ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

জীবনের গোধুলি বেলায় দাঁড়িয়ে মার্টিন ক্রো!

অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৫
জীবনের গোধুলি বেলায় দাঁড়িয়ে মার্টিন ক্রো! মার্টিন ক্রো

অস্ট্রেলিয়া (অকল্যান্ড): ইডেনপার্কের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ৪০ বছরের মতো। সেই ইডেনপার্কে এসেছিলেন তিনি আইসিসি’র ‘হল অব ফেম’-র পুরস্কার নিতে।



কিন্তু এই তিনি কি সেই মার্টিন ক্রো, এক সময় যাকে সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে মেনে নিতে ক্রিকেট বিশ্বের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি!

ইমরান-কপিল-বোথাম থেকে ওয়াসিম আকরাম এখনো যারা ক্রিকেট আড্ডায় বলেন- মার্টিনকে বল করার কাজটা কখনোই সহজ ছিল না। সেটা নিউজিল্যান্ডের মাটিতে হোক কিংবা বাইরে কোথাও হোক। মর্টিন ক্রো উইকেটে থাকা মানে ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের আশা বেঁচে থাকা।

কিন্তু ক্রিকেটোত্তর জীবনে সেই লোকটার এখন আর বেঁচে থাকার কোনো আশা নেই! যে কোনো সময় শোনা যাবে- ‘জীবনের ২২ গজে রান আউট হয়ে গেছেন মার্টিন ক্রো!’

নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট মহল বলেন, তার পরিবার বলেন, সবাই যেন মানসিকভাবে প্রস্তুত ও রকম কিছু শোনার জন্য। কারণ, তারা সবাই জানেন ক্রোর জীবনে এখন একটাই সত্য- ‘মৃত্যু!’

এক সময় স্কাই স্পোর্টসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন  মার্টিন ক্রো। ইডেনপার্কের প্রেসবক্সে বসে সেই  স্কাই স্পোর্টসের এক রিপোর্টারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মার্টিন ক্রো-র সঙ্গে কথা বলা যাবে কিনা।

ড্যানিয়েল রর্জাসের প্রথম জিজ্ঞাসা, কী নিয়ে কথা বলবে? ক্রিকেট! নাহ, তিনি খুব একটা কথা বলেন না। বাড়ি থেকেও বের হন না। হি ইজ নট ওয়েল!’ কেন তিনি ভালো নেই, সেটা আগেই জানা ছিল। ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে তাঁর শরীরে। সব চিকিৎসাই মোটামুটি ব্যর্থ বলা যায়। অ্যাডভান্স লিমফোমা-য় আক্রান্ত তিনি। মাত্র ৫৩ বছর বয়সেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। সব কিছু জেনে শুনেও প্রেসবক্সের উল্টো দিকে  আইসিসি বক্সে পৌঁছেছিলাম অনেক চড়াইউৎড়াই পেরিয়ে। কিন্তু সেখানে যে ক্রো-কে দেখলাম, তাতে বুঝতে অসুবিধা হলো না, এই লোকটার সঙ্গে কথা বলা মানে তাঁর শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেওয়া। জীবনের কাছে ক্রিকেট খুব বড় কোনো বিষয় হতে পারে না।

যে লোকটার জীবনের ইনিংস থেমে যাওয়ার পথে, যেখানে আর কোনো রিভিউ সিস্টেম কাজ করছে না, থার্ড আম্পয়ার বলতে ‘ঈশ্বর’ যদি তাঁকে কিছুটা ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিয়ে  কয়েকটা দিন বাঁচিয়েও রাখেন, তাতেও তাঁর ইনিংস আর খুব লম্বা হবে না। এই লোকটার কাছে তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার, বিশ্বকাপ এসব নিয়ে কথা বলা মানে সৌজন্যতার সীমানা পেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেটা কি সম্ভব!

‘হ্যালো’ বলে নিজের পরিচয় দিতে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করলেন ক্রো অনেক কষ্টে! সেটাকে বলা যেতে পারে বিষণ্নতা মেশানো হাসি,  যা মিলিয়ে যেতেও খুব একটা সময় লাগেনি!

কিন্তু তাঁকে আরো বেশি বিষণ্ন লাগলো যখন, ইডেনপার্কের বাউন্ডারি লাইনের কাছে দাঁড়িয়ে আইসিসি’র ‘হল অব ফেম’-র অ্যাওয়ার্ড হিসেবে ক্যাপটা নিলেন! কেমো নিতে নিতে মাথায় একটা চুলও নেই। শরীরও বেশ খানিকটা ভেঙে গেছে। কথা বলতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাও মনে হলো না। তবু কিছু বলতেই হলো।

৪০ হাজার দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে কেন, মার্টিন ক্রো ৯০ হাজার দর্শকের সামনে দাঁড়িয়েও কথা বলেছেন। কিন্তু এবার তিনি অনেকটাই নার্ভাস। ক্লান্তি ভর করেছে তাঁর শরীরে। কথা বলা তাই কঠিন। তবু থেমে থেমে কয়েকটা বাক্য বললেন। হয়ত কষ্ট করেই বললেন- ‘তৃতীয় নিউজিল্যান্ডার হিসেবে আইসিসি’র হল অব ফেমে জায়গা পেয়ে আমি গর্বিত। আমি গর্বিত আমার বন্ধু রিচার্ড হ্যাডলির পাশে নিজের নাম দেখে। তবে আর একটু বেশি গর্বিত নিউজিল্যান্ডের প্রথম নর্দার্ন আইল্যান্ডার হিসেবে এই পুরস্কারটা পেয়ে। হ্যাডলি, ক্রো ছাড়া নিউজিল্যান্ড নারী ক্রিকেট দলের সাবেক সদস্য ডেভিড হকলি পেয়েছেন এই পুরস্কার।

