ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

ফোর্বস অনেক ক্ষমতার কথাই জানে না

মহসীন হাবিব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১১
ফোর্বস অনেক ক্ষমতার কথাই জানে না

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সুপরিচিত পত্রিকা ‘ফোর্বস’ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ১০০ নারীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকা অনুসারে এক নম্বর স্থান পেয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মার্কেল।

পাঠক, তাঁর নামটি কিন্তু ঠিক মার্কেল নয়। আবার মেরকেলও নয়। উচ্চারণ অনুসারে বানানটা যে কী তা আমার বলার সাধ্য নেই, ওটি ব্যাকরণের বিষয়। তবে একটা কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না, এক কথায় তাঁকে মার্কেল বা মেরকেল বললে হয়ে যাবে খঞ্জনার প্লাসের মতো। সে গল্পটা একটু বলে মূল কথায় ফিরছি।

এই খঞ্জনা একসময় আমাকে ভীষণ জ্বালিয়েছে। আমি ছড়ার খঞ্জনা চিনি। কিন্তু জার্মানির মিউনিখ শহরে গিয়ে বাঙালি ভাইদের মুখে একটি স্থানের নাম শুনতে পেলাম ‘খঞ্জনার প্লাস’। প্রায়ই আমার স্বদেশি ভাইয়েরা বলেন, এই একটু খঞ্জনার প্লাসে গিয়েছিলাম। অথবা বলেন, অমুক দোকানটা খঞ্জনার প্লাসের কাছেই। আমাকেও কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি খঞ্জনার প্লাসের ওদিক দিয়ে আসলেন? আমি পড়লাম বিপদে। জায়গাটি আমার আর চেনা হয়ে ওঠে না। শেষ পর্যন্ত ভর্ৎসনার সম্মুখীন হয়েছি, এতদিন এখানে আছেন, এখনো খঞ্জনার প্লাসটা চিনলেন না? তখনো আমি বোকার মতো হা করে তিরস্কার সহ্য করি। কী করা যাবে, যার জায়গা চেনার মুরোদ নেই, তাকে তো কিছু কথা শুনতেই হবে।

শেষে একদিন এক ভাই জেদ করে আমাকে জায়গাটা চেনাতে নিয়ে গেলেন। চার রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে বললেন, এটা কোন জায়গা! এবার চিনেছেন খঞ্জনার প্লাস? সত্যি কথা বলতে কি, আমি সারাক্ষণ ওই জায়গাটি দিয়েই যাতায়াত করি। সাইনবোর্ডে জায়গাটির নাম পরিষ্কার ভাষায় লেখা আছে, য়োয়েনসোলার্ন প্লাস (Hohenzollern platz)। একাদশ শতাব্দীর জার্মান, প্রুশিয়া এবং রোমানিয়ার ইতিহাসখ্যাত রাজপরিবারের নাম য়োয়েনসোলার্ন। আর প্লাস হচ্ছে, ইংরেজি প্লেস বা স্থান। কী করে প্রবাসী বাঙালি ভাইয়েরা জায়গাটিকে খঞ্জনার প্লাস নাম করে ফেলেছেন, তা আজও আমার কাছে রহস্য।

মূল কথায় ফিরে আসি। ফোর্বস নিজস্ব পদ্ধতিতে জরিপ করা তালিকা প্রায়ই প্রকাশ করে থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয়, বিশ্বের সবচেয়ে প্রত্যাশিত ইত্যাদি তালিকা তারা ফলাও করে প্রচার করে। ফোর্বসের এই তালিকার দিকে সবার নজর থাকে। দেশে দেশে নিউজ হয়। দুঃখের বিষয়, আমার কাছে এই তালিকাকে ওই খঞ্জনার প্লাসের মতো বিষয় বলে মনে হয়।

লক্ষণীয়, ফোর্বস দুটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছে। একটি মোস্ট পাওয়ারফুল, আরেকটি মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল। অর্থাৎ বাংলায় দাঁড়ায় সবচেয়ে ক্ষমতাবান এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী। এ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, তৃতীয় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ, চতুর্থ পেপসি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ইন্দ্রা ন্যুই। ভারতের কংগ্রেস দলের প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধীর অবস্থান সপ্তম। এ ছাড়া তালিকার প্রথম দিক দখল করে আছেন বহুজাতিক কোম্পানি, ব্যাংক এবং বিভিন্ন সংগঠনের নারীরা। রানি এলিজাবেথ ৪৯তম এবং লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফের অবস্থান ৬২তম। অথচ ফেইসবুকের সিওও সেরিল স্যান্ডবার্গ চতুর্থ এবং ইয়াহুর সিইও ক্যারল বার্ৎস ৩৭তম অবস্থানে। এখন কথা হলো, সবচেয়ে ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালীকে সংজ্ঞায়িত করার উপায় কী? ফোর্বস প্রথমে ২০০ নাম মনোনীত করে। সেখান থেকে ছয়টি ক্যাটাগরিতে এবং ক্ষমতার ভিত্তিতে নির্বাচিত করা হয়। সেগুলো হলো : billionaires, business, lifestyle (including entertainment and fashion), media, nonprofits and politics.

