ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

দীর্ঘদিন ঢাকা মেডিক্যালের এক্স-রে মেশিন অকেজো

মুরসালিন হক ও আজিজুল হাকিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১১
দীর্ঘদিন ঢাকা মেডিক্যালের এক্স-রে মেশিন অকেজো

ঢাকা : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের (এক্স-রে) প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের তিনটি এক্স-রে মেশিন প্রায় এক বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এক্স-রে করতে আসা রোগীদের পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে।



এছাড়াও অভিযোগ আছে- মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যাল ও এক্স-রে ফিল্ম দিয়ে এক্স-রে এর কাজ চালানো হচ্ছে। আবার অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরেই এই বিভাগের কার্যক্রম চলছে ঢিলেঢালা গতিতে। রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হলেও সেবার মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের লম্বা করিডোরে এক্স-রে’র ছয়টি কক্ষের মধ্যে দুটি কক্ষের সামনে এক্স-রে করতে আসা রোগীদের উপচে পড়া ভীড়। বাকীগুলো সবই বন্ধ।

এক্সরে কক্ষগুলোর ২ হতে ৭ নং পর্যন্ত ছয়টির মধ্যে তিনটি কক্ষই তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। একটি কক্ষ এক্স-রে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বরাদ্দ।

জানা যায়, ৩, ৫ এবং ৭ নং কক্ষের তিনটি মেশিন প্রায় এক বছর ধরেই অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। অবশিষ্ট দুটি কক্ষে মাত্র দুটি এক্স-রে মেশিনে কাজ চালানো হচ্ছে। ফলে প্রতিদিনই গড়ে প্রায় দেড় হাজার রোগীর এক্স-রে কাজ চালানো দায় হয়ে পড়েছে।

এক্স-রে করতে এসে দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে ভোগান্তির পাশাপাশি রোগীদের অভিযোগ, কিছু বেশি টাকা খরচ করে বাইরে থেকে এক্স-রে করলে দুই ঘণ্টার মধ্যে ফিল্মসহ এক্স-রে প্রতিবেদন দিয়ে দেওয়া হয়।

অথচ ঢামেক হাসাপাতালে টাকা দেয়ার পরও তিনদিন পার হয়ে যায়। কিন্তু ফিল্মসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়া যায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক্স-রে কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ (মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট) বাংলানিউজকে জানান, ২০১০ সালে সরকার থেকে দেওয়া এক্স-রে করার কেমিক্যাল এবং ফিল্মের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে বহু আগেই। চলতি বছরেও মেয়াদোত্তীর্ণ ওইসব কেমিক্যাল ও ফিল্ম দিয়েই এক্স-রে করানো হচ্ছে।

এছাড়াও মেয়াদোত্তীর্ণ ফিল্ম দিয়ে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক্স-রে’র কাজ করানো হচ্ছে। অন্যদিকে আরও প্রায় ছয় শতাধিক প্যাকেট ফিল্ম রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ঢামেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারী বিভাগের চিকিৎসক ডা. জাহাঙ্গীর আলম জানান, মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যাল ও ফিল্ম দিয়ে এক্স-রে করানো হলে সেখানে চিহ্নিত স্থানের পরিপূর্ণ কোনও অবয়ব আসে না। আসে শুধু একটি ঝাপসা ছবি, যার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া চিকিৎসকদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

ডা. জাহাঙ্গীর আরও জানান, একজন রোগীকে এক থেকে একাধিক এক্স-রে করার পরামর্শ দেয়া হলে প্রতি এক্স-রে’র সময় কয়েক হাজার রক্তকণিকা নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যাওয়া রক্তকণিকা পুনরায় জন্ম নিতে অনেক সময় লাগে।

তিনি আরও জানান, ঢামেক হাসপাতালের এক্স-রে বিভাগের মেয়াদোত্তীর্ণ এক্স-রে করার কারণে একই সঙ্গে রোগী, টেকনোলজিস্ট ও সংশ্লিষ্ট সকলেই শারীরিকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালের প্রাক্তন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বজলে কাদের দায়িত্বপালনকালে দরপত্রের মাধ্যমে সিমেন্স প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা তিনটি এক্স-রে মেশিন ক্রয় করেন।

বর্তমানে তিনিসহ হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট আরও ১৯ জন এইসব মেশিনসহ অন্যান্য ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত মামলার আসামি।

বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদুল হক মল্লিককে অকেজো হয়ে পড়ে থাকা এসব এক্স-রে মেশিন বিষয়ে সাবেক বিভাগীয় প্রধান কর্তৃক কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হলেও এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

টেকনোলজিস্ট আব্দুস সালাম জানান, নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা তিনটি এক্স-রে মেশিনের মধ্যে একটির শুধুমাত্র টিউব নষ্ট হয়ে গেছে, যা মেরামত করতে খরচ হবে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা। আর তিনটি মেশিন মেরামত বাবদ খরচ হতে পারে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা।

তিনি আরও জানান, এই অল্প কিছু টাকার জন্য কোটি টাকা দামের মেশিন অকেজো অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন রোগীদের সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। তেমনি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে টেকনোলজিস্টদেরও চাপের মুখে থাকতে হচ্ছে।

রেডিওলজি ও ইমাজিং বিভাগের বর্তমান বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক এমএ নোমান চৌধুরীর কাছে বিভাগের দুরাবস্থার চিত্র তুলে ধরে তা প্রতিকারের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, অল্প কিছুদিন হল তিনি বিভাগের দায়িত্ব পেয়েছেন। সবকিছু সম্পর্কে জেনে নিয়ে প্রতিটি সমস্যার সমাধান করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

বিলম্বে প্রতিবেদন দেয়ার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, পূর্ব থেকেই বিভাগে ঢিলেঢালা কাজ চলে আসছে। যারফল এখনও বহন করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিভাগের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট ও কর্মচারী সঙ্কট। এই সঙ্কট থাকার কারণেই মূলত এক্স-রে প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হয়।

তিনি আরও জানান, রেডিয়েশনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট ও কর্মচারীদের আগে বিভাগ সংশ্লিষ্ট সকল কাজের বিনিময় মূল্যের শতকরা ৪০ ভাগ ঝুঁকিভাতা হিসেবে দেওয়া হত, বর্তমানে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্টদের কাজের প্রতি এক ধরণের অনীহা চলে এসেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
 
মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যাল ও ফিল্ম  বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিভাগীয় প্রধান বলেন, এই বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। দায়িত্ব গ্রহণের পরেই এ ব্যাপারটি সম্পর্কে আমি অবগত হই। যত দ্রুত সম্ভব এসব মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যাল ও ফিল্ম বাতিলের ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছি।

অকোজো এক্স-রে মেশিন এর ব্যাপারে হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদুল হক মল্লিক বাংলানিউজকে জানান, অকোজো মেশিনগুলো মেরামতের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিমেন্স কোম্পানিকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। যতদ্রুত সম্ভব মেশিনগুলো ঠিক করে কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

মেয়াদোত্তীর্ণ কেমিক্যাল ও ফিল্ম এর ব্যাপারে তিনি বলেন, হাসপাতালের সাবেক পরিচালক প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসব জিনিস ক্রয় করার কারণে বর্তমানে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্যও চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়:  ১৭১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।