ঢাকা: কারওয়ানবাজার কাচাঁবাজারে ১৩ বছরের সুমন মাথয় বড় ঝুড়ি নিয়ে বাজার বহন করে। এখানে অনেক কাচাঁমাল ব্যবসায়ী ওকে মিনতিনসুমন নামে চেনে।
শুধু সুমন নয় ওর মতো অনেক শিশু ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে মিনতি হিসেবে কাজ করে। রাজধানী ঢাকার কাওরানবাজার, মোহাম্মদপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ, সূত্রাপুর, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, মগবাজার, হাতিরপুলসহ বিভিন্ন স্থানে মার্কেটগুলোতে মিনতির কাজে অনেক শিশু রয়েছে ।
সুমন জানায়, ঢাকায় তার মা ফার্মগেট ওভারব্রিজে ভিক্ষা করে। বাবা নেই। তারা দুইভাই ১ বছরের ছোটভাই সুজনও মিনতির কাজ করে। গ্রামের বাড়ি কোন জেলায় সে জানে না। সে তার মায়ের কাছে শুনেছে ঢাকায় তাদের জন্ম, বাবা রিক্সা চালাতো পালিয়ে অন্যখানে বিয়ে করেছে। তার বাবাকে সে কখনো দেখেনি।
সুমন বললো, খরচাপাতি দিয়া আহি খুশি হইয়া স্যাররা ১০- ৫০ ট্যাকাও দেয়। প্রতিদিন প্রায় শ খানেক ট্যাকা পাই্ মাঝে মধ্যে কমও হয়।
কিন্ত সুমনের মতো মিনতি শিশুরা কোন অক্ষর জ্ঞান নেই, কোনদিন স্কুলেও যায়নি, সে নিয়ে স্বপ্নও নেই।
সংসারের অভাব অনটনের কারণে হাজার হাজার ছেলে মেয়ে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এসব কর্মজীবী শিশুর বেশির ভাগই চরম দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে বড় হয় এবং বেঁচে থাকে। তারা উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ ও দক্ষতা উন্নয়নের কোনো সুযোগ পায় না।
অভাব-অনটনের সংসারে একটি শিশুকে উপার্জনের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়। জীবনের শুরুতেই উপার্জনমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ শিশুদের শিশুত্বকে নষ্ট করে দেয়। একটি কোমলমতি শিশুর জীবনের সকল স্বপ্ন-কল্পনার সেখানেই অপমৃত্যু ঘটে।
যে কোন দেশে ও যে কোন সমাজে শিশুরা অধিক আদরণীয়। তারা নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ, দুনিয়ার তাবৎ পবিত্রতা ও সৌন্দর্য তাদের সঙ্গে জড়িত। কিন্ত ঢাকার শ্রমজীবি শিশুরা পরিচিত হয় টোকাই কিংবা মিনতি নামে।
নগরীর দরিদ্র অধিকাংশ মানুষ অভাব অনাটনের কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তনদের লেখা পড়া করাতে পারছেনা। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের আদরের সন্তানকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই শিশুরা বিভিন্ন ওয়ার্কশপে, ওয়েল্ডিং মেশিন , কুলির কাজসহ ও বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে রৌদ্র, ঝড়, বৃষ্টি, শীত উপেক্ষা করে শিশু শ্রমিকরা কাজ করে যাচ্ছে মুধু বেঁচে থাকার জন্য।
শিশু অধিকার
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী যেকোন মানব সন্তানকেই শিশু বলা হয়েছে । বাংলাদেশের জাতীয় শিশু নীতি ১৪ বছরের নীচে যে কোন বালক-বালিকাকে শিশু বলছে ।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী -
অপরাধের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার, অবসর ও বিনোদন ,উন্নত জীবন মান, গ্রেফতার ও দন্ড থেকে বিশেষ সুরক্ষা, চিকিৎসা পরিচর্যা, জন্ম নিবন্ধন ও আইনসম্মত পরিচিতি, দত্তক গ্রহণ ও প্রদান,পারিবারিক সংহতি, পিতামাতার সাথে বসবাস, পাচার থেকে সুরক্ষা, প্রতিবন্ধী শিশু,পুনরুজ্জীবন ও পুনসংহতকরণ, পরিবার বঞ্চিত শিশুর ক্ষেত্রে সঠিক যতœ, বেঁচে থাকা, বিকাশ লাভ, মর্যাদা ও সুনাম, মত, ভাব চিন্তা, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, মেলা মেশার স্বাধীনতা, মানবিক আচরণ, মাদকের অপব্যবহার থেকে রক্ষা, যৌন অনাচার থেকে রক্ষা, শিক্ষা লাভ, শারীরিক ও মানসিক উন্নয়ন, শরনার্থী শিশু, শোষন থেকে রক্ষা, সঠিক লালন পালন, সশস্ত্র সংঘাত থেকে সুরক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি । বাংলাদেশ এই সনদে প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের অন্যতম হলেও এসব মিনতি শ্রমিকরা তার সুফল পায়নি।
১৯২৪ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত লীগ অব ন্যাশনের কনভেনশনে ঘোষণা করা হয়, ‘মানবজাতির সর্বোত্তম যা কিছু দেয়ার আছে, শিশুরাই তা পাওয়ার যোগ্য’।
ইউনিসেফ ২০১০ সারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিশুদের কাজে লাগানোর কারণ তাদের সহজেই শোষণ করা যায়৷ দারিদ্র হল একমাত্র কারণ যার ফলে শিশুরা তাদের বয়সের তুলনায় অনুপযুক্ত কাজ করতে বাধ্য হয়৷
বিশেষজ্ঞদের অভিমত
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শিরিন শারমিন চৌধুরী বলেন, আজকের শিশু আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। সেজন্য প্রতিটি শিশুকে সুন্দর পরিবেশে ও সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে ও শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির গ্রহণ করেছে।
শ্রমিক শিশুদের জন্য সরকার আগামী বাজেটে বিশেষ ব্যবস্থা নেবে বলে তিনি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, মিনতি শ্রমিক শিশুরাও আমাদের সন্তান। শিশুর অধিকার সম্বলিত উপযুক্ত ও প্রয়াজনীয় আইন প্রয়ন এবং তার সফল বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, দেশে প্রায় ২.২ কোটি শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত । সমাজের উন্নয়নের মূরধারা থেকে ছিটকে পড়া এসব শিশুর প্রতি দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।
ঢাকা শহরের অধিকার বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন ফর চাইল্ড ওয়েলফেয়ারের মহাসচিব আজাদ কবির বলেন, ঢাকা শহরেরর শ্রমজীবি শিশুদের নিয়ে সরকারিভাবে সঠিক কোন জরিপ নেই । আমরা এদের ব্যপারে জরিপ শুরু করেছি । দীনহীনভাবে বসবাস করা শিশুরা দু’বেলা দু’মুঠো অন্নই যেখানে ঠিকমতো তাদের জোটে না। সেখানে অন্যান্য চাহিদার কথা তো সুদূর পরাহত। তবে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে এদের পূর্নবাসন করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ সময় ১২১৮ ঘন্টা, মে ০১, ২০১১