেকে দিল্লির কালকা এক্সপ্রেসে ১৭/১৮ বছরের এক মেয়ে তার দাদীকে বিদায় জানায় চমৎকার হিন্দি ভাষায়। ৭০ বছরের মিসেস গুহ জানান, কলকাতায় এখন হিন্দি বলতেই বেশি ভালো লাগে তরুণ-তরুণীদের। বাংলাকে লালন করতে চায় না তারা।

মিসেস গুহের বড় ছেলের ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট ফার্ম রয়েছে। ব্যাবসা করে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন তিনি। মায়ের সুখের জন্যে কি কি করছে তা রাতভর শোনালেন তিনি।

আবার ১৪ ডিসেম্বর দূরন্ত এক্সপ্রেসে যে নারী তার সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করায় তার মধ্যেই রয়েছে চিরায়ত নারীর সৌন্দর্য।

২৪ টিরও বেশি রাজ্যের দেশ ভারত। প্রতিটি রাজ্যেই হয় প্রকৃতির পরিবর্তন। পরিবর্তন হয় সমাজ ও সংস্কৃতির। কর্মব্যস্ত ভারতীয় নারী চলে একেক রাজ্যে একেক রূপে, একেক সৌন্দর্য নিয়ে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১২
এমএন/সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।