ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

স্কুল ছেড়ে কাজের সন্ধানে!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৪
স্কুল ছেড়ে কাজের সন্ধানে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লালুয়া, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: ঘরে পড়ার টেবিল রাখার জায়গা নেই। পানিতে ডুবে বইপত্র নষ্ট হয়েছে কয়েকবার।

স্কুলে যাওয়া পথে পথে নানান সমস্যা। এর ওপর দৈনন্দিন খাদ্য সংগ্রহের সংকট তো আছেই। এইসব নানামুখী সংকটের মুখে বহু স্কুলগামী ছেলেমেয়ে এখন কাজের সন্ধানে ছুটেছে। লেখাপড়া ছেড়ে সংসারের আর্থিক যোগানে নেমে পড়েছে। আবার এর ভেতর দিয়েও লেখাপড়া এগিয়ে নিচ্ছে কিছু শিক্ষার্থী।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের চারিপাড়াসহ আশাপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের অবস্থা এমনই। বছরের প্রত্যেক জোয়ারের মৌসুমে বাড়িঘর ডুবছে, বহু মানুষ হারাচ্ছে সহায়-সম্পদ। আর সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার গতি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অভিভাবক, শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মিলল নানান তথ্য।
সূত্র বলছে, লালুয়া ইউনিয়নের রামনাবাদ তীরবর্তী এই এলাকার চিত্র গত কয়েক বছরে অনেকটাই বদলে গেছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় বাড়িঘর, ফসলি মাঠ ভাসছে জোয়ারের পানিতে। রাস্তাঘাট নেই। এক দেড় কিলোমিটার পথ যেতে চার-পাঁচটি সাঁকো পার হতে হয়। অনেক চেষ্টা করেও চাষিরা জমিতে ফসল আবাদ করতে পারছেন না। দেশের অন্যসব এলাকার সঙ্গে এই এলাকার পার্থক্য অনেক।

চরিপাড়া গ্রামের শেষপ্রান্তে ছোট্ট মুদি দোকান। দুর্যোগকালে, বিপদে-আপদে এই দোকানই এলাকার মানুষের সহায়। জরুরি প্রয়োজনে চাল-ডাল-তেলের জন্য এই দোকানে ছুটে আসেন মানুষেরা। তখন দেড়-দুই কিলোমিটার দূরের বাজারে যাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই দোকানের সামনে পাতানো বেঞ্চে বসেই আলাপ কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে।
গ্রামের নানান সমস্যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শিক্ষায় সংকটের কথা। স্কুল ছেড়ে কাজে যোগ দেওয়া ছেলেমেয়েদের নামের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। গ্রামবাসী বাবুল সর্দার কৃষি কাজ করতেন। এখন বিভিন্ন কাজে যোগালি দেন। তার ছেলে জসিম চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত। সংসারের অভাব অনটনে লেখাপড়া ছেড়ে কাজে নেমেছে।

আলমাস হাওলাদার আগে কৃষিকাজ করতেন, এখন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। সংসার চালিয়ে নিতে না পারায় ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া ছেলে আরিফের লেখাপড়া বন্ধ করে কাজে নামিয়েছেন। এখন বাবার সঙ্গে মাছ ধরে। জয়নাল আবেদীনের ছেলে রাসেল ও মেয়ে সীমা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ত। বারবার পেশা বদল করে বাবা সংসার চালাতে পারছিল না বলে ওরা লেখাপড়া ছেড়ে কাজে নেমেছে। গোটা পরিবারটি এখন ঢাকায়।
আক্কেল হাওলাদারের ছেলে হাবিব নবম শ্রেণী থেকে, করম আলীর ছেলে ইসা হাওলাদার ৩য় শ্রেণী থেকে, আবুল কালামের ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে, জুলুফ হাওলাদারের ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে হানিফ হাওলাদারের ছেলে শিমুল হাওলাদার ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে লেখাপড়ার অধ্যায় শেষ করে কাজে যোগ দিয়েছে। কেউ এলাকায় আছে, আবার কেউবা কাজের সন্ধানে ছুটেছে শহরে।

ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারছে না, এমন কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে আলাপ। তারা জানালেন, অনেক আশা নিয়ে ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া তো কোনভাবেই সম্ভব নয়। খাবার যোগাড়ের চেষ্টায় এক একটি পরিবার বহু সংগ্রাম করছে। বাসস্থানের জায়গাটুকু ঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেখানে লেখাপড়ার বাড়তি খরচ যোগানো কষ্ট হয়ে যায়।
ভর দুপুরে রামনাবাদ নদীর তীর ধরে যাওয়ার সময় কিশোর রবিউলের সঙ্গে দেখা। বয়স ১২-১৩ বছর। বাবার নাম শামসুল আলম। পড়েছে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত। এরপর আর লেখাপড়া এগোয়নি। সংসারে বড় ছেলে হিসাবে বাবার পেশার সূত্র ধরে ওকে নামতে হলো নদীতে মাছ ধরতে। ডান হাতে তর্জনী উঁচু করে রবিউল ওর ছোট্ট নৌকাটি দেখিয়ে বলে ওখানেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে ওর। চারিপাড়া আর নয়াকাটা গ্রামের বেড়িবাঁধ ধরে যেতে যেতে দেখা মেলে এমন আরও অনেক কিশোরের।

গ্রামের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চারিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে ছাত্র-ছাত্রী ৩৬২জন। বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, একটি পুরানো ভবনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। স্থান সংকটের কারণে ছোট্ট কক্ষে বসতে হচ্ছে অনেকজন শিশুকে। বিদ্যালয় থেকে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপে বোঝা গেল, গত কয়েক বছরে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কমেছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা সহকারী শিক্ষক নাসরিন আকতার বলেন, বেড়িবাঁধ না থাকায় এলাকাটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় আছে। ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে আসাযাওয়ায় মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। বিদ্যালয়ের ৬জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র একজন স্থানীয়, বাকিরা যাতায়াত করেন দূর-দূরান্ত থেকে।
শিক্ষকেরা জানান, বর্ষাকালে অনেক ছেলেমেয়ে স্কুলে আসতে পারে না। জোয়ারের প্রবল স্রোতের কারণে নৌকায় করেও স্কুলে আসা সম্ভব হয় না। বর্ষার ছয় মাস গোটা এলাকা সীমাহীন সমস্যায় ডুবে থাকে। ওই সময় জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে বিদ্যালয়ের ক্লাস চালাতে হয়।

এলাকাবাসী জানান, গত কয়েক বছর ধরে এই এলাকায় যে সমস্যা বিরাজ করছে, তারই প্রভাব পড়েছে শিক্ষায়। জীবন-জীবিকা যেখানে বিঘ্নিত হচ্ছে, মানুষ যেখানে ছোটাছুটি করছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, সেখানে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়াটা তো অত্যন্ত কঠিন। সমস্যা সমাধানের জন্য শক্ত করে বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তারা।

লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান তারা বলেন, জীবন-যাপনে যেখানে এত সমস্যা, শিক্ষার ওপর তো তার প্রভাব পড়েছেই। কাজের সন্ধানে অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। তাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তাছাড়া বর্ষাকালে স্কুলে যাওয়া তো দূরের কথা, ঘরেও থাকা যায় না।

তিনি বলেন, এলাকার মানুষের মাঝে স্থিতিশীলতা ফেরাতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। আর সেজন্য সবচেয়ে জরুরি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ।       

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
 

বাংলাদেশ সময়: ০১১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।