ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

সিডরে ছিঁড়ে যাওয়া বাঁধ জোড়া লাগেনি

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৪
সিডরে ছিঁড়ে যাওয়া বাঁধ জোড়া লাগেনি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

উপকূলের সিডর বিপন্ন জনপদ ঘুরে : প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সাত বছরে বহু মানুষ কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়েছে। জমিতে ফসল না হওয়ায় অর্ধাহারে দিন কাটছে বহু মানুষের।

স্কুল ছেড়ে শিশুরা নেমেছে কাজে। সম্পদশালী পরিবারের ঠাঁই হয়েছে রাস্তার পাশের ছোট্ট ঝুঁপড়িতে। রাস্তাঘাট ভেঙে চুরমার। ফসলি মাঠ পানিতে ডুবে থাকছে বছরের পর বছর।

সিডরের পর থেকেই এই সংকটে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের রামনাবাদ নদী ঘেঁষা কয়েকটি গ্রামের। সিডরের তাণ্ডবে রামনাবাদ নদীর তীরের শক্ত বাঁধ ছিঁড়ে যাওয়ার পর আর জোড়া লাগেনি। কয়েক দফায় বাঁধ মেরামত ও পূননির্মাণের কাজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা কোন কাজেই আসেনি। বরং দিনে দিনে দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।

সরেজমিনে এলাকা ঘুরে দেখা গেল, ভাঙা বাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশের কারণে এলাকার জীবনচিত্রটাই বদলে গেছে। লালুয়া ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র বানাতী বাজার থেকে রামনাবাদের তীরে মাত্র দেড় কিলোমিটার পথে চারটি সাঁকো। রাস্তার ওপরে তৈরি কালভার্ট ভেঙে এখন খালে পরিণত হয়েছে। আর এই খাল দিয়েই জোয়ারের পানি ঢুকছে হু হু করে। বছরের ছ’মাস মানুষদের এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যেতে হয় নৌকায়।

কিন্তু এই এলাকার মানুষের দুর্ভোগ দেখতে বর্ষা পর্যন্ত অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। শুকনো মৌসুমেও প্রতিটি বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, বাড়ির উঠোনে ধ্বংসের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে আছে।

শক্ত বাঁধের বেষ্টনি না থাকায় লালুয়া ইউনিয়নের নয়াকাটা গ্রাম এখন প্রায় পুরোটাই রামনাবাদের পেটে। এই গ্রামের মাত্র তিনটি পরিবার বাঁধের পাশে আশ্রয় নিয়ে কোনমতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এদেরই একজন আবদুল করিম প্যাদা। বয়স সত্তরের কোঠায়। দাদার ৬৫ একর জমি থেকে বাবা পেয়েছিলেন ১২ একর। নিজে কিনেছিলেন আরও ৫ একর। ভালোই কেটেছিল দিন। সিডরের আঘাত আসার আগেও বেশ ভালো ছিলেন। কিন্তু সিডরের আঘাতের পর থেকেই শুরু হয় বিপর্যয়। স্ত্রী নূর জাহান বেগমকে নিয়ে এখন তার সংসার চলছে অতিকষ্টে।

আমজেদ হাওলাদার এই এলাকার সম্পদশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। চারিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। নয়াকাটা গ্রামের বাঁধের ওপরে বাসা বানিয়ে রেখেছেন। গ্রামের বাড়িতে পানি উঠলে এখানে এসে আশ্রয় নেন। কিন্তু এ বাঁধও এখান ভাঙণের কিনারে। অল্পদিনের মধ্যে হয়তো এখান থেকেও অন্যত্র সরে যেতে হবে।

রামনাবাদ পাড়ের চারিপাড়া, চৌধুরিপাড়া, নয়াকাটা, মঞ্জুপাড়া, মুন্সিপাড়া, ছোট পাঁচ নং, বড় পাঁচ নং, নিজামপুরসহ ১৩টি গ্রামের মানুষের এমন দুরাবস্থা চলে আসছে সাতটি বছর। বছরের পর বছর এরা পানিবন্দি। জমিতে ফসল হয় না। তিনবেলা ঠিকমত ভাত জোটে না। বাড়ি পানিতে ডুবে থাকায় রান্নার সুযোগ থাকে না। ঈদ-কোরবানী কিছুই করতে পারেনি। রোজার মাসে না খেয়ে সেহরি-ইফতারি করেছেন। পানির কষ্ট, যাতায়াতের কষ্টে দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়ে যায়।

বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামতের দাবিতে হাজার-হাজার নারী-পুরুষ বহুবার কলাপাড়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের সামনে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুই হয় নি।

