শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) থেকে ফিরে: ‘চল সাথি চল/পাইতাল পাইতাল/একনাম্বার বাগানে পাতা তোলা কাম...’ বাৎসরিক উৎসব বা পার্বণে এমন কথার গানের সাথে চা-শ্রমিকদের নৃত্য করতে দেখা গেলেও আসলে বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো।
এ যুগেও ৪৮ টাকা হাজিরায় দিন পার করতে হয় চা শ্রমিককে।
১৮৬০ সাল থেকে বাংলাদেশে চা-চাষ শুরু হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। মূলত বাণিজ্যিক স্বার্থেই ব্র্রিটিশরা চা-চাষ শুরু করে।
বাংলাদেশের ঢালু ভূমির বৃষ্টিবহুল অঞ্চল বৃহত্তর সিলেট চা-চাষের উপযোগী হওয়ায় ব্রিটিশরা বেঁছে নেয় এ অঞ্চলকে।
অধিক মুনাফা লাভের জন্য চা-বাগানের ব্রিটিশ মালিকরা বাগানের শ্রমিক হিসেবে কাজ দেয় নিম্নবর্গের হিন্দু সম্প্রদায় যেমন কোল, মুন্ডা, কৈরি, চন্ডালসহ অবহেলিত আদিবাসীদের।
শুরুর দিকে এসব শ্রমিকদের সাপ্তাহিক কিস্তিতে বেতন দেওয়া হতো। বেতন এতো নগণ্য ছিল যে, তা দিয়ে কোনভাবে সপ্তাহ পার করা সম্ভব হতো না। যদিও সাপ্তাহিক রেশন দেওয়া হতো কিন্তু তার পরিমাণও ছিল খুবই সামান্য। ফলে অনাহারি চা-শ্রমিকদের করুণ চিত্র ফুটে উঠত। যার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে।
অন্যদিকে অমানসিক পরিশ্রমে কাতর চা-শ্রমিকদের বিনোদনের জন্য ব্রিটিশ মালিকদের পক্ষ থেকে দেওয়া হতো হাড়িয়া, ভাঙ, চুয়ানি, গাজা খাওয়ার সুযোগ। ফলে এক বর্বরপণায় আসক্ত চা-শ্রমিকরা কখনো জীবনমুখী কোন ব্যাপারে বিদ্রোহ করেনি। যার ফলে পিছিয়ে পড়া এ শ্রমিকশ্রেণীকে আজো একইভাবে অমানবিকভাবে কাজে লাগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বেশ কিছু চা-শ্রমিক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও মানবেতর জীবন থেকে স্বাধীনতা পায়নি চা-শ্রমিকরা।
শিক্ষার আলো, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, বিনোদন, পরিকল্পিত জীবনচেতনা কোন কিছুরই সুব্যবস্থা নেই চা-শ্রমিক ও তাদের পরিবারের জন্য।
চা-বিভাগ বলে খ্যাত সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি চা-বাগান। এ অঞ্চলে বসবাসকারী চা-শ্রমিকরা আজো মানবেতর জীবনযাপন করছে।
৪০ বছর বয়স সুচিত্রা হাজরার। চার ছেলে ও এক মেয়ে। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে। বড় ছেলেও বিয়ে করেছে। বাকি তিন ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার ।
কাজ করেন স্থানীয় চা-বাগানে। কিন্তু তাতে তার সংসার চলে না। একবার খেলে আরেক বার উপোস থাকতে হয়। দুঃখের শেষ নেই হাজরার। কথা বলতে বলতেই চোখে জল এসে যায় তার।
শুধু কি সূচিত্রার দুঃখ। সরেজমিনে শ্রীমঙ্গলে ঘুরে কথা হয় এমন আরো অনেকের সঙ্গে। সবিতা, শিলা, সুরমি, মিলা, রাধাসনির সঙ্গে। কথায় কথায় বেরিয়ে আসে তাদের জীবনের দুঃখ গাঁথা।
শুধু যে চা-শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন তা নয়। এসব এলাকার মানুষ স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, পানীয় জলের অভাব, শিক্ষাসহ অন্য মৌলিক নাগরিক সুবিধাগুলো ঠিক মতো পান না। এক কথায় তাদের জীবন মানবেতর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজুর রহমান টেলিফোনে বাংলানিউজকে জানান, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে চা-শ্রমিককের জন্য সরকারের বিশেষ প্রকল্প চলছে। তবে সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি জরুরি।
তিনি বলেন, চা-শ্রমিকদের জীবন বদলাতে হলে আগে তাদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেলক্ষে সরকার এ জেলার চা-বাগানগুলোতে ১৫৩টি স্কুল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতোমধ্যে এর কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। প্রায় ১০০টি স্কুলের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা সেবা গ্রহণে চা-শ্রমিকরা অনাগ্রহী উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা এ ব্যাপারে লজ্জাবোধ করে। সেবা নিতে চায় না। তবে বিষয়টি কীভাবে আরো জোরালো করা যায় সরকার সরকারের পরিকল্পনার মধ্যে তা রয়েছে।
