ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সড়ক বাড়লেও কমছে রেলপথ

ওবায়দুল্লাহ সনি, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১১
সড়ক বাড়লেও কমছে রেলপথ

ঢাকা: নিরাপদ,সাশ্রয়ী ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রেলপথের গুরুত্ব অপরিহার্য থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে যাতায়াত ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে সড়ককেন্দ্রিক।

অতিরিক্ত সড়ক নির্ভরতার কারণে দেশে দুর্ঘটনা, দূষণ,জ্বালানি ব্যয়, যাতায়াত খরচ ও যানজটে সময়ের অপচয়সহ বেড়েছে নানারকম সমস্যা।



স্বাধীনতার পর গত চার দশকে যোগাযোগ খাতে সড়কপথ যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, ঠিক তেমনই অবহেলিত হয়েছে রেলপথ। অথচ রেলপথের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যই এ বাংলায় সড়কপথ তৈরি করেছিলো তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে রেলওয়ের যাত্রা শুরু। মূলত ব্রিটিশরা এ অঞ্চল থেকে সস্তা পণ্য দ্রুত পরিবহনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক সুবিধা সৃষ্টি ও বিশাল ভারতকে শাসনের সুবিধার্থে একস্থান থেকে অন্যস্থানে সৈন্য নেওয়ার লক্ষ্যে রেললাইন স্থাপন করে।

তবে পরবর্তী সময়ে জনসাধারণের সুবিধার্থে রেলপথ তৈরি হয়। ১৮৮৫ সালের দিকে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সংযোগের মাধ্যমে পূর্ববাংলায় সর্বপ্রথম এককভাবে রেললাইনের আগমন ঘটে। পরে একই বছর রেললাইন সম্প্রসারিত হয় ময়মনসিংহ পর্যন্ত। এরপর ১৯৪০ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ চলে।

এ সময়ের মধ্যে বালাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট ২ হাজার ৮শ ৫৮ দশমিক ২৩ কি.মি. রেললাইন স্থাপিত হয়। এর মধ্যে সরকারি পৃষ্টপোষকতার অভাবে পরবর্তীতে অনেক পথ বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার পর পরবর্তীতে নতুন রেললাইন স্থাপন করা হয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে ২ হাজার ৮শ ৩৫ দশমিক ০৪ কি.মি. রেলপথ রয়েছে।

অথচ ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে মাত্র ৪শ ৬১ দশমিক ৮ কি.মি. পাকা সড়ক ছিলো। বর্তমানে কাঁচা-পাকা মিলে সে সড়কপথ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ৫শ ৬৫ কি.মি.। এছাড়া সড়কপথের আরেকটি অংশ হচ্ছে সেতু। বর্তমানে মোট সেতুর পরিমাণ ১ হাজার ১শ ৪১ কি.মি.।

আর এসব সড়কপথ দিয়ে প্রতিনিয়ত নিবন্ধিত যান্ত্রিক যানবাহন চলছে ১৫ লাখ ৯৬ হাজার। যার সংখ্যা ২০০৩ সালে ছিলো অর্ধেকেরও কম (৭ লাখ ৩৭ হাজার ৪শ)। এছাড়া অনিবন্ধিত যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যাতো রয়েছেই। গবেষকদের মতে বাংলাদেশের সড়কে নিবন্ধিত যানবাহনের তুলনায় অনিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা কয়েকগুন।

সড়কনির্ভর যাতায়াত ব্যবস্থায় ক্রমান্বয়ে যানবাহন বেড়েছে, যে জন্য বৃদ্ধি পেয়েছে যানজট ও যাতায়াত ব্যয়। যানজটের কারণে শুধু ঢাকাতেই বছরে ২০ হাজার কোটির টাকার মত ক্ষতি হয় বলে গবেষকরা বলেছেন।

আর এতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। অকালে নিহত হওয়ার পাশাপাশি পঙ্গুত্ব বরণ করছে অনেক মানুষ। যা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উৎপাদন ব্যাহত করছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বায়ু, শব্দ দূষণসহ নানারকম পরিবেশ দূষণ। আর এসব দূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, স্ট্রোক, বধিরতাসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দিনদিন বেড়েই চলছে।

