ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি: অপরাধী যখন শাস্তি দেয় নিরপরাধকে!!!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১১
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি: অপরাধী যখন শাস্তি দেয় নিরপরাধকে!!!

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে এত বেশি লেখালেখি হচ্ছে যে নেপথ্যের নায়কদের সম্পর্কে কম-বেশি আমরা সবাই জানি। তবুও শিরোনাম বিষয়ে যাওয়ার আগে সংক্ষেপে তাদের বিষয়ে আলোচনা করতে চাই।



১. ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীকে শেয়ারবাজারে ডেকে আনলো কারা: ডিএসই’র বর্তমান পরিচালকদের একজন রকিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকাকালে শেয়ারবাজারকে বড় করার জন্য তার অন্য সহযোগীদের (বিশেষ করে বিশেষ আস্থাভাজন বর্তমান প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী) নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সভা, সেমিনার ও মেলার আয়োজন করেছেন। বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছেও গিয়েছেন। বিপুল পরিমাণ লাভের লোভ দেখিয়ে বাড়ি-ঘর, জমি-জমা বিক্রি করে শেয়ারবাজারে আসতে তাদের উৎসাহিত করেছেন। রকিবুর রহমান সরকারের খুব কাছের লোক হিসেবে পরিচিতি থাকায় প্রধানমন্ত্রীকেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, শেয়ারবাজার দিয়েই দেশের উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা  ড. মসিউর রহমানের জন্য। কারণ, তিনি তখন প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাতে পারেননি দেশের উন্নয়নে শেয়ারবাজারের কোনো ভূমিকাই নেই।

২. শেয়ারবাজারকে আকাশচুম্বি করলো এবং টাকা লুটে নিলো কারা: বাংলানিউজটোয়েনটিফোরডটকম-এ সাংবাদিক রাজু আহমেদের লেখা- পুঁজিবাজার: কেন এমন হলো, দায় কার? সাংবাদিক জেবুন নেসা আলোর লেখা- শেয়ারবাজার কেন অতিমূল্যায়িত হলো? পড়লেই বিস্তারিত জানতে পারবেন। এছাড়া শেয়ার কেলেঙ্কারি  তদন্ত কমিটির প্রধান জনাব ইব্রাহীম খালেদের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক ব্যবসায়ী নেতারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন এবং কে কীভাবে লুটে নিয়েছেন সে খবরও আমরা গণমাধ্যম থেকে বিস্তারিত জেনেছি। উল্লেখযোগ্য গ্রুপগুলোর নাম উল্লেখ করলেই খবরগুলো আপনাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে; যেমন সামিট, বেক্সিমকো, সিএমসি, আফতাব ইত্যাদি।

শুনতে খুব ভালো লাগে যে বাণিজ্যিক ব্যাংক, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউটগুলো শেয়ারবাজার থেকে শত-শত কোটি টাকা লাভ করেছে। তারা উচ্চমূল্যে তাদের শেয়ারগুলো পাবলিকের কাছে বিক্রি করে পোর্টফোলিও প্রায় খালি করে ফেলেছে।

উল্লেখ্য, এ সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও ব্যবসায়ী নেতারা জড়িত। সরকার থেকে শুরু করে সকলেই এদের তেল দিচ্ছে শেয়ার কেনার জন্য। কিন্তু তাদের হাতে থাকা অবশিষ্ট শেয়ারগুলো কমদামে বিক্রি করে বোঝাতে চাইছে শেয়ারের দাম অনেক কমে গেছে।

৩. শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) দায়িত্ব কী ছিল? আর তারা কী করেছে? আগে আলোচনা করা যাক, এসইসি কী করেছে?- বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, এসইসি এ পর্যন্ত যে সব আইন করেছে বা  সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলো সরকারি দলের ব্যবসায়িক নেতাদের সুবিধার জন্য করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিজেদের বিদ্যা-বুদ্ধিতে কিছুই করতে পারেনি। এই প্রতিষ্ঠানটি অযোগ্য ব্যক্তি ও দুর্নীতিতে সয়লাব হয়ে গেছে। বাজার কারসাজির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে কমিশনের সদস্য মনসুর আলমের পদত্যাগ ও নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবির ভূঁইয়াকে ওএসডি করাই এর বড় প্রমাণ। সম্প্রতি কমিশনের চেয়ারম্যানকে হাইকোর্ট ডেকে নিয়ে তার অযোগ্যতার বিষয়টি বুঝিয়েছে এবং তার পদত্যাগের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। জানা গেছে, ইকোনোমিকসে মাস্টার্স করে আইসিবিতে চাকরি করার সুবাদে তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। কোর্ট তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু তাঁর মাস্টার্সের রেজাল্টটাও জানা দরকার ছিল।

