ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

অরক্ষিত উপকূল-৫

নিয়তির ওপর ভর করে বাঁচা!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২০ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৫
নিয়তির ওপর ভর করে বাঁচা! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দুর্যোগ-দুর্বিপাকে উপকূলে বিপন্নতা বাড়ে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাড়িঘর।

আশ্রয়হীনেরা ছুটে চলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। বাপ-দাদার পুরনো ভিটে ছেড়ে দিয়ে মাথা গোঁজে বাঁধের ধারে।

কারো ঠিকানা মেলে শহরের রাস্তার ধারে। কখনো জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব, কখনো-বা অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়া।

বর্ষায় ভাঙনের চিত্রটা এখন একেবারেই স্বাভাবিক। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপকূলে বাড়ছে এই দুর্যোগের ঝুঁকিও। দুর্যোগ মৌসুমে উপকূলবাসীর দুঃশ্চিন্তার যেন শেষ থাকে না। প্রতিনিয়ত ঝুঁকি বাড়তেই থাকে। তবু উপকূল থেকে যায় অরক্ষিত।

এই সব নিয়ে ‘অরক্ষিত উপকূল’ শিরোনামে বাংলানিউজের আট পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব-

উপকূলের বিপন্ন জনপদ ঘুরে:
উপকূলের সমুদ্রপাড়ে এমন কিছু এলাকা রয়েছে, যেখানে মানুষের বেঁচে থাকা পুরোটাই প্রকৃতি-নির্ভর।

পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে গেলে আশ্রয়ের খোঁজে উঁচু স্থানে কিংবা গাছের ডালে উঠতে হয়। এখান থেকে ইচ্ছে করলেই মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার সুযোগ নেই। দুর্যোগের সময় এখানকার মানুষেরা একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই তাদের নিরাপত্তা নেই। অথচ এটাও বাংলাদেশের একটি ছোট্ট ভূখণ্ড। নির্বাচন এলে এখানকার বাসিন্দারা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। এই সব মানুষদেরও আছে অধিকার কিছু চাওয়া-পাওয়ার।

সমুদ্র মোহনার ছোট্ট দ্বীপ চরনিজামের বাসিন্দারা এভাবেই তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের বিবরণ তুলে ধরছিলেন বাংলানিউজের কাছে।

সরেজমিন তথ্য সংগ্রহে গেলে সেখানকার মানুষের অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। তবে এই তালিকার মধ্যেও আবার প্রধান হয়ে ওঠে চরে যাতায়াতের রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সাইক্লোন শেল্টার আর খাসজমি বন্দোবস্তের দাবি।

এই দ্বীপে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপে ভিন্ন এক চিত্র পাওয়া গেল। দুর্যোগের মৌসুম এলে এখানকার মানুষেরা বড় আকারের মিলাদের আয়োজন করেন। এ জন্য অঞ্চলের বড় হুজুরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কোনো এক ভোরে ফজর নামাজের পর এই দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অংশ নেয় দ্বীপের সব মানুষ। এই আয়োজনের জন্য দ্বীপবাসী চাঁদা দেন। এভাবে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে দ্বীপের মানুষ দুর্যোগ থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন। অদৃষ্টই তাদের একমাত্র ভরসা হয়ে আছে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে।   

উপকূলের দ্বীপজেলা ভোলার দ্বীপউপজেলা মনপুরার ছোট্ট দ্বীপ চরনিজামের অবস্থান সমুদ্রের মোহনায়। মেঘনা অববাহিকায় জেগে থাকা এই দ্বীপের পরই শুরু হয়েছে, সমুদ্রের সীমারেখা। প্রতিদিন এই দ্বীপে যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। দিনগুণে এখানে যাতায়াত করতে হয়। মঙ্গলবার চরনিজাম থেকে যে ট্রলারটি চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাটে আসে, সেটিই আবার চরনিজাম যায় শনিবার।

আবার শনিবার যে ট্রলারটি চরনিজাম পৌঁছায়, সেটি বেতুয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে মঙ্গলবার। বেতুয়া থেকে মনপুরা পৌঁছাতে আবারও মেঘনা নদী পার হতে হয়।