লালুয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের অওতাধীন চারিপাড়া, বানাতী, ধঞ্জুপাড়া, চৌধুরীপাড়া ও নয়াকাটা গ্রাম। এই এলাকার মেম্বার মজিবর রহমান জানালেন, মানুষের এত দুর্ভোগ চোখে না দেখলে বোঝার কোন উপায় নেই। বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। মানুষের হাতে কাজ নেই। কিন্তু এত সংকটের পরেও এখানে আসেনি বিশেষ কোন সহায়তা। বহু আবেদন নিবেদনের পরও ফিরে তাকায়নি কর্তৃপক্ষ।  

তিনি জানান, ৬০ এর দশকে যে উচ্চতায় বেড়িবাঁধ করা হয়েছে। পরবর্তিতে যতবার মেরামত কিংবা বাঁধ পুনর্বাসনের কাজ হয়েছে কখনই মূল ডিজাইন ঠিক রাখা হয় নি। বেড়িবাঁধের ডিজাইন ঠিক না থাকায় তাদের এমন সর্বনাশ হয়ে গেছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, দুর্ভোগ লাঘবে সরকারি বরাদ্দ এলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মেরামত কিংবা পুনর্বাসনের নামে সরকারের দেয়া কোটি কোটি টাকায় কপাল খুলেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও সরকারি দলের চিহ্নিত কিছু লোকজনের। আর এরই ফল ভোগ করছে ১৩ গ্রামের মানুষ। বরাদ্দের টাকায় যথাযথভাবে কাজ হয়নি বলে কৃষি উৎপাদন ভেস্তে গেছে। ফসলি জমি অনাবাদি পড়ে থাকছে। জোয়ারের অস্বাভাবিক চাপে সব বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। অন্তত চার হাজার কৃষক পরিবার বছরের পর বছর আমন আবাদ করতে পারেনি। আউশ, বোরো কিংবা রবিশস্যের আবাদেও নামতে পারেনি তারা। কাজের খোঁজে এলাকা ছেড়েছে অন্তত ৪০টি পরিবার।

সূত্র বলছে, লালুয়ার ৪৭/৫ পোল্ডারের বিধ্বস্ত বাঁধ মেরামত কিংবা পুনর্বাসনের জন্য ২০১০-২০১২ অর্থ বছরে ১৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বরগুনার এক ঠিকাদার এ কাজটি করেন। কাজটির শুরুতেই মূল ডিজাইন মানা হয়নি।

বাঁধ পুনর্বাসনের মূল ডিজাইন ছিল টপ দুই দশমিক ৪৭ মিটার। উচ্চতা আর এল এবং ফরমেশন লেভেলে পাঁচ দশমিক ৭৯ মিটার। এছাড়া রিভার সাইটের এক ফুট উচু করলে স্লোপ হবে পাঁচফুট এবং কান্ট্রি সাইটে এক ফুট উচু করলে দুই ফুট স্লোপ দেয়ার কথা ছিল। এসবের কিছুই মানা হয়নি। উল্টো উচু বাঁধের স্লোপ কেটে খাড়া এবং টপ কেটে আরও নিচু করা হয়েছে। এ কাজটি ২০১২ সালের মে মাসে শেষ করা কথা থাকলেও বহু পরে আগাছোলা অবস্থায় শেষ হয়। স্থানীয় লোকজন বহুবার বহু অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধতন প্রকৌশলী কিংবা বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক কেউ কর্ণপাত করেনি।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, শুধুমাত্র পানি উন্নয়ন বোর্ডের কয়েক প্রকৌশলী এবং সরকারি দলের চিহ্নিত ১০-১২ প্রভাবশালী নেতার দুর্নীতির শিকার হয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে হাজার হাজার কৃষক ও জেলে পরিবার। বিপদাপন্ন এসব মানুষ তাদের দুর্দশা সিডরের সাত বছর পরেও কাটাতে পারেনি। তারা প্রধামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সবার দাবি তাদেরকে জোয়ারের তাণ্ডব থেকে রক্ষায় স্থায়ী প্রটেকশনের বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ নেয়া হোক।

লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান জানান, ৪৭/৫ নম্বর পোল্ডারের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে এখন ১৩টি গ্রামের ২৩৭৬ পরিবারের জীবন ও সম্পদ এখন চরম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়েছে। ইতোমধ্যে ৩০টি ঘরবাড়ি সম্পুর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে আরও ২১৮৫টি বাড়ি। কবে, কীভাবে এ বিপদ তারা কাটাতে পারবেন তাও জানেন না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়াস্থ নির্বাহী প্রকৌশল দফতরের তথ্যসূত্র বলছে, সিডরে ৭০ দশমিক ০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়। যার মধ্যে ২৯ কিলোমিটার সম্পুর্ণ বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্যে অধিকাংশ বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হয়েছে। লালুয়া ও নিজামপুরের মোট ছয় কিলোমিটার বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত করতে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বার বার তাগিদ দেয়া হয়েছে বলে জানালেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় কর্মকর্তারা।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময় ০০৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।