সুচিত্রারা সারাদিন কাজ করে যে টাকা পান তা দিয়ে এক কেজি চাল কিনলে আর হাতে টাকা থাকে না। অথচ এই চা রপ্তানী করে আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।
সুচিত্রা জানায়, প্রতিদিন একজন শ্রমিক ২৩ কেজি চা পাতা তুলতে পারলে, তবে তিনি পাবেন ৪৮ টাকা। আর ৪০ কেজি পর্যন্ত তুলতে পারলে ৮০ টাকা। অর্থাৎ একজন শ্রমিক গড়ে প্রতি কেজি চা পাতার জন্য দুই টাকা পান।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন শ্রমিক সকাল থেকে সন্ধ্যা অবদি কাজ করলে গড়ে ৩০ কেজির বেশি পাতা তুলতে পারেন না। আবার বর্ষাকালে অতি বৃষ্টির কারণে তাও সম্ভব হয় না। অপরদিকে অন্য সময়ে গাছে পাতা বেশি থাকে না। ফলে তখন গড়ে ২০ কেজির বেশি পাতা তোলা সম্ভব হয় না।
সম্প্রতি সরেজমিনে একটি প্রতিষ্ঠিত চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে যেয়ে শ্রমিকদের করুণ পরিস্থির সত্যতা প্রমাণিত হয়। সেখানে যেয়ে দেখা যায়, একজন নারী শ্রমিক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে মোট ২৮ কেজি চা-পাতা তুলেছেন।
কাজ না দেয়ার ভয়ে চা-বাগান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনেকেই এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে চান না।
ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের তথ্য মতে, একজন শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শিল্পের বর্তমান অবস্থা, শ্রমিকের জীবনযাত্রা, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা হয়।
বোর্ডের একজন উর্ধŸতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চা শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হচ্ছে তা অমানবিক। কোনভাবেই এই মজুরি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ’
তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চা-শ্রমিকরা ঠিক মতো স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্পনা সেবা পান না। তাছাড়া তাদের মধ্যে বাল্য বিবাহের প্রবণতাও বেশি। অল্প বয়সে বিয়ে হচ্ছে। দেখা যায়, ৪০ বয়সোর্ধ্ব একজন নারী অশিক্ষা ও অসচেতনার জন্য অনেক বেশি সন্তান নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ চা-বোর্ড এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে একলক্ষ ১৫ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে ১৬৩ টি চা-এলাকা গড়ে ওঠেছে। যাকে কেন্দ্র করে চলছে ১১৪ টি চা-শিল্প। এসব বাগানে ঠিক কতজন শ্রমিক কাজ করছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্ট এলাকার বেশির ভাগ লোকেরই জীবিকা অর্জনের মাধ্যম হচ্ছে চা বাগানে কাজ করা। বিশেষ করে ঐ এলাকার নারীদের।
তথ্যমতে, ১৩৬ টি চা-এলাকার ৯০টিই গড়ে ওঠেছে মৌলভীবাজারে। এ জেলার মোট জমির ৪৮ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে চা উৎপাদনে। যা কিনা চা উৎপাদনে ব্যবহৃত জমির প্রায় ৫৬ শতাংশ।
শ্রীমঙ্গলের ফিনলে চা বাগানের টালি ক্লার্ক বীরবল ভৌমিক জানান, এই বাগানে পুরুষ ও মহিলা মিলে ৩৭২ জন শ্রমিক রয়েছে। বর্তমানে ভরা মওসুম। প্রতিদিন শ্রমিকদের কেউ ২৫ থেকে ৪০ কেজি পাতা তুলে আনে। তিনি জানান, প্রতি কেজি পাতা অনুযায়ী শ্রমিকদের ২ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।
পাথারিয়া চা-বাগানের ম্যানেজার মো. সিরাজউদ্দৌলা জানান, তার বাগানে ৭শ’ শ্রমিক রয়েছে। তাদের বর্তমানে দিনে ৪৮ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। আগে মজুরি ৩২ টাকা দেওয়া হতো। এখন তা বাড়ানো হয়েছে।
এভাবে চলতে থাকলে চা-শ্রমিকরাও হয়ত বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১১১ ঘণ্টা, ১৭ জুলাই, ২০১১।