ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বাঁচতে চাওয়াটাই তাদের অপরাধ!

মিজানুর রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২৩
বাঁচতে চাওয়াটাই তাদের অপরাধ! ডায়ালাইসিসে ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে রাস্তায় শুয়ে পড়েন আকবর আলী

চট্টগ্রাম: ফ্যাকাসে মলিন চেহারা। দু’চোখ জুড়ে তার রাজ্যের দুশ্চিন্তা।

প্রথম দেখাতেই যে কেউ আন্দাজ করতে পারবেন কতটা কষ্টের জীবন আকবর আলীর।

সকালে এসেছেন কিডনি ডায়ালাইসিস করতে।

কিন্তু ফি বেড়ে যাওয়ায় আর করা হয়নি ডায়ালাইসিস। তাইতো বর্ধিত ফি কমানোর দাবিতে হাসপাতালের সামনেই বসে পড়েছেন তিনি।  

রোববার (৮ জানুয়ারি) সকাল ১১টার দিকে কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারের সামনে বর্ধিত ফি’র প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু আকবর আলীর মতো ভুক্তভোগীরা।

নিঃসঙ্গ আকবর আলীর ৫২ বছরের জীবনে শেষ ৭ বছর ধরে ভুগছেন এ জটিলতায়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু হওয়ার পর থেকেই সেবা নিচ্ছেন তিনি। এতদিন ধরে বড় ভাই-আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে কিডনি ডায়ালাইসিস করলেও হঠাৎ করে ফি বৃদ্ধিতে পড়েছেন বিপাকে।  

ক্ষোভ প্রকাশ করে আকবর আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমরা তো এমনিতেই মৃত। মরতে যখন হবে হাসপাতালের রাস্তায় মরবো। কিন্তু এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরার কোনও মানে হয় না। কিডনি ডায়ালাইসিসের যে খরচ তা আমার পক্ষে বহন করা সম্ভব না।  

আকবরের মতোই অবস্থা প্রফুল্ল কুমার রায়ের। মীরসরাই থেকে সপ্তাহে তিনবার আসতে হয় চমেক হাসপাতালে। এক একটি ডায়ালাইসিস করতে যত খরচ হয় তার চেয়ে বেশি খরচ মীরসাইর থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসা যাওয়ায়। সঙ্গে ডায়ালাইসিসের ফি বাড়ায় পড়েছেন যেন অতল সাগরে।

এর চেয়ে আরও কষ্টের গল্প শাহীনের। বাবাকে নিয়ে গত দুই বছর ধরে চমেক হাসপাতালে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করেন তিনি। ২১ পেরুনো এ যুবকের বাবার কিডনি রোগ তাকে দেখিয়েছে জীবনের কঠিন এক বাস্তবতা। বাবাকে বাঁচাতে তার যত সংগ্রাম তাই যেন অশ্রু হয়ে ঝরছে দু’চোখে। তাইতো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে যখন অপরাগতfর সুর, তখন তাঁর চোখে অশ্রুজল।  

শাহিন বাংলানিউজকে জানান, ঠাকুরগাঁওয়ে বাবার চিকিৎসা করাতে না পেরে চট্টগ্রাম নিয়ে এসেছি। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। পাশাপাশি টিউশন করে সংসার চালাচ্ছি। বাবার প্রতি মাসে ১২টি করে কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয়। এতে প্রতিটির জন্য ৫১০ টাকা করে খরচ পড়তো। কিন্তু এখন হঠাৎ করে দাম বৃদ্ধি হয়েছে।  আগে যেখানে সাড়ে ছয় হাজার টাকায় শেষ করতে পারতাম। এখন সেখানে প্রায় ৩০ হাজার টাকা মতো লাগবে। এত টাকার যোগান আমি কোথা থেকে দেবো। আমি মনে হয় আমার বাবাকে আর বাঁচাতে পারলাম না।  

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, স্যানডোর এতদিন দুটি মূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা দিতো। এর মধ্যে ভর্তুকির যে সেবা দিতো, তার মূল্য ছিল ৫১০ টাকা। তা বেড়ে এখন ৫৩৫ টাকা হয়েছে। এছাড়া ভর্তুকি বাদে ২ হাজার ৭৮৫ টাকায় যে ডায়ালাইসিস সেশন চালাত, তা বেড়ে করা হয়েছে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা।

আবার যাঁরা মাসে আটটি সেশন ভর্তুকি মূল্যে ডায়ালাইসিস করাতে পারতেন, তাঁদের এখন থেকে অর্ধেক পুরো ফিতে করতে হবে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এ কারণে রোগী ও স্বজনেরা আগের ফি ও ভর্তুকি সেশন আগের মতোই বহাল রাখার দাবি জানিয়ে আসছেন।  

পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের কিডনি রোগীদের জন্য ২০১৭ সালের ৫ মার্চ ৩১টি মেশিন নিয়ে চমেক হাসপাতালের নিচতলায় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারটি চালু হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বহুজাতিক কোম্পানি স্যানডোর এ সেন্টারে তাদের কার্যক্রম ১০ বছর চালিয়ে যাবে।

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শামীম আহসান বাংলানিউজকে জানান, ‘সরকারের সঙ্গে স্যান্ডর কর্তৃপক্ষের চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ফি বাড়ে। এবছরও বেড়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের এবং দরিদ্র রোগীদের বছরজুড়ে সাড়ে ছয়শ সেশন ফ্রি সেবা দিয়ে থাকি। কিন্তু বছর বছর আমাদের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অথচ সেশন বাড়ছে না।  

তিনি আরও বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, বছরে সাড়ে ছয় হাজারটি সেশনে ভর্তুকি দিয়ে ডায়ালাইসিস করানোর কথা রয়েছে। সব কটি সেশন ভর্তুকি না দিয়ে অর্ধেক ভর্তুকির সেবা নিতে বলায় রোগীরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। ভর্তুকি আরও বাড়ানো যায় কি-না, তা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত কী আসে তার ওপর নির্ভর করবে আমরা কতটুকু ভর্তুকি দিতে পারবো। তা না হলে আমাদের স্বনির্ভির হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২৩
এমআর/পিডি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।