ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

কুয়াকাটা উপাখ্যান-২

অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্ম্য থামে না

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩০ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৫
অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্ম্য থামে না ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সমুদ্রের নোনা জলের ঝাপটায় অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে জেগে আছে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। বিকাশের ধারায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে এই পর্যটন কেন্দ্র।

অনেক সম্ভাবনা, অনেক স্বপ্ন। এখানকার সৈকতের দীর্ঘ বেলাভূমিতে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আকর্ষন দেশজোড়া।

দলে দলে পর্যটকেরা ছুটে আসেন এই বেলাভূমিতে। তবুও কোথায় যেন থেকে যায় একের পর এক সংকট। জটিলতার অবসান হয় না কিছুতেই। সংকটের ভেতর দিয়েই ডানা মেলছে কুয়াকাটা। তারপরও প্রতিটি নতুন ভোরে নতুন আশাবাদ। এই বুঝি কুয়াকাটা ফিরে পেল প্রাণ। এইসব নিয়ে কুয়াকাটা উপাখ্যান শিরোনামে বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ঘুরে এসে: যে যেভাবে পারছে দখল নিচ্ছে। কেউ ভ‍ুয়া কাগজপত্র তৈরি করে, কেউবা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়। নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্ম্য থামে না। আর অবৈধ দখলের কারণে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। অপরিকল্পিত বাড়িঘর উঠে এখানে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কুয়াকাটার বেড়িবাঁধের বাইরে সৈকতপাড় পর্যন্ত সড়কটির দুইদিকে ও আশপাশে শতাধিক স্থাপনা রয়েছে। চিহ্নিত একটি চক্র ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এসব স্থাপনা তুলেছে। সৈকত এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরের সাড়ে চার সহস্রাধিক একর জমি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এই অবৈধ স্থাপনাগুলোর কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় জীবনহানির শঙ্কায় থাকছে পর্যটকসহ হাজারো মানুষ।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, অবৈধ দখল কুয়াকাটার অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র বিকাশের পথে এটি বড় বাঁধা। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে উচ্চ আদালতের আদেশ রয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি রয়েছে, এমনকি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের সীমানাও নির্ধারণ করা হয়েছে। তারপরও কুয়াকাটাকে দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না।

সূত্র বলছে, উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে বিভিন্ন কৌশলে ভ‍ুয়া কাগজপত্র তৈরি করে কুয়াকাটায় দখলদারিত্ব অব্যাহত রয়েছে। বারবার উচ্ছেদ হলেও নতুন করে আবার দখল চলে। ২০১১ সালের ২ জুন পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে সব ধরনের স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় দু’শতাধিক স্থাপনা ভেঙে দেয় পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন। দীর্ঘদিন ধরে স্থাপনা তোলার কাজ বন্ধ থাকে। ওই সময় কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা করতে ওই সময় দুটি রুলও জারি করা হয়।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের একটি রিট (পিটিশন নং-৫১৬২/২০১১) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও গোবিন্দ ঠাকুরের বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

একই বছরের ১ জুন একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংস্থাটির পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ও আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী এ আবেদন করেন।

অবৈধ স্থাপনা অপসারণের আদেশ বাস্তবায়ন করে সাত দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার ও কলাপাড়া থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

একই সঙ্গে কমিটি গঠন করে সমুদ্র সৈকতের সীমানা চিহ্নিত করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয় আদালত। সৈকত এলাকার যে কোন ধরনের দখল ও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থা করতে জেলার পুলিশ সুপার ও কলাপাড়ার ওসিকে বলা হয়েছে।

উচ্চ আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি সৈকত এলাকা জরিপ করে খসড়া ট্রেসম্যাপ করে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকার সীমানা নির্ধারণ করে।

এতে পশ্চিম দিকে আন্ধারমানিক নদীর মোহনা এবং বঙ্গোপসাগরের সংযোগস্থল থেকে কাউয়ারচর মৌজার উত্তরপুর্ব সীমানার রামনাবাদ চ্যানেল পর্যন্ত সৈকত এলাকা নির্ধারণ করা হয়।

কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সিডর, আইলা, জলোচ্ছ্বাসে সৈকত এলাকার বেড়িবাঁধ পর্যন্ত প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। জলবায়ুর দ্রুত পবির্তনজনিত কারণে ভবিষ্যতে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করে বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাস করা নিরাপদ নয়। সমুদ্রের জোয়র-ভাটার সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ উচ্চতা বিবেচনা করেই এ সৈকত এলাকা নির্ধারণ করা হয়।

তিন সদস্যের কমিটি সৈকত এলাকায় মাটি ভরাট, অবৈধ অনুপ্রবেশ, স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ প্রতিরোধ করতে সুপারিশ করেন।

ওই সময়ে তৈরি করা ট্রেসম্যাপ অনুসারে চারটি মৌজার চার হাজার ৭২৪ দশমিক ৬০ একর জমি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। যার মধ্যে লতাচাপলী মৌজায় এক হাজার ৯৭ দশমিক ৮৬, গঙ্গামতি দুই হাজার পাঁচশ’ ১০ দশমিক ৪৭ একর, কাউয়ারচর এক হাজার ৪৪ দশমিক ৮৩ একর এবং চরচাপলী ৭১ দশমিক ৪৪ একর।

একই সময় উচ্ছেদের জন্য ২২৮ স্থাপনা শনাক্ত করা হয়। এসব বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে ২০১১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে এক সভা হয়।

হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশনের আদেশ প্রতিপালনার্থে এ সভা হয়। সভায় সৈকত এলাকার স্থাপনা অপসারণের পরে পুনরায় যাতে কোন স্থাপনা তুলতে না পারে এ বিষয় পুলিশ সুপারকে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কিন্তু পুলিশ প্রশাসন, ভূমি প্রশাসন, বিচ ম্যাজেমেন্ট কমিটি কিংবা কুয়াকাটা পৌরসভা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় চলছে এসব স্থাপনা পুননির্মাণসহ নতুন নির্মাণকাজ।

মহিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, কুয়াকাটা বেড়িবাধেঁর বাইরে পর্যটন মার্কেটে লতাচাপলী মৌজার ৭৪৩ খতিয়ানের ৭৪৭৫ নম্বর দাগের মাত্র ২৪ শতাংশ জমি রেকর্ডীয় থাকলেও প্রায় দুই একর সরকারি খাসজমি দখল করে মার্কেট ও আবাসিক হোটেল করা হয়েছে।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বেলাভূমি দখল করে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তোলা হয়। কোথাও আবার কাঁটাতারের বেঁড়াও দেওয়া হয়। অন্যদিকে কুয়াকাটা সৈকতের শেষপ্রান্তে কাউয়ারচর বেলাভূমে একাধিক হাউজিং কোম্পানি শত শত সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। বিভিন্ন সময় এসব সচিত্র প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও জেলা প্রশাসন নামেমাত্র দখলদার উচ্ছেদের নামে কখনও নোটিশ, কখনও নামমাত্র উচ্ছেদ অভিযান চালায়।

অবৈধ স্থাপনা প্রসঙ্গে একাধিক স্থাপনার মালিক বলেন, এমনিতেই সাগরে সব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই সৈকত তীরে কোনভাবে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।   

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কুয়াকাটা বিচ ম্যনেজমেন্ট কমিটির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, এসব স্থাপনার মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

** কুয়াকাটা উপাখ্যান-১: সৈকত সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই

বাংলাদেশ সময়: ০২২২ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৫
আরআইএম/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।