ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

মাঝরাতে জোয়ারের গর্জনে ঘুম ভাঙে

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৮ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৫
মাঝরাতে জোয়ারের গর্জনে ঘুম ভাঙে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলাপাড়া, পটুয়াখালী: বর্ষায় বাড়ির আঙিনায় চলে আসে জোয়ারের পানি। কখনো ভাসায় বাড়ি-ঘর, ফসলের ক্ষেত।

সারা বছরের সঞ্চিত সম্পদ ভেসে যায়। সারাক্ষণ আতঙ্ক-ভয়। এর মধ্যেই বেঁচে থাকা। কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা।

এসব কষ্টের কথাগুলো জানাচ্ছিলেন সমুদ্র তীরবর্তী জ্যেষ্ঠ নাগরিক সেরজন মৃধা।    

তিনি বলেন, ‘বাবারে জোয়ার আইলই ডর হরে। একটু বাতাস বাড়লেই জোয়াররে পানি ঘরে ওডে। কোথায় যামু? যাওয়ার যাগাও নাই। ধার-দেনা করতে করতে শেষ পর্যন্ত দেনা লইয়াই মরতে অইবে মনে হয়। ’

বসতঘরের সামনে বিশাল নদীর তীরে বসে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন তিনি। বয়স তার পঁচাত্তর পার হয়েছে। এখনও হাঁটা-চলা এমনকি কিছু কাজকর্মও করতে পারেন। জীবিকার প্রয়োজনে এই বয়সেও কিছু কাজ করতে হয় তাকে।
 
সেরজন অস্থায়ীভাবে ঘর বেধেছেন কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের আন্ধারমানিক নদীর মোহনায় ৪৮ নম্বর পোন্ডারের বেড়িবাঁধের পাশে। এ বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকেছে নিজামপুরসহ চার গ্রামে। এর ফলে প্রায় দুই সহস্রাধিক পরিবার নি:স্ব হয়ে পড়েছে। তাদেরই একজন সেরজন মৃধা।

কথায় কথায় সেরজন জানালেন, জমি ছিল তিন একর। সাত ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার চলছিল খুব ভালো। বাঁধের ভেতরে তিন একর জমিতে ফসল ফলতো সব ধরনের। ছেলেদের কয়েকজনকে জাল-নৌকা করে দিয়েছেন বাবা সেরজন। এলাকায় তার যথেষ্ট সম্মান ও সুনাম ছিল। কিন্তু শেষ বয়সে সেরজন আর সেই সুদিন দেখে যেতে পারলেন না। বাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারের পানি যেন তার সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

নদী থেকে এখন তার বসতঘরের দূরত্ব মাত্র ২০ ফুট। গভীর রাতে জোয়ারের ঢেউয়ের শব্দে অনেকবার ঘুম ভাঙে তার। পাঁচ ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে সবাইকে বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিলেও বয়সী সেরজন মৃধা নিজের ঘরেই রয়ে গেছেন ছোট ছেলের সঙ্গে। জীবনের শেষ বেলায় সব ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে শান্তিতে কাটাবেন, এমন স্বপ্ন থাকলেও বাঁধের ভাঙন সব কেড়ে নিয়েছে। হঠাৎ কবে জোয়ারের পানিতে ভেসে যেতে হয়, সেই ভয়ে থাকতে হয় সারাক্ষণ।

নদীর তীর থেকে বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে বললে সেরজন বলেন, ‘কই যামু? তিন একর জমি, যে জমির মূল্য ছিল প্রতি একর ১২ লাখ টাকা, এহন লবণ পানিতে হেই জমি ডুইবব্যা থাহে। এই জমি কেউ ৫ হাজার টাহায় একর কেনবে না। কন কেমনে কি করমু? এক টাহা ইনকাম নাই। গত দুই বছর ধইরা ধার-দেনা কইরা চলি। এহন দুই লাখ টাকা দেনা আছি। দেনা দিমু না কি করমু কিছুই বুঝি না। সরকারের কতো টাহা, একটা ভাঙ্গা রাস্তা জোড়া দিতে পারে না? মোগো কষ্ট কি হেরা বোঝে না? হেরা যদি এমন কষ্টে থাকতো, হেইলে বোঝতো’।

কথাগুলো বলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই অনেক কথা বেরিয়ে আসে সেরজন মৃধার কণ্ঠ থেকে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা জল। কিন্তু এ কষ্টের শেষ কোথায় তা জানেন না সেরজন মৃধা।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এমন বহু বিপন্ন মানুষের অজানা গল্প। জীবনব্যাপী তাদের যুদ্ধ। দুর্যোগ তাদের তাড়িয়ে ফেরে। নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, ঝড়, লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে এসব মানুষদের বাড়ি বদল করতে হয় বার বার। কিন্তু পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না।

তারা বার বার পরাজিত হন জীবনযুদ্ধে। তবুও বেঁচে থাকার অবিরাম চেষ্টা এদের।      

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরা-খবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]  ]

বাংলাদেশ সময়: ০০৫৭ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৫
আরআইএম/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।