চাঁদপুর থেকে: এরশাদ ব্যাপারীর পুরো অবয়বে প্রাকৃতজনের ছায়া। চোখে মুখে গ্রাম্যতা, সরলতা আর দৃঢ়তার সবটাই যেনো বর্তমান।
এরশাদ ব্যাপারিকে কেনা যায়নি। নগদ ২৫ লাখ টাকার প্রলোভন ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। তার চাওয়া একটাই বিচার। ১১ বছরের শিশু কন্যাটির সম্ভ্রম কেড়েছে যে ৫৫ বয়সী লম্পট শিক্ষক তার বিচার।
‘আমি কিছুই চাই না, শুধু ওর বিচার চাই। আমার মেয়েকে যে...’ গলা আটকে আসে এরশাদ ব্যাপারীর। পাশে দাঁড়িয়ে অঝরে কাঁদছিলেন তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা।
এরশাদ ব্যাপরীর শিশু কন্যা হালিমা এখন ৬ মাসের একটি সন্তানের মা। যে বয়সে নিজেই মায়ের কোলে ঘুমুনোর কথা সেই বয়সে হালিমা সামলাচ্ছে নিজের কন্যা সন্তানকে। মাদ্রাসা শিক্ষক জলিলের ধর্ষণের শিকার হয়েই মা হয়েছে হালিমা।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে কাপাইকাপ গ্রামে হালিমাদের বাড়িতে গেলে তার মা -বোন কথা বলতে রাজি হচ্ছিলেন না ভয়ে। তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে... সাংবাদিকরা আর তাদের কতদিন রক্ষা করবে এই বলে। গ্রাম্য মাতব্বর, স্থানীয় প্রশাসন কোনো কিছুই যে যে আর হালিমাদের পক্ষে নেই।
হালিমার বড় বোন বলছিলেন, ‘আর কী ব্যবস্থা নেবেন, যা হওয়ার তাতো হইয়াই গেছে। আসামিরাও খালাস পাইয়া গেছে। কয়দিন পর জলিলও ছাড়া পাইয়া যাইবো। কী হইবো আর লেইখ্যা। ’
এদিকে, গ্রামবাসীরাও আসামিদের ভয়ে মেশে না এরশাদ ব্যাপারীর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে।
এরশাদ ব্যাপারীর মুখে দৃঢ়তা। বললেন আমিতো খালি জলিলরে আসামি করছি, আর কাউরে না, হেরা (পুলিশ) সবাইরে আসামি কইরা চার্জশিট দিছে যাতে কোন শাস্তি না হয়। আমার মিথ্যার কোন প্রয়োজন নাই। যা সত্যি সেইটা প্রমানিত হইলেই হয়। ’
তিনি জানালেন, জলিলের এক আত্মীয় চাদপুরের অতিরিক্ত জেলা মেজিস্ট্রেট মো ফরিদুল ইসলাম মজুমদার। তিনি ফোনে তাকে ( হালিমার বাবাকে) ২৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে বলেছেন। বলেছেন ফাঁসি দিয়ে কী হবে, হালিমার ভবিষ্যতই বা কী হবে। তারচেয়ে আপোষ করে ফেলেন। এইটাকা দিয়ে হালিমার ভবিষ্যত হয়ে যাবে।
কিন্তু এ প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করেছেন হালিমার বাবা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো ফরিদুল ইসলাম মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, তার সঙ্গে আমার কখনোই কথা হয়নি। টাকা দিয়ে আপোষ করার কথা ঠিক না। আমি তাকে কোন ধরনের অফার করি নাই।
তাহলে আপনার কথা কেন বললো, জানতে চাইলে, কিছুই জানেন না বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ক্রিড়াজগতের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, সে অনেক ক্ষমতাশালী, সে ইচ্ছা করলেই অনেক কিছু করতে পারে এসব কথা বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে এরশাদ ব্যাপারীকে।
২০১০ সালের ৩ আগস্ট হালিমাকে ধর্ষণ করে লম্পট মাদ্রাসা শিক্ষক আবদুল জলিল। এরপর জানুয়ারির দিকে হালিমার শরীরে ফুটে উঠতে শুরু করে তার মা হওয়ার বিষয়টি।
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ১১ বছর ৩ মাস ১০ দিন বয়সের কিশোরী হালিমাকে ৫ জানুয়ারি জোর করে জলিলের সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দেয়। কিন্তু তা মেনে নেয়নি হালিমার বাবা। ১৯ জানুয়ারি চাদঁপুর জেলা জজকোর্টে জলিলকে আসামি করে নারী নির্যাতনের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন তিনি। বিষয়টি জানাজানি হলে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সংস্থা হালিমার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। সংস্থাটি ১৭ এপ্রিল হালিমাকে ঢাকায় নিয়ে যায় এবং ১৯ এপ্রিল হালিমা এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সংস্থার পক্ষ থেকে বিষয়টি বাংলাদেশ হাইকোর্টের নজরে আনলে বিচারপতি ফরিদ আহমেদ এবং বিচারপতি মো. শতকত হোসেনের বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। হাইকোর্ট হালিমা এবং তার কন্যা সন্তানকে সংস্থাটির হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
উল্লেখ্য, ধর্ষক শিক্ষক এখন চাদপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে। ধর্ষক শিক্ষকের সহযোগী হিসেবে পুলিশ লাল্টু ও কুদ্দুস নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছিলো। তারা নি¤œ আদালত থেকে এরই মধ্যে জামিন পেয়েছে। তারাই এখন বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিয়ে আসছে এরশাদ ব্যাপারীর পরিবারকে।
