ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

শব-ই-বরাত : কল্যাণের রাত্রি

সৈয়দ গোলাম মোরশেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১১
শব-ই-বরাত : কল্যাণের রাত্রি

মুসলমানদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক রাত্রি শব-ই-বরাত। মুসলমানদের বিশ্বাস, এ পবিত্র রাত্রিতে আল্লাহপাক পরবর্তী এক বছরের জন্য তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলতসহ যাবতীয় বিষয় নির্ধারণ করে থাকেন।

অর্থাৎ বলা যায়, তকদিরের বাজেট পেশ করে থাকেন। ইরান এবং বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে এ রাত্রিকে শব-ই-বরাত বলা হয়, যার অর্থ নিষ্কৃতির রাত, পাপমার্জনার রাত অথবা ভাগ্য-রজনী।

হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, ওই রাতে আল্লাহ সর্বনিম্ন আকাশে অবতরণ করেন এবং মানুষকে তাদের পাপ মার্জনার প্রার্থনার আহ্বান জানান ও তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন (তিরমিজি)। হাদিসে আরো উল্লেখ আছে, শাবান মাসে রাসুলূল্লাহ (সা.) অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি রোজা রাখতেন, রাতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতেন, সারা রাত  নফল ইবাদত করতেন এবং উম্মতদেরও অনুরূপ করার নির্দেশ দিয়েছেন (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি ইত্যাদি)। ১৪ শাবান দিবাগত রাত্রি হচ্ছে ওই মাহিমান্বিত রাত বা শব-ই-বরাত। ‘লাইলাতুল নিছফি মিন শাবান’ হাদিসের মধ্য দিয়ে এটি প্রমাণিত।

পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে যে আয়াত আছে তা হলো :‘ইন্না আঞ্জালনা হু ফী লাইলাতিল মুবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুঞ্জিরীন, ফী হা ইউফরাকু কুল্লু আমরীন হাকীম’। [সুরা দুখান :৩-৪]

অর্থাৎ, আমি এটি কল্যাণময় রজনীতে নাজিল করেছি। আমিই সতর্ককারী। এতে আমার আদেশে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মীমাংসিত হয়।

ওই আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাত’ বলে যে শব্দ আছে তা দিয়ে আল্লাহ পাক কোন রাতকে বুঝিয়েছেন তা নিয়ে মুফাচ্ছিরদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। মুফতি সফি গং মুফাচ্ছিরদের মতে, ‘লাইলাতুম মুবারাকাত’ বলতে আল্লাহ পাক শবে কদরকেই বুঝিয়েছেন। তাদের মতে শবে কদরে পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ার ব্যাপারে যেহেতু মুফাচ্ছিরদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই, সেহেতু সুরা দুখানে ‘মুবারক রজনীতে এটি নাজিল করেছি’ এ কথার দ্বারা ওই শবে কদরের রজনীকেই আল্লাহপাক ‘মুবারক রজনী’ বলে উল্লেখ করেছেন বলে তাদের ধারণা।

ইকরিমা প্রমুখ কয়েকজন মুফাচ্ছির থেকে বর্ণিত, ওই আয়াতে মুবারক রাত্রি বা বরকতের রাত বলতে শব-ই-বরাত তথা শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেই বোঝানো হয়েছে।

সম্ভবত দুটি পৃথক রাতে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে-- এ ধারণার কারণে ওই মুবারক রাত্রি নিয়ে তাদের মধ্যে এ মতপার্থক্যর সৃষ্টি হয়েছে। অথচ ওই দুই আয়াতের কোনোটাতেই আল্লাহ পাক  ‘কোরআন’ শব্দটি উল্লেখ করেননি। ‘হু’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন যার অর্থ ‘ইহা’ বা ‘এটি’ । ওই ‘ইহা’কেই তারা পবিত্র কোরআন বলে ধরে নিয়েছেন। অথচ সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছেন, ‘শাহরু রামাদ্বানাল্লাজী উনজিলা ফী কুরআনু হুদাল্লিন্নাছি’। অর্থাৎ, পবিত্র রমজান মাসে নাজিল হয় কোরআন যা মানবজাতির জন্য হেদায়ত। মুফাচ্ছিররা ধরে নিয়েছেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হবার জিনিস হচ্ছে একমাত্র কোরআন। অথচ হজরত আদম, ঈসা ও মরিয়ম (আ.)-এর ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘রুহ’ মুমিনদের কল্যাণের জন্য লৌহ (জুলফিকার) নাজিল হবার কথাও পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। হয়তো সর্বপ্রথম পবিত্র কোরআনের আয়াত পবিত্র রমজান মাসে নাজিল হতে পারে, যার সমর্থন আমরা পবিত্র কোরআনেই পাই (২:১৮৫)। কিন্তু সমস্ত কোরআন পবিত্র রমজান মাসে নাজিল হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ, তথ্য, দলিল বা ঐতিহাসিক ভিত্তি আমাদের হাতে নেই। মুফতি সফি গংদের মতে, পবিত্র কোরআন একসাথে এক দফায় প্রথম আসমানে নাজিল হয় এবং তা ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ তেইশ বছর যাবৎ রাসুলূল্লাহর (সা.) ওপর নাজিল হয়। তার এ কথাও পবিত্র কোরআন সমর্থন করে না। পবিত্র কোরআন অনুযায়ী, সৃষ্টিজগতে এমন কোনো বস্তু নেই যা ওই আমানতকে (কোরআন) ধারণ করবে একমাত্র মানুষ (মুহাম্মদ সা.) ছাড়া [৩৩:৭২]।

