ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

মনীষীদের শ্রদ্ধা জানাতে বইমেলায় বিশেষ কর্নার

আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৪
মনীষীদের শ্রদ্ধা জানাতে বইমেলায় বিশেষ কর্নার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৪ উপলক্ষে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের শ্রদ্ধা জানাতে বাংলা একাডেমি একটি কর্নার তৈরি করেছে।

একাডেমির মূল প্রাঙ্গণে পুকুর পাড়ের পশ্চিম কোণে এ কর্নারটি তৈরি করা হয়েছে।

এ কর্নারে এমন ব্যক্তিত্বদের অংকনচিত্র (পেইন্টিং) এখানে রাখা হয়েছে, তারা আবহমান বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং অনেক সংস্কার সাধন করেছেন।

শুধু তাই নয়, তারা বাঙালি জাতির জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছেন। দিয়েছেন দিক-নির্দেশনা।

যাদের অংকনচিত্র এ কর্নারে রাখা হয়েছে, তারা হলেন- অদ্বৈত মল্লবর্মণ, আবদুর রাজ্জাক, লালন, জয়নুল আবেদিন, ও হাজী মোহাম্মদ মহসীন।

অংকনচিত্রের পাশাপাশি এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচিতি লিখে রাখা হয়েছে,পাঠক-দর্শকদের জন্য।



বইমেলায় আগত দর্শক-পাঠক ও ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দেখে যাচ্ছেন বাঙালি জাতির বরেণ্য এই মনীষীদের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বইমেলার তথ্যকেন্দ্রে কর্মরত নামে প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ও সাধারণ মানুষের কাছে তাদের পরিচিতি তুলে ধরতে এ কর্নারটি তৈরি করেছে বাংলা একাডেমি।

যাদের অংকনচিত্র (পেইন্টিং) রাখা হয়েছে, এ বছর তাদের কারো জন্মবার্ষিকী। কারো-বা মৃত্যুবার্ষিকী। পরবর্তীতে এ ভাবে অন্যান্য মনীষীদের পরিচিতিও তুলে ধরা হবে।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১)

২০১৪ সাল অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মশতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়েছে তাঁর অংকনচিত্র রেখে। তাঁর পরিচিতিতে বলা হয়েছে, অদ্বৈত মল্লবর্মণ ১৯১৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৫১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছিলেন নিম্নবর্গের অমর লেখক। ‘মোহাম্মদী নবশক্তি’, ‘দেশ, ‘বিশ্বভারতী’তে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

জীবনের প্রথম পর্বে তিনি কবিতাও লিখেছেন। তিনি ছিলেন গভীরভাবে ছিলেন সমাজ ও রাজনীতি সচেতন মানুষ।

বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের তিতাস নদী তীরবর্তী মালো সম্প্রদায়ের জীবন নিয়ে লেখা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণের স্মরণীয় একটি কীর্তি। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসকে ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্রে রূপ দিলে দেশ-বিদেশে তা বিপুল সাড়া ফেলে।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ উপন্যাস ছাড়াও গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, লোকজ সংস্কৃতি গবেষণা এবং অনুবাদ সাহিত্যেও ব্যাপৃত ছিলেন।

আবদুর রাজ্জাক  (১৯১৪-১৯৯৯)

এ বছর জ্ঞান-সাধক আবদুর রাজ্জাকেরও জন্মশতবার্ষিকী।   সে কারণে বাংলা একাডেমি তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর অংকনচিত্রও রাখা হয়েছে এই কর্নারটিতে।

এই জ্ঞান-তাপসের জন্ম ১৯১৪ সালে এবং মৃত্যু ১৯৯৯ সালে।

বিচিত্র বিষয়ক বিপুল পড়াশুনা এবং অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য কিংবদন্তি প্রতিম জ্ঞান-সাধক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন আবদুর রাজ্জাক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মহান শিক্ষক, ‘শিক্ষকদের শিক্ষক’ হিসেবে পরিণত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয় রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম উপদেশক ছিলেন।

ভাষা-জাতি-জাতীয়তা-সমাজ-রাষ্ট্র ইত্যাদি বিষয়ে সুগভীর পাণ্ডিত্যের দ্বারা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর সৃষ্টি করেছিলেন এই জ্ঞান-সাধক আবদুর রাজ্জাক।

ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল ব্যাপক। সে কারণে আইয়ুবি স্বৈরাচারী শাসনামলে তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সরকার আবদুর রাজ্জাককে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসেবে উপাধি দেয়। লিখিত রচনাকর্ম অল্প হলেও তিনি তাঁর চিন্তার গভীরতা-স্বচ্ছতা ও দূরগামিতা দিয়ে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেন। বাঙালি মুসলমানের আত্মানুসন্ধান ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে তাঁর ছিল নিজস্ব-নতুন বিশ্লেষণ।