মার্টিন ক্রো যখন পুরস্কারটা নিচ্ছিলেন, তখন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফর্ম করছিলেন নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা। সেটা দেখে অবশ্যই উচ্ছ্বসিত ছিলেন মার্টিন ক্রো। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাসের বহির্প্রকাশ ঘটানোও তাঁর জন্য কঠিন ছিল। তবু বললেন, আমি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটকে ভালোবাসি। আজ হচ্ছে সেই  দিন, যাকে বলবো, ‘ডে টু ব্লিভ। ’

নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলতে পারাটা তাঁর জীবনের বড় এক সফলতা। তাই, ধন্যবাদ জানালেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটকে। কৃতজ্ঞতা জানালেন বাবা-মার প্রতি। কৃতজ্ঞতা জানালেন নিউজিল্যান্ডের মানুষের প্রতি যাদের ভালোবাসায় ধন্য হয়েছেন তিনি।

মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত মার্টিন ক্রোর ক্রিকেট ক্যারিয়ার ছিল বর্ণিল। বিশ্বকাপ আসলেই ক্রো-র কথা মনে করতেই হবে। রঙিন পোশাক আর সাদা বলের প্রথম বিশ্বকাপ হয়েছিল ’৯২-এ অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে। সে সময় নিউজিল্যান্ড দলের অধিনায়ক ছিলেন মার্টিন ক্রো। ওয়ানডে ক্রিকেটে একটা  বিপ্লবও ছিল তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। মার্ক গ্রেট ব্যাচকে দিয়ে ইনিংস ওপেন করানো; ‘পিঞ্চ হিটিং’ শব্দটাকে ক্রিকেট বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করা। এর পাশাপাশি দীপক প্যাটেল নামে এক অফ স্পিনারের হাতে নতুন বল তুলে দেওয়া। সবই ছিল মার্টিন ক্রোর চিন্তার ফসল। সেই সঙ্গে তিনি নিজেও ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। একাই টেনে নিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত।

এরপর এই ইডেনপার্কেই তাঁর স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল ইমরান খানের পাকিস্তানের সামনে পড়ে। আরো পরিস্কার করে বললে বলতে হবে, ইনজামাম-উল-হক নামে এক তরুণের অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ের কারণে। নিজের সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু অন্যান্য নিউজিল্যান্ডবাসীর মতো তিনিও বিশ্বাস করছেন, নিউজিল্যান্ডের এবারের দলটার বিশ্বকাপ জেতার ক্ষমতা আছে। যদিও তিনি কাপ জয়ের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা দেখছেন সাউথ আফ্রিকার।

অবশ্য মার্টিন ক্রো ভালোভাবেই জানেন,  বিশ্বকাপ কার হাতে উঠবে সেটা ঠিক হবে ২৯  মার্চ রাতে মেলবোর্নে। সেখানে তিনি থাকছেন না এটা মোটামুটি নিশ্চিত। জীবনের বাকি সময়টুকু পরিবার নিয়েই কাটাতে চান তিনি। ক্রিকেট তাঁর জীবনে এখন অনেক পরের ব্যাপার। কারণ, যার ক্রিকেট ক্যারিয়ার ছিল বর্ণময়, সেই মার্টিন ক্রো নিজেই জানেন তিনি এখন জীবনের গোধুলি বেলায় দাঁড়িয়ে! যেখানে রংধনু নেই। নেই কোনো রঙ। সব কিছুই যেন ধূসর। আর সেটা উপলব্ধি করেই কি ইডেনপার্কে এসেছিলেন মার্টিন ক্রো ধূসর রঙের স্যুট-টাই পরে! ধূসরই কি তাঁর কাছে এখন প্রিয়!

কিন্তু জীবনের ধূসর গোধুলি বেলায় দাঁড়িয়েও কিছুদিন আগে তিনি রাঙিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটকে! শরীরের এই অবস্থাতেও ব্যাট করতে নেমেছিলেন তিনি। তাঁর স্থানীয় ক্লাব কর্নওয়েলের হয়ে একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ব্যাট করেছেন তিনি। ২০ বলে অপরাজিত ছিলেন ২৫ রানে। ওটাই তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংস। সেখানে অপরাজিত থাকলেন। কিন্তু জীবনের ইনিংসে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে। ক্রোর কথা দিয়েই শেষ করতে চাইছি লেখাটা।

‘ডে টু ব্লিভ’। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, মার্টিন আপনি যেখানেই থাকবেন, ভালো থাকবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১৫

** শচীন আছেন শচীন নেই! | অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ব্রিলিয়ান্ট! সুপার! গ্রেট! অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** বাংলাদেশের ব্র্যান্ড সাকিব!|| অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** মিরপুর টেক্কা দিচ্ছে মেলবোর্নকে ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে বাকযুদ্ধ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** নীল-হলুদ নাকি লাল-সবুজের ঢেউ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** চোক’ কি ক্রিকেটীয় জোক?। । অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** সাকিব-ই সেরা মানতে অসুবিধা কোথায়!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** বৃষ্টিবিলম্বিত ক্লার্কের ফেরা! না থেকেও আছেন আশরাফুল॥ ব্রিসবেন থেকে অঘোর মন্ডল
** শঙ্কার চোরা স্রোত ব্রিসবেনে॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ম্যাচের নায়করা ছিলেন বাইশ গজের বাইরে। । অঘোর মন্ডল, ক্যানবেরা থেকে
** ‘সি’ ফর ক্রিকেট নাকি সাইক্লোন!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।