পবিত্র কোরআন কোথায় আছে এবং কোথা থেকে নাজিল হয় তাও পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত আছে। ‘বাল হুয়া কুরআনুম মজিদ ফী লাওহিম মাহফুজ’ [সুরা বুরুজ : ২২-২৩]। অর্থাৎ ওই পবিত্র কোরআন লাওহে মাহফুজে (সুরক্ষিত তক্তার মধ্যে) সংরক্ষিত আছে। ‘লা ইয়ামাছছুহু ইল্লাল মুতহারুন’ [সুরা ওয়াকিয়াহ: ৭৭-৭৯]। অর্থাৎ, পুত-পবিত্রগণ (নবী-রাসুলের পবিত্র আত্মা) ছাড়া কেউই এটি স্পর্শ (ধারণ) করতে পারে না। ওই লাওহে মাহফুজ থেকে তা রাসুলূল্লাহর (সা.) পবিত্র আত্মায় ক্রমান্বয়ে অবতীর্ণ হয়েছে বলেও পবিত্র কোরআন সাক্ষী দিচ্ছেন (দেখুন সুরা বাকারা : ৯৭)।

যেহেতু প্রথম আসমানসৃষ্ট বস্তু সেহেতু কোনো সৃষ্ট বস্তুর ওপর কোরআন অবতীর্ণ হলে তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যেত বলেও পবিত্র কোরআন  ঘোষণা করছেন  (দেখুন সুরা হাশর : ২১)।

পবিত্র কোরআন নাজিল হবার কারণেই শুধু নয় (আমাদের মুফতি মহোদয়দের ধারণা মতে) আরো অনেক আধ্যাত্মিক ও জাগতিক কল্যাণের কারণে, পবিত্র কোরআন  ও রাসুলুল্লাহর (সা.) হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতে এ শব-ই-বরাতের মর্যাদা ও গুরুত্ব আমাদের  কাছে অপরিসীম। বিশেষ রাত্রির বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা আল্লাহ ও রাসুল (সা.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ওই সমস্ত বিশেষ রাত্রিতে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি করে কান্নাকাটি করা, ইবাদত-বন্দেগি করা, রহমত ও মাগফিরাত কামনা করা যে উম্মতের জন্য অশেষ কল্যাণময় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যারা এসব নফল ইবাদতের মধ্যে শিরক ও বিদআতের গন্ধ খুঁজে পায় তাদের কথা আলাদা। শব-ই-বরাতে আমাদের দেশে ঘরে ঘরে হালুয়া রুটি এবং ভালো খাবারের আয়োজন করা একটি সামাজিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এটি ইসলামি সংস্কৃতি ও ইবাদতের একটি সুন্দরতম অঙ্গ। ওই দিনে ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা এবং তা গরিব-মিসকিনদের খাওয়ানো, দান-খয়রাত করা, বুজর্গ ও অলি-আল্লাহদের মাজার জিয়ারত করা, নফল ইবাদত করা, রোজা রাখা এসবই অত্যন্ত নেক আমল।

প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতালা শাবানের ১৫ রাত্রিতে কেলাব, রাবিয়া ও মোদার গোত্রের মেষের লোমসংখ্যক গুনাহগার উম্মাহকে ক্ষমা ও রহমত করেন (হজরত ফরিদুদ্দিন আক্তার রচিত তাজকিরাতুল আউলিয়া)।
আশেকে রাসুলদের (সা.) উদ্দেশ্যে একটি ঘটনা বর্ণনা করছি : আশেকে রাসুল (সা.) হজরত ওয়ায়েছ করনী (রা.) ওহোদের যুদ্ধে প্রিয় নবীজীর (সা.) একটি দন্ত মোবারক শহীদ হয়েছে শুনতে পেয়ে নিজের বত্রিশটি দাঁত ভেঙে ফেলেন। প্রিয় নবী (সা.) তা জানতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মা ফাতিমাকে (রা.) আদেশ দিলেন, ‘মা, আমার বন্ধু খুবই অসুস্থ। কোনো শক্ত খাবার সে খেতে পারে না। তাঁর জন্য তুমি কিছু নরম খাদ্য তৈরি করো’। মা ফাতিমা (রা.) নির্দেশমতো নরম রুটি ও হালুয়া তৈরি করে দিয়েছিলেন, যা প্রিয় নবী (সা.) জিব্রাইলের মাধ্যমে তাঁর মাহবুব ওয়ায়েছ করনীর (রা.) কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং সেদিন ছিল ১৫ শবান অর্থাৎ শব-ই-বরাত। সেই থেকে শব-ই-বরাতে হালুয়া-রুটি খাওয়া ও বিতরণ করা সুন্নতে পরিণত হলো। প্রিয় নবী (সা.) হজরত আলী ও হজরত ওমরের মাধ্যমে তাঁর পবিত্র খিরকাটি ওয়ায়েছ করনীর কাছে পাঠিয়েছিলেন।

আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে আশেকে রাসুল (সা.) অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন!

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

বাংলাদেশ সময় ১৮০৫, জুলাই ১৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।