ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

হালদায় যান না আর প্রান্তিক জেলেরা

রমেন দাশগুপ্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১১
হালদায় যান না আর প্রান্তিক জেলেরা

চট্টগ্রাম: হালদা নদীর জোয়ার-ভাটার সঙ্গে অন্তত ৬০ বছরের মিতালী রাউজানের জামিরহাট জেলেপাড়ায় তেজেন্দ্র লাল জলদাসের (৮৪)। উত্তাল জোয়ার আর স্রোতের টান দেখে শংকিত স্ত্রীর মন একসময় যাকে ঘরে বেঁধে রাখতে পারেনি, সেই তেজেন্দ্র বা তার বংশধরদের এখন কেউ হালদায় যান না, যেতে পারেন না।


    
নদীতে যান না কেন- বুধবার দুপুরে বাংলানিউজের এমন এক প্রশ্নের জবাবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তেজেন্দ্র বলেন, ‘নৌকা, জাল, রশি, নোঙ্গর কিছু নাই। আমরা মাছ ধরেছি কিন্তু কোনদিন মা’র (মা মাছ) গায়ে হাত দিইনি। এখন শুনছি মারেও ধরে খেয়ে ফেলা হচ্ছে। তাই মাও আর আসে না, আমরাও নদীতে যাই না। ’

তেজেন্দ্রর মতো হালদায় যান না বা যেতে পারেন না একই জেলেপাড়ার নিতাই, রাখাল, বিনয়, ধীরেন, টুনটু; আজিমঘাটের চাঁদু জলদাস আর গড়দুয়ারার সুধীর জলদাসও। সবার এক কথা, ‘নদী আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। এখন দূর নদীতে গিয়ে মাছ ধরে পোষায় না। বড় বড় মুসলমান-হিন্দু বাবুরাই এখন নদীতে মাছ ধরে। ’

মৌসুমী জেলেদের দাপটে অসহায় হয়ে হালদা নদী থেকে এখন অনেকটাই বিতাড়িত প্রান্তিক জেলেরা। হালদাপাড়ের এই জেলেদের কেউ এখন দিনমজুর, কেউ মহাজনের অধীনে পুকুরে জাল ফেলেন আর কারো কারো পরিণতি ভিক্ষাবৃত্তি।

প্রান্তিক জেলেদের মতে, আর্থিক অনটন, নদীভরাট, শাখা খাল খনন, ইঞ্জিন নৌকা আর বালি উত্তোলনের ফলে প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন আর হালদায় আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। এর উপর আছে হ্যাচারি মালিকদের দাপট।

সরেজমিনে হালদাপাড়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হালদার ভাঙন থেকে রাউজানের গহিরাকে বাঁচাতে ১৯৮৬ সালে গড়দুয়ারা পয়েন্টে প্রায় আড়াই কিলোমিটার লম্বা শাখা খাল খনন করা হয়। এর ফলে উজানে পানিপ্রবাহের গতিপথ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হালদার সোনাইমুখসহ বিভিন্ন পয়েন্টে (যেখানে মা মাছ এসে ডিম ছাড়ত) চর পড়ে গেছে। ভরাট হয়ে গেছে রাউজান ও হাটহাজারী পয়েন্টে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার নদীপথ। এছাড়া হালদায়ও আর আগের মতো পানিপ্রবাহ নেই।

গড়দুয়ারার মৎস্যচাষি ও মুক্তিযোদ্ধা মো. সেকান্দার বাংলানিউজকে বলেন, ‘খাল কাটার সময় আমরা অনেক বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু সে সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি গহিরায় তার বাড়ি বাঁচাতে সন্ত্রাসী এনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাল খনন করেছেন। ’

রাউজানের জামিরহাট জেলেপাড়ার টুনটু জলদাস বাংলানিউজকে বলেন, ‘আগে দাওয়ায় বসলে নদী দেখতাম। সোনাইমুখে মা (মা মাছ) এসে ডিম দিত। এখন দেড় মাইল হেঁটে নদীতে যেতে হয়। হ্যাচারির আশপাশে জাল ফেললে মালিকরা ধমক দেয়। ’

ঘরের সামনে সাংবাদিক (তাদের ভাষায় ছংবাদিক) দেখে দৌড়ে আসেন কৃষ্ণা জলদাস। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আমাদের কপাল খারাপ। না হলে রেণু ধরার এ সময়ে কি আর পুরুষমানুষ ঘরে বসে থাকে। ’

ঘরের দাওয়ায় বসে বিড়ি ফুঁকছিলেন তার স্বামী নির্মল জলদাস। অভাব-অনটনে নির্মলের মা সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ টকী জলদাস এখন ভিক্ষা করেন। বাংলানিউজকে টকী জলদাস বলেন, ‘সরকার ত আঁরার ন, সরকার বর মাইনষ্যর। নইলে ইতারা আঁরারে দইরয্যাত যাইত্যু ক্যা ন দ্যে। কাঁচা কদু আর কদিন খাইতাম মনে কহ ওবা। ’ (সরকার আমাদের নয়, সরকার বড়মানুষের, নইলে কাঁচা মিষ্টিকুমড়া আর কতদিন খেতে ইচ্ছে করে। )

স্থানীয় প্রবীণ মৎস্যচাষী সোলায়মান সরকার বাংলানিউজকে বলেন, ‘হাটহাজারী-রাজউানের কমপক্ষে একশ জায়গা থেকে বালি তোলা হচ্ছে। ইঞ্জিন বোট চালিয়ে বালি নেওয়া হচ্ছে। আবার অনেকে ইঞ্জিন বোট চালিয়ে মাছ শিকার করছে। এতে মাছের ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেছে। ’

হালদা নদীতে ২৮ বছর ধরে চালানো দাঁড়িনৌকার মাঝি কামাল সর্দার বাংলানিউজকে বলেন, ‘ডিম ছাড়ার জন্য প্রত্যেক মা মাছের সঙ্গে একটা করে পুরুষ মাছও আসে। ডিম ছেড়ে দিয়ে মা মাছ যখন অজ্ঞান হয়ে যায় পুরুষ মাছ তখন তাকে টেনে নিয়ে যায়। এসময় মা মাছের মন দুর্বল থাকে। তাই ইঞ্জিনের শব্দে তারা ভয় পেলে পরে আর হালদায় আসে না। ’

সোলায়মান সরকার বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে হালদায় লাখখানেক জেলে ডিম ধরত। এখন দুই থেকে আড়াই হাজার চাষি ডিম সংগ্রহ করে। এর মধ্যে জেলে নেই বললেই চলে। ’

গত দু বছর ধরে সরকার ডিম ছাড়ার মৌসুম শুরুর আগে স্থানীয় জেলেদের বিনা সুদে ঋণ দিচ্ছে। এ বছরও রাউজানে ৮০০ এবং হাটহাজারীতে ৬০০ জনকে ঋণ দেয়া হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, মৎস্যচাষি সেজে ঋণের প্রায় পুরো টাকাটাই হাতিয়ে নিয়েছেন স্থানীয় হ্যাচারি মালিক আর টাউট-বাটপাররা।

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে প্রতি বছর গ্রীষ্মের শেষ দিকে বা বর্ষার শুরুতে ডিম ছাড়ে মিঠা পানির মা মাছ। এসব মা মাছের মধ্যে আছে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ এবং বোয়াল।

বাংলাদেশ সময় ২১০৫, এপ্রিল ২১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।