ক্ষমতার নানা রকমের রূপ আছে : শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অর্পিত ক্ষমতা, প্রভাবিত করার ক্ষমতা ইত্যাদি। যদি ভালো অর্থে বলি। এমনকি জনসমর্থনের পরিমাণও একটি ক্ষমতা বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

আবার খুবই সংকীর্ণ এবং নেতিবাচক অর্থে ক্ষমতার কথা বলা যেতে পারে। আমার এক সোজা কথা বলা পরিচিতজন আছেন। তিনি প্রায়ই বলেন, যদি শাসনভার পেতাম তাহলে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতাম, ব্রিটেনের নয়। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ধরনের দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে আইনের ঊর্ধ্বে, ১৪ খুন মাফ। যেদিকে রোষের দৃষ্টিতে চাইব সেদিক ভস্ম হয়ে যাবে। আর যেদিকে প্রসন্ন দৃষ্টি ফেলব, সেদিকে সম্পদের স্তূপ তৈরি হবে। আমার যে কেবিনেট থাকবে, সেখানে কারো কোনো মতামত থাকবে না বা গ্রহণ করা হবে না। যদি গুস্তাকি হয়, সে ভয়ে কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধিতা তো দূরের কথা, পরামর্শ দিতেও ভয় পাবে। কিন্তু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী রাস্তার কোনো সোশ্যালমানি খেয়ে বেঁচে থাকা কাউকে একটি চড় দিলে ওই দিনই আইন হাতে তুলে নেওয়ার অপরাধে তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে। ১০টি ব্রিটিশ পাউন্ডের অনিয়ম পাওয়া গেলে ওই দিনই চাকরি হারাতে হবে। তাহলে ক্ষমতা কার বেশি?

যা হোক, এ ধরনের ক্ষমতার কথা বাদই দিলাম। কিন্তু বুঝতে কষ্ট হচ্ছে যে ব্রিটেনের রানির চেয়ে, লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট সারলিফের চেয়ে, ভারতের কংগ্রেস দলের প্রেসিডেন্ট সোনিয়ার চেয়ে ব্যাংকার বা কোম্পানির নির্বাহীরা অধিক প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবান হন কী করে! নিঃসন্দেহে জনসমর্থনেরও একটি ক্যাটাগরি থাকা উচিত ছিল।

২.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জব্বর এক কথা বলেছেন পার্লামেন্টে। তিনি দলের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে বলেছেন, শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন না। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলা এ শত্রু কে, তা কিন্তু বোঝা গেল না। নিশ্চয়ই যারা বাংলাদেশে বোমা হামলা চালিয়েছে, যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করেছে অথবা যারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে তারা শুধু আওয়ামী লীগের নয়, দেশেরও শত্রু। কিন্তু ওই শত্রুরা তো মন্ত্রী-এমপিদের কথা বলাকে কেন্দ্র করে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না। তাহলে প্রধানমন্ত্রী শত্রু বলতে নিশ্চয়ই ইঙ্গিত করেছেন বিরোধী দলকে (আমরা সবাই বুঝি যে তিনি বিরোধী দলকেই শত্রু বলেছেন)। বিরোধী দলের সঙ্গে ব্যাপক মতপার্থক্য থাকতে পারে, এমনকি মারামারি-হাতাহাতিও হতে পারে; কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তাদের শত্রু বলার কোনো সুযোগ আছে কি? বিশেষ করে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে? এমন কথা পল্টন ময়দানে বলা যায়। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এমন কথা বললে তা হয়ে যায় আনপার্লামেন্টারি। দলের মধ্যে আত্মসমালোচনার একটি নতুন আশীর্বাদ, একটি সংস্কৃতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু হতে যাচ্ছিল। এক মন্ত্রীর ভুল আরেক মন্ত্রী, মন্ত্রীদের ভুল এমপিরা ধরিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। এটি বাংলাদেশের জন্য সত্যিই ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনত। জবাবদিহি ও দায়িত্ব পালন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হতো। প্রধানমন্ত্রী এক ধমকে তা বন্ধ করে দিলেন। একেই বলে ক্ষমতা! ফোর্বস পত্রিকার এই ক্ষমতার কথাটিও বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল।

[email protected]

বাংলাদেশ সময় ১৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।