ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

গ্রামে ফেরা যুবকের স্বপ্নভঙ্গ!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৪
গ্রামে ফেরা যুবকের স্বপ্নভঙ্গ! ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লালুয়া, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: পৈত্রিক ভিটে আঁকড়ে থাকার আশা নিয়ে গ্রামে ফেরা। জমিতে ক্ষেত-খামার করে জীবন ধারণ, আর গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন ছিল তার।

গ্রামে শিক্ষা প্রসারে তার ছিল বিশেষ আগ্রহ। বাপ-দাদার জমি-জিরাত ভালোই ছিল। সেই ভরসাতেই দূরের বেসরকারি চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফেরার সিদ্ধান্ত।

কিন্তু সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। জমি তো গেলই, বাড়ির ভিটেটাও ভাঙণের ঝুঁকিতে। সেই স্বপ্ন জাগানিয়া বিএ পাস যুবক জীবিকার তাগিদে গ্রামের স্কুলে নাইটগার্ডের চাকরির জন্য আবেদন করতেও দ্বিধা করলেন না। এই চাকরিটাও মিলবে কীনা জানেন না সিরাজুল।  

গল্পটা সিরাজুল ইসলামের। বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের চারিপাড়া গ্রামে। সরেজমিনে এই গ্রামের মানুষের তথ্য সংগ্রহে গেলে এগিয়ে আসেন এই যুবক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে গ্রামের সবকিছু ওলট-পালট হওয়ার সঙ্গে তার জীবনটাও জড়িত। সহায়-সম্পদ যা ছিল, তা শেষের পথে। সামান্য জমি আবাদের জন্য ঋণের টাকায় কিনেছিলেন মহিষ। তা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। জমিতে ফসল হয় না, আবার মহিষের খাবারও নেই।

রামনাবাদ নদী তীরের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ায় গ্রামের পর গ্রাম যেন ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে শুধু হাহাকার। কাজ ও খাদ্যের অভাবে মানুষ ছুটছে এখানে সেখানে। অনেকে আবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। যুবক সিরাজুল এখনও আছেন চারিপাড়া গ্রামে। নিজের এই গ্রামে কিছু একটা করার প্রত্যয় নিয়েই গ্রামে ফিরেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন তার কষ্টের দিন। একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ত্রী নাসরিন আক্তারের মাত্র চার হাজার টাকা মাইনের চাকরিটাই এখন সিরাজুলের সংসার চালানোর ভরসা।

চারিপাড়া গ্রামের দুর্গম পথে হাঁটতে গিয়ে সিরাজুলের কথায় নিজের জীবনের গল্পটাও উঠে আসে কখনো কখনো। একটি বেসরকারি সংস্থায় দু’বছর চাকরি করেছেন। কিন্তু গ্রামের টানে সেখানে অল্প মাইনের চাকরি করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। অন্যদিকে বৃদ্ধ বাবা শামসুল হাওলাদারকে দেখাশুনার ভারও তার ওপর পড়ে। সব কিছু বিবেচনায় সিরাজুল চাকরি ছেড়ে গ্রামে। কিন্তু এরই মধ্যে সিরাজুলের সম্পদের অনেকটা নদীতে হারিয়েছে। বাবার তিন বিঘা জমির মধ্যে আছে মাত্র ৪০ শতাংশ। শেষ পর্যন্ত সংসার চালিয়ে নেওয়াটাই কঠিন হয়ে পড়ে।

সিরাজুল দ্বিধা করেননি। জীবনটা চালিয়ে নেওয়াই যেন তার কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়। অনেকটা সংকোচের সঙ্গে নিচু গলায় সিরাজুল জানালেন, গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাইটগার্ড পদে একজন লোক নিয়োগের খবর পেয়ে সেখানে আবেদন করেছিলেন তিনি। প্রার্থী ছিল কয়েকজন। অনেক কষ্টে বিএ পাস করা যুবক সিরাজুলের অবশেষে নাইটগার্ডের চাকরিটাও জুটবে কীনা জানেন না।     

