ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

জঙ্গি গ্রুপ বাড়ছে এশিয়ায়

কল্লোল কর্মকার, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১১
জঙ্গি গ্রুপ বাড়ছে এশিয়ায়

ঢাকা: খোলস পাল্টেছে এশিয়ার কথিত ইসলামপন্থিরা। সাবেকী পোশাক তো বটেই, এমনকি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে  কর্মকৌশলও পাল্টে নিয়েছে তারা।

আর এতে নাকি সাফল্যের দেখাও মিলছে। সব মিলিয়ে জঙ্গি গ্রুপ বাড়ছে এশিয়ায়।

সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে,  ইন্দোনেশিয়া ও এর আশপাশের দেশগুলোতে আধুনিক পোশাকের ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, আইনজীবী ইত্যাদি শ্রেণীপেশার মানুষ কথিত ইসলামপন্থি আন্দোলনের সদস্য হিসেবে সক্রিয় হয়ে উঠছেন।

এক জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা যখন এরকম শিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতে ভয় পাচ্ছে ঠিক তখনই শিক্ষিতদের নিয়োগ দিচ্ছে অপর জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরির। বিশ্বব্যাপী বিভ্রান্ত্রিকর এক আন্দোলন শুরু করেছে তারা।

তাদের দাবি, বিশ্বের অন্যান্য ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী সংগঠনের তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল তারা।

হিজবুত তাহরির নামের এই সংগঠনটি খুব দ্রুত বিশ্বের ৪৫টি দেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। বর্তমানে এশিয়াতে তৎপরতা বাড়িয়েছে তারা। তাদের এই নব্য প্রগতিবাদী চিন্তা ইন্দোনেশিয়া থেকে চীন পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

তাদের দাবি মূলত একটাই, সারাবিশ্বের মুসলমানকে একটি ব্লকের আওতায় এনে শরিয়াভিত্তিক শাসন পদ্ধতি চালু করা। এরা মূলত বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র, অধ্যাপক ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিচ্ছে।

এদিকে এ আন্দোলনের নেতিবাচক দিক নিয়ে এরই মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্বের অনেক বিশেষজ্ঞ, সমাজ বিজ্ঞানী ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

কথিত ইসলামপন্থিরে উদ্দেশ্য তৎপরতার সমালোচনা করে তারা বলছেন, এসব পথভ্রষ্টরা ইসলামী শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র চাইলেও মূলত গণতন্ত্রকে ভিত্তি করেই কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে। যেমনটা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে। আর ইন্দোনেশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র ভাবছে তাদের হবু মিত্র ও বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল ইসলামী দেশ।

সম্প্রতি এক পশ্চিমা সাংবাদিককে দেওয়া এক দুর্লভ সাক্ষাতকারে হিজবুত তাহরির এর ইন্দোনেশিয়া চেয়ারম্যান রোচম্যাট লাবিব বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো একটি ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে মানুষের মাঝে নিজেদের বিশ্বাযোগ্যতা তৈরি করা। আমরা সে লক্ষেই কাজ করছি। গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম ও পুঁজিবাদ থেকে মানুষদের ইসলামী আদর্শের পথে নিয়ে আসছি। ’

এ বক্তব্যের সমালোচনা করে ইসলাম বিশেষজ্ঞ জেইনো বারান বলেন, ‘হিজবুত তাহরির হলো সন্ত্রাসবাদের এক নতুন বেল্ট। এরা ইসলামী অতীত ঐতিহ্য ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে মানুষের মাঝে কাজ করে। ’

প্রসঙ্গত, হিজবুত তাহরির এর অভিধানিক অর্থ হলো ‘মুক্তির পার্টি’। এই পার্টি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ১৯৯০ সাল থেকে গোপনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের আছে ২০০৯ সালের সম্মেলন ও চলতি বছরে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলন।

এ সংগঠন অধিকাংশ দেশে নিষিদ্ধ হলেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ওএবং ইন্দোনেশিয়াতে বৈধ। যে যুক্তরাষ্ট্র নিজে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বিশ্বের অনেকগুলো দেশেই যুদ্ধ পরিচালনা করছে, সেই বিশ্বমোড়লেরই ৩৩ প্রদেশে হিজবুত তাহরির কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের হিজবুত তাহরির নেতারা।

আর এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ‘হিজবুত তাহরি সন্ত্রাসবাদের পক্ষে সমর্থন জোগায় কিন্তু তারা সরাসরি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত এমন কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। ’

যুক্তরাষ্ট্র হিজবুত তাহরিরকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণা না দিলেও নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ ২০০৬ সালেই এ সংগঠনকে ‘চরমপন্থী’ দল বলে দ্য অ্যাসেসিয়েট প্রেসকে জানায়। যুক্তরাজ্য সরকার হিজবুত তাহরিরকে নিষিদ্ধ করতে গিয়েও নিষিদ্ধ করেনি।

ডেনমার্কের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান জর্জেন বন্নিশ্চেন বলেন, ‘তারা গণতন্ত্রের নামে যে বক্তব্য দিচ্ছে তা প্রহসন মাত্র। ’

যদিও ড্যানিশ আইন মন্ত্রণালয় দু’বার দেশটির প্রধান কৌসুলির কাছে হিজবুত তাহরিরকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল। কিন্তু দুইবারেই নেতিবাচক উত্তর আসে।

এশিয়ার তাদের কার্যক্রম বাড়ানোর অংশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার পাশ্বর্বর্তী দেশ মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও চীনেও তারা ছড়িয়ে পড়েছে।

