ঢাকা: ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (ডিসিসি) দুর্নীতির তদন্তে প্রথম ধাপেই কার পার্কিংয়ের জন্য বহুতল বাণিজ্যিক ভবন (সানমুন স্টার টাওয়ার) নির্মাণ খাতেই প্রায় ৮০০ কোটি টাকা দুর্নীতির তথ্য বের হয়ে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
তদন্ত রিপোর্ট চুড়ান্ত অনুমোদন ও মামলার জন্য তা ইতিমধ্যে দুদকে জমা দিয়েছে তদন্ত দল।
সপ্তাহের শুরুতেই এ ব্যাপারে দুদক মামলার অনুমতি দিতে পারে বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
এতে সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, প্রধান প্রকৌশলী ডিসিসি (দক্ষিণ) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসানুল হক মিয়াসহ ডিসিসির উর্ধ্বতন সাত/আট জন কর্মকর্তা ফেঁসে যেতে পারেন বলেও দুদকের সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
সূত্র মতে, ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) ৩৭ দিলকুশার সানমুন স্টার টাওয়ারের কার্যাদেশ দিয়েছিল এমআর ট্রেডিংকে। ওই কার্যাদেশ ছিল নিয়ম বহির্ভূত। ফলে সরকারের প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ক্ষতি হওয়ার তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের সহকারী পরিচালক হারুনূর রশিদের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি দল সাবেক ডিসিসির বিভিন্ন অনিয়ম অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানের প্রথম ধাপেই কার পার্কিংয়ের জন্য বহুতল বাণিজ্যিক ভবন (সানমুন স্টার টাওয়ার) নির্মাণে দুর্নীতির এ চিত্র উঠে আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ডিসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়েছে।
একই সঙ্গে তিনি বলেন, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ডিসিসি এ ভবনের নির্মাণ করলে ডিসিসির ৮০০ কোটি টাকা লাভ হত।
তিনি আরও বলেন, এ নিয়মবহির্ভূত ভবন নির্মাণের কারণে ডিসিসির প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ব্যাপারে তৎকালীন মেয়র, প্রধান প্রকৌশলী, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি, এমআর ট্রেডিংয়ের স্বত্ত্বাধিকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে ডিসিসি মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা যানজট মুক্ত রাখতে কিছু পদক্ষেপ নেয়। তার মধ্যে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজিএমসি) কাছ থেকে একটি ফ্লোর এবং ৩০টি গাড়ি পার্কিং সুবিধা বিনা ভাড়ায় দেওয়ার শর্তে চুক্তি করে। চুক্তি মতে, প্রায় দুই বিঘা জমি নেয় ডিসিসি। ডিসিসির নিজস্ব অর্থায়নে ২৫ কোটি টাকা খরচ করে ওই জায়গায় ২৫ তলা মাল্টিস্টোরেজ ভবনের বেসমেন্টসহ তৃতীয় তলার কাজ সম্পন্ন করে। দুটি স্তরে তৃতীয় তলার কাজ শেষ করে। এ সময় ডিসিসি সিদ্ধান্ত নেয় ভবনের পঞ্চম তলা পর্যন্ত কার পার্কিংযের জন্য, বাকিটা ব্যবসার জন্য। ২০০৫ সালে শুরু হওয়া ভবনের বেসমেন্টসহ তৃতীয় তলার নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০০৭ সালের আগস্টে। হঠাৎ ডিসিসি সিদ্ধান্ত নেয় ডেভলপার দিয়ে এ বিল্ডিংয়ের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করবে। যার ফলে বর্তমানে চার থেকে ২৫ তলার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ১৭ তলার কাজ শেষ হয়েছে।