২০০২-২০০৩ সালে সড়কপথে ২৫৯৯ জন নিহত ও ১১০৪ জন আহত হয়েছেন। ক্ষতি হয়েছে ৪৫০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে রেলপথে ২৮ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ১৪৪ জন, ক্ষতির পরিমাণ ২২৪ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০০৯-১০ সালে রেলওয়েতে দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত এবং ১৩৯ জন আহত  হয়েছেন। অপরদিকে ২০০৮ সালে দুর্ঘটনায় সড়কপথে ২৭২৩ জন মারা যান।

অন্যদিকে দারিদ্র্যের পরিবহনখ্যাত রেলওয়ের প্রতি সরকারের অনিহা দিনদিন বাড়ছেই। নতুন করে এ খাতে বিনিয়োগতো দূরের কথা, উল্টো কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে রেলওয়ের লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ ও মালবাহী ওয়াগন এবং লোকবলের সংখ্যা। ১৯৬৯-৭০ থেকে ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত লোকোমটিভ ৪৮৬টি থেকে ২৮৬টি, যাত্রী পরিবহন কোচ ১৬৪৩টি থেকে ১৫০৯টি, মালবাহী ওয়াগন ৫,০৪,৮৯৩টি থেকে ১,৬৬,০১৬টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। লোকবল ৫৮,০০০ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ২৭,৯৭১ জনে।

রেলওয়ের এত সংকোচনের পরও যাত্রী চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রতি কিলোমিটার হিসেবে ৪শ ২০ কোটি ৯০ লাখ যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭শ ৬১ কোটি ১০ লাখে।
    
২০০৭ সালের হিসাবানুযায়ী যাত্রী পরিবহনে প্রতি কিলোমিটারে রেলে খরচ পড়ে ০.৩৮ এবং বাসে ০.৮৭ পয়সা। অথচ রেলপথে ভাড়া না বাড়লেও সড়কপথে বর্তমানে যাত্রী পরিবহনে প্রতি কি.মি. এ খরচ পড়ে ১.৩৫ পয়সা। একই বছরের হিসাবানুযায়ী প্রতি টন মালামাল পরিবহনে খরচ পড়ে যথাক্রমে রেলে ১.৪৯, এবং সড়ক পথে ২.৫৮ পয়সা।

১টি মালবাহী ট্রেন ২১০টি (৫ টন) ট্রাকের সমপরিমাণ মালামাল পরিবহন করতে পারে। একই পরিমাণ ট্রাফিক ইউনিট পরিবহনে রেল ও সড়কপথের মধ্যে তুলনা করা হলে দেখা যায় ট্রেনের চেয়ে প্রাইভেটকার ৮.৩ গুণ এবং ট্রাক ৩০ গুণ পরিবেশ দূষণ করে।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে রেলে যাত্রী প্রতি ০.৯৫ থেকে ১.০৬ লিটার তেল খরচ হয়। আর বাসে যাত্রী প্রতি তেল খরচ হয় ৪ থেকে ৬.২২ লিটার।

অথচ ১৯৯০-৯১ থেকে ২০০৭-০৮ সাল পর্যন্ত সরকারের অর্থ বরাদ্দের চিত্রে দেখা যায়, রেলপথে ৩.১১ থেকে ২ শতাংশে নেমেছে। অন্যদিকে সড়কপথে ৫.১৩ থেকে উন্নীত হয়েছে ৮.৭২ শতাংশ।

বর্তমান যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়ে পড়েছে সড়ককেন্দ্রিক। এ খাতে চার থেকে আট লেনের সড়ক, সেতু, উড়াল সড়কের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে রেল ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন রেল লাইন স্থাপন, লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ ও মালবাহী ওয়াগন বৃদ্ধির উদ্যোগ করা হলেও তা আশানুরূপ নয়। অথচ এ খাতের উন্নয়ন হলে নিরাপদে ও কম খরচে অধিক পরিমাণ যাত্রী ও মালামাল বহন করা সম্ভব।

বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।