ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

মিরপুর বিআরটিএ’তে ভোগান্তির নাম আনসার

মুরসালিন হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১১
মিরপুর বিআরটিএ’তে ভোগান্তির নাম আনসার

ঢাকা : “ভাই আনসারের চাপে জীবন যায়, যায় অবস্থা। অফিসাররা ৫ মিনিটের কাম করে ১ ঘণ্টায়।

এখন তো মনে হইতাছে আনসারের চেয়ে ‘গ্যাটিস’ রাই ভাল। ওগোরে খুশী হইয়া কিছু দিলেই হইতো। কমসে কম অফিসারগোর চেয়ে বেশী কাম জানে। ”

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মিরপুর অফিসে অনুসন্ধানে গেলে সেখানে গাড়ির সংক্রান্ত  কাজ করতে আসা পিকআপ ভ্যান মালিক জিল্লুর রহমান আক্ষেপ করে এসব কথা বলছিলেন।

জানা যায়, ’’গ্যাটিস’ নামধারী ব্যক্তিরা বিআরটিএ অফিসে একটি নির্দিষ্ট রংয়ের পোশাক (হলুদ) পরিহিত সাহায্যকারি কর্মচারি হিসেবে পরিচিত। গাড়ির যে কোন্ও ধরণের কাজে ’এরা বিআরটিএ কার্যালয়ের অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে  দক্ষ’ এ কথা সকলেই স্বীকার করেন। ’’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের এক সহকারি পরিচালক বাংলানিউজকে জানান, ‘গ্যাটিস’ নামধারী ব্যক্তিরা বিআরটিএ অফিসের জন্মলগ্ন থেকেই কাজ করে আসছে। ফলে প্রায় সব ধরনের গাড়ির কাগজপত্র তাদের নখদর্পণে। এছাড়াও তারা বিআরটিএ’র কর্মকর্তাদের চেয়েও ভাল কাজ জানে। তাদের দোষ একটাই যে, তাদের কোন্ও সরকারি বৈধতা নেই। ’  

জানা যায়, গত ১১ সেপ্টেম্বর বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন এক নোটিশে এসব গ্যাটিস সহ অফিস কম্পাউন্ডের ভেতর থাকা দালালদের কার্যালয়ে প্রবেশ এবং আশেপাশে অবস্থান নিষিদ্ধ করে দেয়। এরপরই শুরু হয় বিআরটিএ অফিসের নিরাপত্তায় থাকা আনসারদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য।

পিকআপ ভ্যান মালিক জিল্লুর আরও বলেন, ‘বিআরটিএ অফিসে আগে গ্যাটিসরা থাকতো। তারা বিআরটিএ এবং যে কোন গাড়ির সব ধরনের কাজ সম্পর্কে জানতো। এইসব গ্যাটিসদের কারণে অনেক সময় দালালদের হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যেত। এইসব গ্যাটিসদের হাতে অল্পকিছু বখশিশ ধরিয়ে দিলেই তার নিজ দায়িত্বে খুশি হয়ে কাজ করে দিত। ’

জিল্লুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘গ্যাটিসদের দিয়ে কাজ করিয়ে ন্ওেয়ার কারণে বিআরটিএ অফিসের কোন্ কক্ষে কোন্ কাজ করা হয় তা আমরা অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ কখনোই খুঁজে দেখার প্রয়োজন বোধ করি নাই। এখন বিআরটিএ অফিসে আসলে এ রুম সে রুম করতে করতেই দিন শেষ হয়ে যায়, কাজ আর শেষ হয় না। ’

বিআরটিএ কর্মকর্তারা কাজে অদক্ষ একথা উল্লেখ করে তিনি জিল্লুর র্আও বলেন, আগে বিআরটিএ’তে আসলে গ্যাটিসদের মারফত কাজ করিয়ে নিলে সময় লাগতো ১৫-২০ মিনিট। আর এখন এক ঘণ্টার নিচে কোন কাজ হয় না, কখনো কখনো দুই দিনও লেগে যায়। ’