কমিশনের বিরুদ্ধে আরও যে অভিযোগগুলো সেসবের একটি হচ্ছে, বিভিন্ন গ্রুপের কাছে আগাম তথ্য ফাঁস করে শেয়ারের মূল্য বাড়াতে সাহায্য করা। অর্থের বিনিময়ে কমিশন এটা করছে কিনা তদন্ত করা প্রয়োজন। শেয়ারবাজারকে আকাশচুম্বি করার জন্য কমিশন যে ক্যাটালিস্ট বা প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে সেটা তাদের কর্মকাণ্ড থেকেই বোঝা যায়। যেমন- ডাইরেক্ট লিস্টিং, বুক বিল্ডিং, প্রেফারেন্স ও রাইট শেয়ার অনুমোদন, পর্যায়ক্রমে ফেসভ্যালু পরিবর্তনের অনুমোদনই হচ্ছে উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

৪. শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে কাদের শাস্তি হওয়া উচিত?- এক কথায় এর উত্তর হলো যারা বাজার কারসাজির  সঙ্গে জড়িত বা অপরাধী তাদের। তদন্তে আসল অপরাধীরা বেরিয়ে আসবে তা সদ্যগঠিত কমিটির কাছে থেকে আশা করাই যায়। কারণ তদন্ত কমিটির সভাপতি জনাব ইব্রাহীম খালেদ সম্প্রতি বলেছেন যে, আমি আমার ধারণা থেকে যেটা বলেছি সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে সেটা ভুলে যাব এবং বিশেষ মহল, ব্যক্তি বা সরকারি কোন সংস্থারও মতা নাই তদন্তে প্রভাব ফেলার। আমরা আশাবাদী এবং খুশি এই ভেবে যে, দেশে যখন বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রভাবে সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে তখন শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত কমিটির সভাপতি স¤পূর্ণ নিরপেক্ষতার ব্যাপারে সর্বসাধারণকে আশ্বস্ত করেছেন।

তদন্ত কমিটি অপরাধীদের খুঁজে বের করবে এবং তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তির সুপারিশ করবে, এ বিষয়ে আর কী-ই-বা বলার থাকে? কিন্তু শিরোনামের বিষয়টা পরিষ্কার করতে হলে বর্তমান সময়ের কিছু সংবাদ নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন;
৪.১. শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি এসইসি সদস্য মনসুর আলমকে পদত্যাগ  করতে বাধ্য করা হয়েছে এবং নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবির ভূঁইয়াকেও ওএসডি করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এদের অপরাধের শাস্তিটা কি হলো? এসইসির চেয়ারম্যানসহ অন্য যারা পদত্যাগ না করে বহাল তবিয়তে আছেন তারা যে শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত না, তার তো কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।

৪.২. নিয়ম ছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের মূলধনের ১০ শতাংশের অধিক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে না। কিন্তু তারা তা অতিক্রম করে অধিক বিনিয়োগ করে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে পাবলিকের কাছে বিক্রি করে শত-শত কোটি টাকা লাভ করে বাজার থেকে দূরত্বে চলে গেল। আইন বহির্ভূতভাবে বেশি বিনিয়োগ করার অপরাধে তাদের কি শাস্তি হলো? শাস্তির বদলে তাদের তেল দিয়ে অনুরোধ করা হচ্ছে শেয়ার কেনার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রতি নমনীয় থাকবে- এ আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে।  