হাজী মোহাম্মদ মহসীন (১৭৩২-১৮১২)

এ বছর হাজী মোহাম্মদ মহসীনের দ্বিশততম মৃত্যুবার্ষিকী। সে কারণে বাংলা একাডেমি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অংকনচিত্রের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে।

হাজী মোহাম্মদ মহসীন ১৭৩২ সালে জন্মগ্রহণ ও ১৮১২ সালে মারা যান।

বিশাল সম্পত্তির আয় চিরকুমার মহসীন নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যয় না করে দীন-দুঃখীর দুঃখ মোচনের জন্য ব্যয় করেছেন।

হুগলী-ঢাকা-চট্টগ্রাম-যশোর প্রভৃতি স্থানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বহু অর্থ দান করেছেন। মৃত্যুর ছয় বছর আগে ১৮০৬ সালে একটি ফাণ্ড গঠন করে ধর্ম ও জনহিতকর কাজে সমস্ত সম্পত্তি দান করেন।

মহসীন ফাণ্ডের অর্থে ‘হুগলী মহসীন কলেজ’ (১৮৩৬) ও ‘হুগলী দাতব্য চিকিৎসালয়’ (১৮৩৬) এবং হুগলীর নতুন ‘ইমামবাড়া’ (১৮৪৮) স্থাপিত হয়। মহসীন ফাণ্ডের বৃত্তির অর্থে হাজার হাজার ছাত্রের উচ্চশিক্ষা লাভের প্রসার ঘটে।

আরবি-ফারসি-উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় এবং  ইতিহাস বীজগণিতে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। অনাড়ম্বর জীবনযাপনের অধিকারী হাজী মোহম্মদ মহসীন শিয়া-সুন্নি, হিন্দু-মুসলমান সবাইকে সমান চোখে দেখতেন। তাঁর দানশীলতা মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

ফকির লালন সাঁই (১৭৭২- ১৮৯০)


ফকির লালন সাঁই বাঙালির মরমী বাউল সাধনার শেষ্ঠ প্রতিভা। তাঁর গানগুলোতে যে গভীর আধ্যাত্ম-সাধনা এবং মানব-মাহাত্ম্যের পরিচয় আছে, তা তাঁকে একজন বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক এবং বহুত্ববাদী ভাবুকতার প্রতীকে পরিণত করেছে।

তার জন্ম ১৭৭২ সালে এবং মৃত্যু ১৮৯০ সালে। এ বছর ছিল তাঁর ২৪০তম জন্মবার্ষিকী।

রাজা রামমোহন রায়ের সমসাময়িক লালন ফকির নিম্নবর্গের মানুষকে মানব শ্রেষ্ঠত্বের বাণীতে উদ্বুদ্ধ করে বিশাল বাংলার এক মানবিক নবজাগরণের ভূমিকা পালন করে গেছেন।

তাঁর সেই অমর কীর্তির জন্য তিনি বাংলাদেশের একজন আইকনে পরিণত হয়েছেন।

২০০৫-এর ২৫ নভেম্বর ইউনেস্কো বাউল গানকে ‘A masterpiece of the oral and intangible heritage of humanity’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।


জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬)

এ বছর বাঙালি জাতির আরেক মনীষীর জন্মশতবার্ষিকী। বাংলা একাডেমি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর অংকনচিত্র বইমেলাতে প্রদর্শন করছে।

বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক চিত্রকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ শিল্পগুরু জয়নুল আবেদিন।

১৯৪৮ সালে সফিউদ্দীন আহমদ, আনোয়ারুল হক, শফিক-উল-আমীন, কামরুল হাসান, খাজা শফিক আহমেদ প্রমুখের সহযোগিতায় ঢাকা সরকারি আর্ট স্কুল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৪৩-এর বাংলার দুর্ভিক্ষের অসামান্য চিত্রকর্ম অংকনের মধ্য দিয়ে গোটা ভারতবর্ষে বিপুল খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় নিয়ে বিখ্যাত ‘মনপুরা-৭০’ ছবির শিল্পী তিনি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধও তার চিত্রকর্মের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সংবিধানের প্রচ্ছদ অলঙ্করণে নেতৃত্ব দেন। সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরেরও স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি। প্রকৃতি ও মানুষ তাঁর চিত্রকর্মে সুনিপুণ ব্যঞ্জনাময়ে ভাস্বর।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।