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিআরটিএ কার্যালয় থেকে দালালদের বের করে দিয়্ওে সুফল মেলেনি।   বরং এখন নতুন উপদ্রব হয়ে দেখা দিয়েছে আনসাররা। এরা এখন অবৈধ টাকার লেনদেনে অনেক বেশি জড়িয়ে যাচ্ছে।

কাভার্ড ভ্যান মালিক সাইদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, একটি শিক্ষানবিশ লাইসেন্স করতে সরকার কর্তৃক নিধারিত ফি হচ্ছে ৩শ’ টাকার কিছু বেশি। আগে গ্যাটিসদের দিয়ে কাজ করিয়ে নাস্তার জন্য ৫০ বা ১শ’ টাকা দিলে হত। এখন আনসাররা এ কাজের দায়িত্ব নিয়ে সর্বোচ্চ ১২শ’ টাকাও নিচ্ছে।

বিআরটিএ কার্যালয়ে বিভিন্ন কাজে আসা একাধিক বাস-ট্রাক মালিক ও চালকদের সাথে কথা বলে আরও জানা যায়, গাড়ির রুট পারমিট বাবদ ১৫ শতাংশ ভ্যাট সহ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা লাগলেও আনসাররা এই কাজ করার জন্য তিন থেকে চার হাজার টাকা দাবি করে বসে। আবার ফিটনেস বাবদ সর্বনি¤œ ৬শ’ ৪৫ টাকা হতে ৯শ’ ৪৫ টাকা এবং এর সাথে আয়কর ফি ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। অথচ এ কাজের জন্য আনসার সদস্যরা তিন হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করে থাকে।

এছাড়া নকল টিআইএন  বা টিন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) সার্টিফিকেট এর জন্য এক হাজার ৫শ’ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা দিলেই কাজ হয়ে যায়।

মিন্টু মিয়া নামে আরেক কাভার্ড ভ্যান মালিক বাংলানিউজকে বলেন, ‘আনসাররা এখানে আসে অল্পদিনের দায়িত্ব নিয়ে। কিছুদিন পরেই তারা বদলি হয়ে চলে যায়। বিপদে পড়ি আমরা সাধারণ মানুষ। অথচ গ্যাটিসরা থাকতে তাদের হাতে টাকা দেবার পর কোনো কারণে কাজ না হলেও অন্তত তাদের খুঁজে পাওয়া যেত। ’

আনসারদের এ ধরণের অনৈতিক অর্থ আদায় ্ও নীরব চাঁদাবাজির ব্যাপারে বিআরটিএ চেয়ারম্যান আয়ুবুর রহমান খান এবং আনসার বাহিনীর ঢাকা জেলা অ্যাডজুট্যান্ট ইশা খান রাজা বাঙ্গালির বক্তব্য জানার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করেও  তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে বক্তব্য পাওয়া গেছে আনসার বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জন দুই আনসার সদস্যের।

এ ব্যাপারে মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার বাহিনীর দুই সদস্য মো. ইউসুফ এবং আল আমিনের কাছ জানতে চাইলে তারা আনসার সদস্যদের অবৈধ কাজের সাথে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।

তারা বাংলানিউজকে বলেন, আনসার বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব সরকার কর্তৃক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত থেকে নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলার বিষয়টি নিশ্চত করা।

অভিযোগের বিষয়ে তারা বলেন, সম্প্রতি বিআরটিএ কার্যালয় থেকে গ্যাটিস এবং দালালদের বের করে দ্ওেয়ার কারণে বহিষ্কৃত ওইসব দালাল আনসার বাহিনীর সদস্যদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করছে।

এদিকে অভিযোগের বিষয়ে আনসার বাহিনীর উপ-পরিচালক মো. আহাদ খান বাংলানিউজকে জানান, আনসার বাহিনীর সদস্যদের অবৈধ কাজে জড়িত থাকা ভয়াবহ অন্যায় কাজ। এ ব্যাপারে বিভাগীয় তদন্তের ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকুরি হতে বরখাস্তও করা হয়।

তিনি আরও বলেন, যদি কেউ আনসার সদস্যদের কর্তৃক ভোগান্তির শিকার হন এবং ওই ব্যাপারটি সংশ্লিষ্ট আনসার কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক অভিযোগ করেন তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

বাংলাদেশ সময় ১৯৩০ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।