চট্টগ্রাম: ‘চট্টগ্রামের সিইউএফএল জেটিঘাটে দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের পর জানতে পেরেছিলাম- অস্ত্রগুলো ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য নেওয়া হচ্ছে। অস্ত্র সরবরাহের সঙ্গে ডিজিএফআই’র তৎকালীন পরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার ও এনএসআই কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়েও নিশ্চিত হয়েছিলাম।
চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে এ বক্তব্য দিয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমি।
এসময় তিনি আরও বলেন, ‘উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে রেজ্জাকুল হায়দারের সম্পর্কের বিষয়টি আমি জানতাম। বিষয়টি আমি স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকেও জানিয়েছিলাম। কিন্তু এরপরও তিনি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশের কথা বলে রেজ্জাকুলকে তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য চাপ দেন। ’
নয় পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে সাবেক এ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার বাংলাদেশে অবস্থান বিষয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মনোভাব, অস্ত্র খালাসের সঙ্গে ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো খোলামেলাভাবে তুলে ধরেন।
আদালত সূত্র বাংলানিউজ এসব বক্তব্যের বিষয় নিশ্চিত হয়েছে।
জবানবন্দির শুরুতে সাদিক হাসান রুমি বলেন, ‘অস্ত্র আটকের পর ২ এপ্রিল ভোর ৬টার সময় ডিজিএফআই’র চট্টগ্রাম ডিটাচমেন্টের কর্নেল রেজাউর রহমান আমাকে অবৈধভাবে আসা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটকের বিষয়টি জানায়। আমি তাকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে বলি। সঙ্গে সঙ্গে আমি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জানাই। তিনি জানান এ বিষয়ে তিনি আগে থেকেই অবগত। ’
রুমি বলেন, ‘সকাল আটটার দিকে রেজা আবার ফোন দিয়ে জানায় অস্ত্রগুলো আনার সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার জড়িত। এরপর বাবর সাহেব আমাকে ফোন করে তার সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। ’
রুমি বলেন, ‘চট্টগ্রামে আসার পর কর্নেল রেজা আমাকে জানান অস্ত্রগুলো আনার সঙ্গে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য আনা হচ্ছিল। এর সঙ্গে রেজ্জাকুল হায়দার ও এনএসআই’র কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত। তবে ঘটনার অনেক পর জানতে পারি অস্ত্রগুলো চীন থেকে এসেছে। ’
তিনি বলেন, ‘২ এপ্রিল বিকেলে অস্ত্রগুলো পরিদর্শনের পর আমরা বাবর সাহেবসহ সিএমপি কার্যালয়ে যাই। সেখানে মিটিং থেকে বুঝতে পারি এ ঘটনা কোনো সাধারণ চোরাচালান নয়, এর সঙ্গে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এবং ডিজিএফআই, এনএসআই’র লোকজন জড়িত। ’
‘পরে ডিজিএফআই’র সোর্সদের মাধ্যমে জানতে পারি এনএসআই’র তৎকালীন ডিজি ব্রিগডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম, উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন, ফিল্ড অফিসার লিয়াকত হোসেন অস্ত্র আনার সঙ্গে জড়িত। ’ বলেন তিনি।
২ এপ্রিল আটক করা অস্ত্র পরিদর্শনের পর এ সংক্রান্ত বিষয় বিস্তারিতভাবে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অবহিত করেন বলে রুমি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী তাকে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে এ ঘটনার তদন্ত হবে বলে আশ্বস্ত করেন বলে তিনি জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন।
রুমি আরও বলেন, ‘৩ এপ্রিল লুৎফুজ্জামান বাবর আমাকে ফোন করে রেজ্জাকুলকে কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার নিদেশ দেন। আমি পরেশ বড়ুয়ার সঙ্গে রেজ্জাকুলের সম্পর্ক এবং দশ ট্রাক অস্ত্র আনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি বাবর সাহেবকে জানাই। কিন্তু তিনি আমাকে বলেন রেজ্জাকুলকে কমিটির সদস্য করতে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ আছে। এরপর আমি রাজি হই। ’
তিনি বলেন, ‘পরে জানতে পারি দায়সারা গোছের একটি তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এ রিপোর্টে রেজ্জাকুল হায়দার, এনএসআই কমকর্তাদের বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘২০০৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই আমি উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া ঢাকার উত্তরা এলাকায় অবস্থানের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। আমি এ বিষয়ে রেজ্জাকুলকে তদন্ত করার নির্দেশ দিলে তিনি দু’একদিন পরই আমাকে জানান উত্তরায় পরেশ বড়ুয়া নেই। এতে আমার তার ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ হয়। পরে খবর নিয়ে জানতে পারি রেজ্জাকুলের সঙ্গে পরেশ বড়–য়ার সম্পর্ক আছে। ’
বুধবার বিকেল ৩টা ১০ মিনিট থেকে ৪টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুনতাসীর আহমেদের আদালতে সাদিক হাসান রুমি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম আদালতে দায়িত্ব পালনকারী নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্ত্তী।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) জেটিঘাটে খালাসের সময় দশ ট্রাক অস্ত্র আটক করে পুলিশ।
এ নিয়ে অস্ত্র আটক ও চোরাচালান আইনে দায়ের হওয়া দুটি মামলায় পুলিশ এর আগে চার্জশিট দাখিল করলেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মহানগর দায়রা জজ মামলা অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।
অধিকতর তদন্ত শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর এ মামলায় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক চারজনসহ মোট পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা হলেন- এনএসআইয়ের সাবেক দুই মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম, সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার শাহাবুদ্দিন, উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন ও ফিল্ড অফিসার আকবর হোসেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১১