চরনিজামের বাসিন্দারা এটাকে সহজভাবে ‘বন্দিজীবন’ বলে উল্লেখ করলেন। তারা জানালেন, এখানকার মানুষ এক অর্থে বন্দি অবস্থায়ই বেঁচে আছে। কারণ, এখান থেকে ইচ্ছে করলেই বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ৩-৪ দিন পর পর যাতায়াতকারী ট্রলারও দুর্যোগের সময় বন্ধ থাকে। জরুরি প্রয়োজনে দ্বীপের বাইরে আসার কোনো সুযোগ নেই এখানকার বাসিন্দাদের।

চরনিজামের জালিয়াখাল এলাকায় পড়ন্ত বিকেলে চোখে পড়ে অনেক মানুষের ভিড়। শুকনো খালের ঘাটে বাঁধা কিছু মাছধরা নৌকা। পরেরদিন মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতিতে জেলেরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ছিঁড়ে যাওয়া জাল মেরামতে ব্যস্ত কেউ কেউ। অনেকে আবার নৌকা মেরামত করছেন। কোনো নৌকা থেকে আবার উড়ছে রান্নার ধোঁয়া। এরই মধ্যে শিশুদের কোলাহল, খেলাধুলা।

পাশেই ফাঁকা পড়ে আছে, চরের খাসজমি। দূরে বনের গাছপালা। এখানেই আলাপ কয়েকজন চরবাসীর সঙ্গে।

সত্তর বছর বয়েসী রফিকুল ইসলাম। এখন কোনো কাজ করতে পারেন না। এখানে এসেছেন ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর। এই সময়ে অনেক যুদ্ধ করেছেন। লড়াই করেছেন প্রকৃতির সঙ্গে।

এই প্রবীণ চরবাসী বলছিলেন, এখানের মানুষদের আল্লাহ-ই বাঁচিয়ে রেখেছেন। জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় ঘরবাড়ি। বড় ঝড় হলে বাড়িঘর উড়ে যায়। মানুষদের আশ্রয়ের কোনো স্থান নেই।

চরনিজামের কালকিনি বাজারের ঘাটে ভেড়ে ট্রলার। এই বাজার থেকে চরের ভেতরে যাতায়াত খুবই কঠিন। কিছুদিন আগে চরের ভেতর দিয়ে একটি রাস্তা হলেও জোয়ারের পানিতে সে রাস্তার মাটি ভেসে গেছে। কাদাপানির কারণে রাস্তার কিছু অংশ দিয়ে হাঁটাচলা প্রায় অসম্ভব। স্থানীয় বাসিন্দারা কখনো বাড়িঘরের ভেতর দিয়ে, কখনো শুকিয়ে যাওয়া খাল পেরিয়ে যাতায়াত করেন।

চরে একটিমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র। একটি পুলিশ ফাঁড়ি আছে। রয়েছে বন বিভাগের একটি অফিস। সাইক্লোন প্রিপারডনেস প্রোগ্রাম (সিপিপি)’র আওতায় একটি ওয়্যারলেস থাকলেও সেটি বিকল হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। অথচ এই চরে বসবাস করছেন পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত অধিকাংশ সেবা কার্যক্রমের বাইরেই রয়েছেন এখানকার মানুষ।  

সরেজমিন জানা যায়, চরনিজামের বাসিন্দারা সমুদ্রকেন্দ্রিক জীবিকায় টিকে আছেন। কেউ মাছ ধরে, কেউবা মাছের ব্যবসা করে। বছরের সারা মৌসুমই মাছ ধরা চলে। তবে বর্ষায় ইলিশ মৌসুমের আয়-রোজগার একটু বেশি। কিন্তু এবার ইলিশ না পড়ায় প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে চরনিজামের কালকিনি বাজার। চায়ের দোকানের আড্ডা, হাটবাজারে বেচাকেনা, এমনকি ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি আদায় সবই নির্ভর করে ইলিশ পাওয়া-না পাওয়ার ওপর।

পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ১৯৬২ সালের দিকে এই চরে বসতি স্থাপন শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষেরা এই চরে স্থান নেন। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন সরকার প্রধান হেলিকপ্টারে একাধিকবার এই চরে এসে এখানকার বাসিন্দাদের সুবিধা নিশ্চিতকরণে নজর দেন। ৭০টি ভূমিহীন পরিবারকে ওই সময় তিন একর করে খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। তারা নিজেদের জমির দখল পেয়েছেন।

কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৪ সালে এখানে বন্দোবস্তকৃত ৪৫০ পরিবার তাদের নামে বরাদ্দকৃত দেড় একর করে খাসজমি আজও বুঝে পাননি।

সুখ নেই নোয়াখালীর দ্বীপ হাতিয়ার সুখচরে:
সুখ নেই নোয়াখালীর দ্বীপ হাতিয়ার সুখচরে। এই ইউনিয়নটির দুই-তৃতীয়াংশ মেঘনায় ডুবেছে। কয়েক হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যখানে চলে গেছেন। ভাঙনে এলাকা ছোট হয়ে যাওয়ায় পরিষদের নির্বাচনও হচ্ছে না। অথচ ইউনিয়নটিতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, পুরোটাই। নির্বাচন ছাড়া চেয়ারম্যানও আছেন বহাল তবিয়তে। নির্বাচনবিহীন অবস্থায় জনপ্রতিনিধির জবাবদিহিতা না থাকায় ইউনিয়নের উন্নয়ন বরাদ্দ লুটপাট হচ্ছে। এলাকাবাসী রয়েছেন চরম সংকটে।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের এই ইউনিয়নটির প্রায়-দুই তৃতীয়াংশ এরই মধ্যে মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ইউনিয়নের ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড পুরোটা এবং ২ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আংশিক অবশিষ্ট আছে। ভূমি অফিসের রেকর্ডে ইউনিয়ন ছোট হয়ে যাওয়ার এই তথ্য থাকলেও ইউনিয়ন পরিষদ বলছে, ইউনিয়নের ৬টি ওয়ার্ড এখনও অবশিষ্ট আছে।

বাংলানিউজের সরেজমিনে উঠে আসে ক্ষয়িষ্ণু এই ইউনিয়নের নানা তথ্য। ইউনিয়নের পথঘাট ঘুরলেই বোঝা যায়, কতটা অবহেলিত এই জনপদ। বাঁশের সাঁকো আর নৌকা পার হয়ে যেতে হয় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ। ভাঙনের মুখে থাকা বসতিগুলো একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। বহু মানুষ ঘরবাড়ি বদলাচ্ছেন। কিছু মানুষ রাস্তার পাশে, কিছু আবার দূরে কোথাও মাঠের ভেতরে ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন।

মেঘনা তীরের বেড়িবাঁধ দিয়ে পায়ে হেঁটে চলতেও পথে পথে বাঁধার মুখে পড়তে হয়। এখানের মানুষেরা চরম সংকটের শিকার। কিন্তু এইসব মানুষের নামে আসা বরাদ্দের সিকি অংশও তাদের কাছে পৌঁছায় না, এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর।   

মেঘনার তীর ধরে সুখচর ইউনিয়নের প্রায় আড়াই কিলোকিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙনের শিকার। নদী ক্রমাগত ভাঙছে। আর কোনো রকমে জোড়াতালির বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। আবার কোথাও সময়মতো বাঁধ মেরামত না হওয়াতে ভাঙন খালের রূপ ধারণ করে লোকালয়ের দিকে ঢুকে পড়েছে।

ইউনিয়নের হরিণ বাজার, চেয়ারম্যান বাজারসহ আশপাশের এলাকায় এমন বেশ কয়েকটি খাল চোখে পড়ে। বর্ষায় এখাল দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে বাড়িঘরে। সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে জোয়ার আর জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ডুবে বেঁচে থাকার কষ্টের কথাই জানাচ্ছিলেন এলাকার লোকজন।

উপকূলের ৭১০ কিলোমিটার জুড়ে বিচ্ছিন্ন জনপদগুলোতে এভাবেই মানুষের বেঁচে থাকা পুরোপুরি প্রকৃতি-নির্ভর। শুকনো মৌসুমে মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে দিন অতিবাহিত হলেও দুর্যোগের মৌসুম তাদের জন্য আতঙ্ক নিয়ে আসে।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামে বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০৪১৫ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৫
এবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।