ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

গৃহস্থালি বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণের মুখে দেশের পানি

সোহেল রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১১
গৃহস্থালি বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণের মুখে দেশের পানি

ঢাকা: গৃহস্থালি বর্জ্যে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে দেশের পানিসম্পদ। সঠিক গুণ ও যথাযথ বৈশিষ্ট্য হারিয়ে দিন দিন পরিবেশ দূষণকারী ও পানের অযোগ্য হয়ে উঠছে পানি।

পরিশোধন-পরিচর্যা, অজ্ঞতা ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাবে বাড়ছে দূষিত পানির পরিমাণ, যা বিরূপ প্রভাব ফেলছে দেশের সামগ্রিক পরিবেশের ওপর।

মানুষের নিত্যদিনের গৃহস্থালি বর্জ্যে সৃষ্ট পানির এই দূষণ রোধ করা না গেলে শিগগিরই ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা এনভায়রনমেন্ট প্রোগামের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান এ দূষণ রোধে ব্যবস্থা না নিলে আগামী বিশ বছরে দেশের প্রায় ৫ হাজার ১১০ কোটি ডলার আর্থিক ক্ষতি হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাসা-বাড়িতে মানুষের মল-মূত্র, গোসল, কাপড় ধোয়া, খাওয়া-দাওয়া ও রান্না-বান্নার পানি, গার্মেন্টস, বহুতল মার্কেট, হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে মানবসৃষ্ট বর্জ্য রাখার সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই। সাময়িকভাবে কেউ কেউ তা ছোটাখাটো কোনো সেফটি ট্যাংকে রাখার ব্যবস্থ্য করলেও এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। অধিকাংশরাই কোনো সেফটি ট্যাংক ব্যবহার না করে সরাসরি ওয়াসার ড্রেন, লেক-খাল ও নদীতে এ বর্জ্য ফেলছে। অনেকে আবার বাড়ির পাশের নিম্নস্থানে রাখছে, যা পরে বৃষ্টির পানিতে খাল বা ড্রেনের মধ্য দিয়ে পাশ্ববর্তী কোনো নদীর পানির সঙ্গে গিয়ে মিশছে। বৈজ্ঞানিকভাবে এই বর্জ্য পানি নদীতে ছাড়ার আগে রাসায়নিক পদ্ধতিতে পরিশোধন বা ট্রিটমেন্ট করার কথা থাকলেও তা মানছে না কেউই।

গৃহস্থালি বর্জ্যরে ফলে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পানি ও পরিবেশ। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।

রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গৃহস্থালি বর্জ্যরে মধ্যে বিষাক্ত নাইট্রেট, ফসফেট, কলিফর্ম ও বিওডি থাকে। যা খুবই ক্ষতিকর। নদী ও খালের পানিতে বর্জ্য ফেলার আগে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ট্রিটমেন্ট করতে হয়। উন্নত বিশ্বে এজন্য রয়েছে সোয়েজ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো ট্রিটমেন্ট হচ্ছে না।

দেশে গৃহস্থালি বর্জ্য পানি পরিশোধনের জন্য ঢাকা ওয়াসার অধীনে এক লাখ ২০ হাজার মিটার কিউব ধারনক্ষমতা সম্পন্ন মাত্র একটি সোয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট রয়েছে। ওয়াসা প্রতিদিন গড়ে ১৬০ থেকে ১৭০ কোটি লিটার পানি ঢাকায় সরবরাহ করছে। যার ৭০ ভাগই বর্জ্য হয়ে বেরিয়ে আসছে। ওয়াসার বর্জ্য পানি ট্রান্সমিশন লাইনের স্বল্পতা, ত্রুটি ও অন্যান্য কারণে একটিমাত্র ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট শহরের মাত্র শতকরা ২০ ভাগ বর্জ্য পানি পরিশোধন করছে বলে জানা যায়।

গৃহস্থালি বর্জ্যের পরিশোধনের ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বারবার চিঠি দেওয়া হলেও তার কোনো ফল হয়নি বলে জানা যায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. সোহরাব আলী বলেন, ‘আমরা এজন্য সংশ্লিষ্টদের নোটিশ ও চিঠি দিয়েছি। এরপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ’

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বাংলানিউজকে জানান, বিভিন্ন বাসা-বাড়ি থেকে এ বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকে সেফটি ট্যাংক ব্যবহার করছে আবার অনেকে করছে না। গৃহস্থালি বর্জ্যের ফলে পানি ও পরিবেশ দূষণের কথা তিনি স্বীকার করে বলেন, ‘আমারা বর্জ্য পানি পরিশোধনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়েছি। এটি বাস্তাবায়ন হলে সমস্যার সমাধান হবে। ’

তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষই বর্জ্য পানি পরিশোধন ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কিছুই জানে না। খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার্য পানি সর্ম্পকে সচেতন থাকলেও বর্জ্য পানির বিষয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই। পায়খানা-প্রস্রাবসহ বিভিন্ন বর্জ্য পানি কোনোভাবে ঘর থেকে বের করে দিতে পারলেই যেন তাদের কাজ শেষ। এ বিষয়ে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর ওপরও তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরিবেশের অধ্যাপক ড. এম আশরাফ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারকে পানি সরবরাহ প্রকল্প নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য পানি পরিশোধনের প্রকল্পও হাতে নিতে হবে। এর পাশাপাশি দরকার মানুষের মাঝে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো। সরকারকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্লান্ট স্থাপন করতে হবে। তা না হলে অল্প সময়ের মধ্যে পানি দূষিত হলে আর কোনো উপায় থাকবে না। ’

একই অভিমত ব্যক্ত করে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্ল্যাড ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক মো. মুনসুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এমনিতেই আমাদের পানি কম। শতকরা ৯০ ভাগ পানি আসে দেশের বাইরে থেকে। অথচ এর ওপরে আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। ক্রমবর্ধমান এ দূষণ রোধ করা না হলে ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়তে হবে আমাদের। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।