এছাড়া মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন আরও কয়েকজন। এরা হলেন- মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এটি এম আব্দুল হাই, মাদ্রাসার শিক্ষক কাউছার আহমেদ, আবুল খায়ের মোঃ মহিউদ্দিন, আবুল কাশেম, ইলিয়াছ বকাউল, গভর্নিং বডির সদস্য আব্দুর রব খাঁ ও মাদ্রাসার ছাত্র মোঃ মাসুদ হোসেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব ইন্সপেক্টর মো আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মামলার চার্জশিট আরও একমাস আগে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। চার্জশিটে কতো জনকে আসামী করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নয় জনকে।
হালিমার বাবা মো এরশাদ ব্যাপারী শুধুমাত্র ধর্ষক শিক্ষক জলিলকে আসামি করে মামলা করেছিলেন, তাহলে আপনি কেন নয়জনকে আসামি করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১১ বছরের এক কিশোরীকে কিভাবে তারা বিয়ে পড়িয়ে দেয় এই অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়েছে।
মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যই তিনি চার্জশিটে নয়জনকে অর্র্ন্তভুক্ত করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন হালিমার এরশাদ ব্যাপারী।
তার আরও অভিযোগ তদন্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন তার কাছে ৫ হাজার টাকা চেয়েছেন আসামিদের গ্রেপ্তার করার জন্য, বলেছেন টাকা না দিলে আসামি ধরা যাবে না।
তদন্ত কর্মকর্তাকে ১ হাজার টাকাও দিয়েছেন বলে জানান এরশাদ ব্যাপারী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, তিনি তিন দফা এরশাদ ব্যাপারীর বাড়ি গিয়েছেন এবং তার খরচ আছে।
তদন্তের প্রয়োজনে কোথাও গেলে মামলার কোনো পক্ষের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া অবৈধ এমন প্রসঙ্গে উত্তেজিত হয়ে যান আনোয়ার হোসেন। এক পর্যায়ে ফোনের লাইন কেটে দেন তিনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সংস্থার সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলানিউজকে বলেন, হালিমার বাবাকে বিষয়টি মিমাংসা করার জন্য স্থানীয় থানা থেকে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। আজ তাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো পুরো পরিবারটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তা না করে তারা উল্টোটা করছে। লাল্টু, কুদ্দুস তাদের হুমকি দিচ্ছে বলে তাদের কাছেও তথ্য আছে বলে জানান সালমা আলী।
তিনি আরও বলেন, এখানেতো লুকো ছাপার কিছু নেই। ঘটনা পরিষ্কার, জলজ্যান্ত একটা বাচ্চা পৃথিবীতে এসেছে। এর থেকে বড় প্রমান আর কী হতে পারে। এখন যদি প্রধান আসামি বের হয়ে যায় তাহলে তো এটা মানাধিকার লঙ্ঘন হবে।
সালমা আলী বলেন, আসামি পক্ষ এখন সবাইকে বোঝাতে চাইছে, হালিমার বাবা খারাপ। আমরা যদি ধরেও নেই, হালিমার বাবা খারাপ তারপরও তো এটা হতে পারে না। হালিমার বাবার খারাপ হওয়ার সঙ্গে তো হালিমার ধর্ষিত হয়ে মা হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই।
বিষয়টি নিয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শিরীন শারমীন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও জানা সালমা আলী।
তিনি বলেন, ‘আমি মন্ত্রীকে বলেছি এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে। তবে বিষয়টিতে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। ’
এ ঘটনাকে ঘিরে আলাদা একটি মনিটরিং দল গঠনেরও দাবি জানান সালমা আলী।
তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসন হালিমার পরিবারের কোন নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এবং এর সঠিক তদন্তও হয়নি। এ অবস্থায় আলাদা একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে এর সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। ’
হালিমার বাড়ি থেকে বের হয়ে স্থানীয় সেই মাদ্রাসায় গিয়ে গর্ভনিং বর্ডির কাউকে খোঁজ করেও পাওয়া যায় নি। এদিকে ঘটনার এতদিন পরে কোনো সংবাদ কর্মীকে ওই বাড়িতে যেতে দেখে স্থানীয় উৎসুকদের এরশাদ ব্যাপারীর বাড়ির সামনে ভিড় করতে দেখা যায়।
তবে এ প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাদের কেউই মুখ খুলতে রাজি হয়নি।