ঢাকা: ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী সমর্থিত প্রলম্বিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনীতিতে প্রবেশ করার ইচ্ছা পোষণ করার আগেই নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং পরিণতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এবং ‘প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা’ রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর এই হঠাৎ-প্রবেশকে কিছুতেই সহজভাবে মেনে নেবেন না।
শুক্রবার ভারতের খ্যাতনামা ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’র অনলাইন সংস্করণে ব্যতিক্রমী গণমাধ্যম উইকিলিকসের বরাত দিয়ে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনে নোবেল বিজয়ীর এই আশঙ্কার কথা প্রকাশ করা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন কলকাতায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল অঁরি জারদাঁর (Henry Jardine) কাছে।
২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে ওয়াশিংটনকে পাঠানো অঁরি জারদাঁর গোপন কূটনৈতিক বার্তা থেকে দ্য হিন্দুর জন্য প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন এ শ্রীবাথসান।
ড. ইউনূস সেসময় কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ্রগ্রহণের উদ্দেশ্যে কলকাতা সফর করছিলেন। কলকাতা চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত এক মধ্যাহ্নভোজে জারদাঁ এবং ইউনূস বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করেন। আলাপের সূত্রপাত হয় যখন জারদাঁ ইউনূসের রাজনৈতিক পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চান।
ওই সময় ড. ইউনূস রাজনীতিতে তার অংশগ্রহণের বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহের কথা জানান।
কলকাতা চেম্বারের সভাপতি মনোজ মোহংকা এসময় তাদের আলোচনায় ঢুকে পড়েন। রাজনীতিতে প্রবেশে ড. ইউনূসের আগ্রহ দেখে তিনি তাকে বাংলাদেশের সেসময়কার অস্থির ও ঘোলাটে রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলে ধরে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যে, রাজনীতিতে প্রবেশের মাধ্যমে ড. ইউনূস নিজের সুনামই ক্ষুন্ন করবেন।
মনোজের এই প্রতিক্রিয়ায় নোবেল বিজয়ী বলেন, এর বিপদ সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতন। তবে তার ধারণা ‘কুশাসন এবং দুর্নীতিজর্জরিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থেই পরিবর্তন আনতে হলে দায়িত্ববান ব্যক্তিদেরই এগিয়ে আসতে হবে। ’
অঁরি জারদাঁ আলোচনার এই পর্যায়ে ড. ইউনূসের কাছে বাংলাদেশে মৌলবাদের বাড়-বাড়ন্ত অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জানতে চান। জবাবে ড. ইউনূস তাকে বলেন, বাংলাদেশের ‘মুসলিম মৌলবাদীর সংখ্যা হাতেগোনা। দেশের মূলধারায় এদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। ’
মার্কিন কনসাল জেনারেল ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার লালনকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে খেলাফত মজলিশের সম্পাদিত একটি চুক্তির বিষয়ে ড. ইউনূসের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই চুক্তির মূল বিষয় ছিলো ফতোয়াকে স্বীকৃতি দেয়া এবং শরীয়াহ বিরোধী আইন প্রণয়ন নিষিদ্ধ করা।
ড. ইউনূস এই চুক্তির সমালোচনা করে বলেন, ‘এই চুক্তি হচ্ছে আওয়ামী লীগের নৈতিক দেউলিয়াত্বেরই প্রতিফলন এবং শুধু বাড়তি কিছু ভোট পাওয়ার জন্য স্রেফ রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ থেকেই এই চুক্তি করা হয়েছে। বাংলাদেশে যে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে, এই চুক্তিটি তারই আরেক প্রমাণ। ’
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়টিকে ড. ইউনূস ইতিবাচকভাবে দেখেন বলেও ওই বৈঠকে জানান। তবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি প্রায়ই বিভেদের ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগারে মেতে ওঠেন। ’
এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশি পণ্যে প্রবেশে ভারত সরকারের নেতিবাচক ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, ‘বিশেষ করে বেশ কিছু অশুল্ক বাধার কারণে ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশ কঠিন নিয়ন্ত্রণের মুখে পড়ে। ’
উইকিলিকসকে উদ্ধৃত করে দ্য হিন্দু জানায়, আঞ্চলিক বাণিজ্যের সুবিধার্থে চট্টগ্রাম বন্দরকে ভারত, মিয়ানমার, ভুটান এবং চীনের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনার ছিল ড. ইউনূসের। এছাড়া গ্রামীণব্যাংকের বিনিয়োগে চট্টগ্রামে বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী নতুন একটি বন্দর নির্মাণে প্রকল্প হাতে নেওয়ার ইচ্ছাও তাঁর ছিল।
ড. ইউনূসকে ‘উচ্চ নৈতিকতা ও শক্তিশালী সাংগঠনিক ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করে মার্কিন গোপন কূটনৈতিক বার্তাটি শেষ করা হয়। বার্তায় জারদাঁ বলেন, ‘রাজনীতিতে তাঁর (ইউনূস) প্রার্থিতা হাসিনা-খালেদার নেতিবাচক রাজনীতির অচলায়তন থেকে মুক্তির একটা সম্ভাব্য উপায় হতে পারে। এ দুই নেত্রীর নেতিবাচক রাজনীতির কারণে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে বার্তায় উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘন্টা, ২২ এপ্রিল, ২০১১