এর আগে সরকারের খাদ্য বিভাগের পিওন পদে চাকরি জন্য আবেদন করেছিলেন। চাকরিটা পাওয়ার জন্য কিছু টাকা প্রয়োজন ছিল। সিরাজুলের সে সামর্থ্য ছিল না। কম নয়, তিন লাখ টাকায় সেই চাকরির ‘সমঝোতা’ হয়েছে, অভিযোগ সিরাজুলের। সুপারিশ করার মত লোক ছিল না বলে রেডক্রিসেন্টের কমিউনিটি অর্গানাইজার পদের চাকরিও জোটেনি গ্রাম নিয়ে স্বপ্ন দেখা এই যুবকের ভাগ্যে।

সিরাজুলের স্বপ্ন ছিল গ্রামেই থাকবেন। গ্রামের মানুষের উন্নয়নে কাজ করবেন। শিক্ষা প্রসারে কাজ করার কিছু পরিকল্পনা ছিল তার। বয়স্ক শিক্ষার বিষয়ে তার ছিল বিশেষ আগ্রহ। করেছিলেনও কিছু কাজ। এখন সব ফেলে নিজেকেই জীবিকার তাড়নায় ছুটতে হচ্ছে এখানে সেখানে। মাঝে মাঝে সিরাজুলের মনে হয়, কষ্ট করে শিক্ষা গ্রহণটাই যেন নিজের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কলাপাড়া উপজেলা সদরের মোজাহার উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১০ সালে বিএ পাস করেন সিরাজুল। ২০০৫ সালে এইচএসসি করেছেন পটুয়াখালী জেলা সদরের করিম মৃধা কলেজ থেকে। আর এসএসসি করেছেন নিজের গ্রাম উত্তর লালুয়া ইউসি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে। এই প্রান্তিক জনপদে থেকে বিএ পর্যন্ত লেখাপাড়া এগিয়ে নেওয়ার কষ্ট এখনও ভুলতে পারেন না সিরাজুল। নানামুখী সংকটের ভেতর দিয়ে সময় অতিক্রম করায় গ্রামের এই যুবকের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে।

আলাপে সিরাজুলের দীর্ঘশ্বাস। ঋণের বোঝা। কাজ নেই। জমিতে ফসল হচ্ছে না। সংসার চালাতে কষ্ট। এনজিওসহ বিভিন্ন স্থানে ঋণী আছেন প্রায় ৪০ হাজার টাকা। প্রত্যেক দিন তিনবেলা খাবারের সংস্থানের সঙ্গে ঋণ পরিশোধের চিন্তাটাই তাড়িয়ে ফেরে সিরাজুলকে। পরিবারের সংকট কাটাতে চাকরির খোঁজ তো চলছেই। সৌভাগ্যক্রমে স্ত্রীর চাকরিটা জুটেছিল বলে কোনভাবে চালিয়ে নিতে পারছেন।

তবে সেই ভরসায় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন না সিরাজুল। কখনো চাষাবাদ, আবার কখনো মাছ ধরে কিছু রোজগার করে স্ত্রীর মাইনের সঙ্গে যোগ করছেন। চেষ্টা করছেন ব্যয় নির্বাহের। সিরাজুলের  নিজের এই সংসারটার বয়স ৬ বছর। ঘর আলো করে এসেছে মেয়ে তানজিলা আকতার। বয়স ৩ বছর ৪ মাস। মেয়েকে নিয়ে সিরাজুলের অনেক স্বপ্ন। দাঁড়াতে চান মাথা উঁচু করে। মানুষ করে গড়তে চান মেয়েকে।

একা সিরাজুল নন। উপকূলের গ্রামে হাজারো যুবকের স্বপ্ন ভাঙে। হতাশায় ঘুরপাক খায়। এদেশে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে যুবকদের জন্য আছে অনেক প্রকল্প। এদের আত্মনির্ভর করার উদ্যোগও কম নেই। কিন্তু সেসব প্রকল্প আর উদ্যোগ সিরাজুলদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না!      

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।