চীন তো এরই মধ্যে তাদের প্রত্যন্ত পশ্চিমাঞ্চলে উইগহুরস মুসলিমদের মধ্যে সংঘর্ষের জন্য হিজবুত তাহরিরকে দায়ী করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সিডনি জোন্স বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ায় হিজবুত তাহরির এর কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি। কয়েক হাজার মানুষ হিজবুত তাহরির হয়ে কাজ করছে সেখানে। ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ মানুষদের ওপর এই জিহাদি সংগঠনের প্রভাব খুব বেশি। ’

চীনের ফুদান ইউনির্ভাসিটির সন্ত্রাস বিরোধী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জেং জিয়াদং সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘হিজবুত তাহরির সন্ত্রাসী সংগঠনের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকর। কারণ সাধারণ মানুষের ভেতর এদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। চীনে এদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এই বিশাল সংখ্যক সমর্থকদের তারা যে কোনো কাজেই যে কোনো সময় কাজে লাগাতে পারে। ’

যদিও ইন্দোনেশিয়ার হিজবুত তাহরির এর মুখপাত্র ইসমাইল ইয়োসানতো জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা একটি শান্তিপূর্ণ ইসলামী সংগঠন। সাধারণ মানুষ তথাকথিত সন্ত্রাসীদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই আমাদের দ্বারা না। হিজবুত তাহরির সহিংসতায় বিশ্বাস করে না। আমরা সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছি এমন কোনো প্রমাণ নেই। ’

এদিকে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, হিজবুত তাহরির সদস্যরা প্রথমিকভাবে সংগঠনের সদস্য হিসেবে থাকলেও পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। বলা যায়, এভাবেই তাদেরকে তৈরি করা হয়। যাতে হিজবুত তাহরির এর ওপর সরাসরি কোনো আঘাত না আসে। ২০০১ সালে তেল আবিবের এক বারে আত্মঘাতী হামলাকারী আসিফ হানিফ এবং উমর খান শরীফের সঙ্গে হিজবুত তাহরির এর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। আসিফ ও উমর দুজনেই ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক।

এমনিক নাইন/ইলেভেনের হামলার মূল পরিকল্পনাকারী খালিদ শেখ মোহাম্মদও আগে হিজবুত তাহরির করতেন বলে এক রিপোর্টে পাওয়া যায়। খালিদ ছিলেন ইরাকে আল কায়েদার দায়িত্বে।

যেসব দেশে সরকার বিরোধী আন্দোলন হয় বা হতে পারে সেসব জায়গায় হিজবুত তাহরির মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে তাত্ত্বিক পর্যায় পর্যন্ত কাজ করে। সরকারের পতন না হওয়া বা সরকারকে টালমাটাল অবস্থায় ফেলতে প্রয়োজনবোধে এরা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জোট বেধেও কাজ করে।

১৯৫৩ সালে তাকিউদ্দিন আর-নাভানি নামে এক ফিলিস্তিনি আইনজীবী এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং দেশে দেশে মুসলিম বিরোধী অন্দোলন যাতে দানা না বাধতে পারে সেজন্যেই তৈনি হয়েছিল সংগঠনটি। সংগঠনটির কার্যক্রম শুরুর প্রাক্কালে সিরিয়া এবং মিসরে অভ্যুত্থান করার চেষ্টা করে। কিন্তু তা ব্যর্থ হয় তখন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশেই সংগঠনটি নিষিদ্ধ।

তবে ইন্দোনেশিয়াসহ আশপাশের দেশগুলোতে ফুলে ফেঁপে উঠছে এর কার্যক্রম।

ইন্দোনেশিয়ার হিজবুত তাহরির এর নারী সংস্থার প্রধান রাতু ইরমার মতে, ‘অন্যান্য ইসলামী সংগঠনগুলোতে নারীদের সদস্য করা হয় না। কিন্তু আমাদের সংগঠনে নারীদের জায়গা আছে। ’

মালয়েশিয়ার বিষয়ে সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নওযাব মোহামেদ ওসমান বলেন, ‘মালয়েশিয়ার তরুণরা প্রচলিত রাজনীতির বাইরে হিজবুত তাহরির এর দিকে ঝুঁকছে। কারণ ইসলামী নীতি-আদর্শ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে তারা মনে করছে। কিন্তু তারা ভাবতেও পারছেনা যে তারা কোন পথে এগুচ্ছে। মালয়েশিয়ায় ২০০৪ সালে হিজবুত তাহরির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় প্রায় এক হাজার সদস্য উপস্থিত ছিল।   মালয়েশিয়ার প্রতিটি অঞ্চল থেকেই সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ’

মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার বেশ কয়েকজন নেতাকে তাদের সদস্য সংখ্যা এবং অভ্যন্তরীন কর্মপ্রণালী সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তারা কৌশলে প্রশ্ন এড়িয়ে যান। এমনটি বর্তমানে তাদের শীর্ষ নেতা কে তাও তারা বলতে চাননি।

তবে আতা খলিল আবু-রাসতা এতটুকু বলেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের হয়ে কাজ করছেন।

নওয়াব আরও বলেন, ‘ছাত্রদের মাঝে তারা সবচেয়ে বেশি কাজ করে। ছাত্রদের উদ্বুদ্ধকরণ এবং ট্রেনিংয়ের জন্য তারা অনেক সময় ব্যয় করে। পাঁচ বছরের ট্রেনিংয়ের ভেতর দিয়ে তারা ছাত্রদের তাদের সংগঠনের তালিকাভুক্ত সদস্য করে থাকে। আর এই ট্রেনিংয়ে ৬০ শতাংশ ছাত্রই উতরে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।