২০০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ডিসিসি দরপত্র আহ্বান করে। তিনটি প্রতিষ্ঠান এমআর ট্রেডিং, সাজেদা এন্টারপ্রাইজ এবং সিয়াম করপোরেশন দরপত্র দাখিল করে। দরপত্রের শর্ত ভঙ্গের কারণে প্রথমেই সাজেদা এন্টারপ্রাইজ বাতিল হয়ে যায়।
অপরদিকে, সিয়াম করপোরেশনের অফিসের ঠিকানা ভুল থাকায় তাদের দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। এমআর ট্রেডিংও এসময় দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে জমা দেয় ব্যাংক গ্যারান্টি। যদিও ডিসিসির দরপত্র অনুযায়ী বাধ্যতামুলক ব্যাংক ড্রাফট বা পে আর্ডার জমার বিধান রাখা হয়েছিল।
সূত্র আরও জানায়, ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দেওয়ায় এমআর ট্রেডিংয়ের দরপত্রটি বাতিল হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। উপরন্তু ৪ থেকে ২৫ তলা পর্যন্ত নির্মাণে ডিসিসিকে ২৫ ভাগ এবং এমআর ট্রেডিংকে ৭৫ ভাগ মালিকানার ভিত্তিতে কার্যাদেশ দেওয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে এমআর ট্রেডিং উচ্চ আদালতে যায়। আদালত বিষয়টি স্থগিত করে ৯০ দিনের মধ্যে কার্যাদেশ দেওয়ার নির্দেশ জারি করে।
পরবর্তী সময় ডিসিসি গোপনভাবে চুক্তির মাধ্যমে কার্যাদেশ দেয় এমআর ট্রেডিংকে। এমআর ট্রেডিংয়ের রিট করার পাঁচ দিনের মাথায়ই এ চুক্তি হয় বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
সূত্রটি আরও জানায়, এমআর ট্রেডিং (সেলামি) ফ্লাট বিক্রির মাধ্যমে ভবন তৈরি করছে। এভাবে ডিসিসি এ ভবনটি নির্মাণ করলে ৭৫ ভাগ শেয়ার অন্যকে দিতে হত না। এর ফলে সাত লাখ ৫৬ হাজার বর্গফুট জায়গা নির্মাণ করবে এমআর ট্রেডিং। ডিসিসি পাবে এক লাখ ৯১ হাজার ২৫০ বর্গফুট। এমআর ট্রেডিংয়ের অংশ পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার ৭৫০ বর্গফুট। যার বর্তমান মূল্য এক হাজার ১৪৭ কোটি ৫০ লাখ (প্রতি বর্গফুট ২০ হাজার) টাকা। অথচ ডিসিসি এসব জায়গা প্রতিবর্গ ফুট ১৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করলেও ৮৬০ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেত। ফলে এই অর্থ থেকে বঞ্চিত হয়েছে ডিসিসি।
দুদকের তদন্তের তালিকায় বাণিজ্যিক ভবন ছাড়াও রয়েছে নামিদামি হাসপাতালের শত শত কোটি টাকার হোল্ডিং ট্যাক্স ফাঁকি, মার্কেট নির্মাণ ও দোকান বরাদ্দের দুর্নীতি, সড়ক উন্নয়নে দুর্নীতি, শত শত গাড়ি ব্যবহারে ফুয়েল যন্ত্রাংশ ও নতুন গাড়ি পুরাতন দেখিয়ে নিলামে বিক্রি, খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয়ে দুর্নীতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি, বিলবোর্ড স্থাপনে দুর্নীতি, মশক নিধনের নামে দুর্নীতি ইত্যাদি খাতগুলো।
অনুসন্ধানে সিটি কর্পোরেশনের অন্যান্য বিষয়ে নথিপত্র ইতিমধ্যে সিটি কর্পোরেশনের কাছে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে বলে সূত্র জানায়।
উল্লেখ্য, ডিসিসির নয় বছরের দুর্নীতির তদন্তে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশীদকে প্রধান করে ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম, উপ-সহকারী পরিচালক মো: হাফিজুর রহমান, রেজাউল করিম তরফদার, এইচএম আক্তার হোসেন ও মো. মনিরুল ইসলাম।
কমিটি ১৯ ডিসেম্বর থেকে কাজ অনুসন্ধান কাজ শুরু করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৭ ঘণ্টা, জানুযারি ২০, ২০১২