৪.৩. এসইসি বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। এ দায় তারা কোনভাবেই এড়াতে পারে না। কয়েকদিন আগে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, শেয়ারবাজারে বর্তমান পিই রেশিও ২৩, যা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। কথা হচ্ছে, পিই রেশিও ২৩ সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য হলে এই ফরমুলা দিয়েই তো বাজার নিয়ন্ত্রণ সহজ। যে সব দুর্বল ফান্ডামেন্টাল কো¤পানির শেয়ারের পিই রেশিও অনেক বেশি এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ২-৩ গুণ দাম বাড়ানো হচ্ছে সেগুলোর বিষয়ে নজর দিলেও তো কারসাজি ধরা সম্ভব। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এ পর্যন্ত শেয়ারবাজারের কোন কারসাজি ধরতেও পারেনি এবং কাউকে শাস্তিও দিতে পারেনি। তবে শাস্তি দিয়েছে ৩০ হাজার নিরাপরাধ বিনিয়োগকারীকে, যারা ছয়টি ব্রোকারেজ হাউজে লেনদেন করে। প্রশ্ন হলো, এসইসি যদি পাঁচ মিনিটেই ছয়টি ব্রোকারেজ হাউজের এগ্রেসিভ সেল ধরতে পারে তাহলে এতদিনেও কেন কোন্ ক্ োঅ্যাকাউন্ট থেকে এগ্রেসিভ সেল হয়েছে সেটা ধরতে পারছে না। ৩০ হাজার নিরাপরাধ বিনিয়োগকারীর লেনদেন বন্ধ রেখে তাদের তি করছে কেন?

এসইসি বর্তমানে নতুন সার্কিট ব্রেকার দিয়ে কৃত্রিমভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা চালাচ্ছে আপাততঃ সেটা সফল মনে হলেও টেকসই নয়। বাজার কারসাজিতে জড়িত ষড়যন্ত্রকারীরা আগে যে কাজটা একদিনে করতে পারতো, এখন বেশি হলে তাদের দুইদিন লাগবে। তাই মূল যে কাজ বাজার কারসাজি নিয়ন্ত্রণ তা এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা দিয়ে হবে না। কারণ বাজার কারসাজিতে তারা নিজেরাই জড়িত।

একটা কোম্পানির শেয়ারের ফান্ডামেন্টাল ও বাজারদর নিয়ে আলোচনা করলে কারসাজির বিষয়টা সহজে বোঝা যাবে। চিটাগাং ভেজিটেবল কো¤পানির শেয়ারমূল্য ২০০৯-এর ১০ সেপ্টেম্বর ছিলো ৮২ টাকা ৬১ পয়সা এবং ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি উঠেছিল ছয় হাজার ৪৭৩ টাকা। এর বর্তমান পিই রেশিও ২৩০। এক বছর চার মাসে শেয়ারটির দাম বেড়েছে ৭৮ গুণ। এই কো¤পানিটির উৎপাদন বন্ধ। তারপরও কো¤পানি ২০ শতাংশ বোনাস দিয়েছে শেয়ার হোল্ডারদের। এখান থেকেই বোঝা যায় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এসইসি কী নিয়ন্ত্রণ করেছে বা করতে পেরেছে।

পরিশেষে খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের লেখা (২৭ জানুয়ারি ২০১১, কালের কণ্ঠ) থেকে কিছু অংশ হুবহু তুলে না দিয়ে পারছি না। কারণ এই কথাগুলো আমারও। ‘জুয়াড়ি সিন্ডিকেটের চক্রান্তে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতায় (সহায়তায়?) লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হলো। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে। বিধিবিধান আছে। আছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। শোনা যায়, নিয়ন্ত্রক নাকি নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে! তাও নাকি সিন্ডিকেটের হাতে! সবাই তো সরকারকে দোষারোপ করছে। সরকার কোনও ব্যক্তি নয়। সরকার চলে বিভিন্ন বিধিবদ্ধ সংস্থার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ সংস্থা দায় এড়াবে কীভাবে? সরকার কি অ্যাকাউন্টিবিলিটি নিশ্চিত করবে? কমিশন কি পুনর্গঠিত হবে?

প্রফেসর ড. মো. রিজাউল করিম শেখ: ইউনিভার্সিটি অফ মালায়া, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া। [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।