ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রণাঙ্গনের ১০০ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা

আতিয়া আক্তার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২২
রণাঙ্গনের ১০০ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা

একযুগের অধিক সময় ধরে Oral History বা কথ্য ইতিহাসকে আশ্রয় করে মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি সংগ্রহের যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, এরই উত্তম উদাহরণ লেখক মো. আবু হাসান তালুকদারের ‘১০০ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা’ গ্রন্থটি। এবারের একুশে বইমেলায় (ফেব্রুয়ারি-২০২২) গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে।

গ্রন্থটির লেখক কোনো স্বীকৃত ইতিহাসবিদ নন। তিনি একজন স্ব-প্রণোদিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংকলক। গ্রন্থের মুখবন্ধেই লেখক একটি আবেগাপ্লুত বার্তা দিয়েছেন। বার্ধক্যের ছোবল কিংবা রোগাক্রান্ত হয়ে বিগত কয়েক দশকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাই জাতির এই মহান সন্তানদের প্রয়াণের পূর্বেই তাদের যুদ্ধকালীন স্মৃতি সংরক্ষণ করতে হবে। এই তাড়না থেকেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়িয়েছেন। তাদের যুদ্ধকালীন স্মৃতি সাক্ষাৎকার/লিখিত রূপে সংগ্রহ করেছেন। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপস্থাপনের স্বার্থে প্রতিটি ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন কর্মকান্ড লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ, যুদ্ধকালীন পত্র-পত্রিকা, দলিল দস্তাবেজ, বিভিন্ন ওয়েবসাইটের তথ্য ও প্রয়োজনবোধে তাদের সহযোদ্ধাদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন স্মৃতিকথা সংগ্রহ ও সংকলনকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সংশ্লিষ্ট গ্রন্থের বরাতে জানা গেছে, তিনি একজন পেশাদার ব্যাংকার। অগ্রণী ব্যাংকে কর্মরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পূর্বেও ‘অগ্রণী ব্যাংক পরিবার: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা’ নামীয় গ্রন্থ সংকলন করেছেন।

লেখক বিশ্বাস করেন, যতদিন প্রান্তিক পর্যায়ে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন স্মৃতি সংরক্ষণ না করা হবে, ততদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পূর্ণতা পাবে না। আর তাদের স্মৃতিকথা সংরক্ষণের কাজটি খুব দ্রুতই করতে হবে, কেননা বয়সের ভারে নতজানু মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিভ্রাট ও প্রস্থানে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার মৌলিক উপাদান।

ইতিহাস আশ্রয়ী প্রায় সকল মৌলিক গ্রন্থ একটি সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করে, তা হলো নতুন তথ্য উপাত্তের প্রয়োগ কিংবা বিদ্যমান তথ্যের ভিন্নতর উপাস্থাপনা। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে গ্রন্থটি অনেক নবতর তথ্যের দ্বার উন্মোচন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থটিতে লেখক পাঁচজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা (বীর বিক্রম/বীর প্রতীক), সাতজন কমান্ডার (কোম্পানি/প্লাটুন), বেশ কয়েকজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের একশ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন স্মৃতিকে মোলাটবন্দি করতে সক্ষম হয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য এদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যতীত অধিকাংশের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রম কোনো ইতিহাস গ্রন্থে তো দূরে থাক, এমনকি পত্রিকার পাতায় কিংবা অনলাইন নিউজপোর্টালেও ঠাঁই পায়নি। এই ঠাঁই না পাওয়ার তালিকায় বাদ যাননি আব্দুল গফুর মিয়া বীর প্রতীকের মতো খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাও।

মেলাঘর ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে পরিচালিত ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’-এ ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম বীর প্রতীকের সঙ্গী পদ্মা রহমানের যুদ্ধকালীন স্মৃতিও গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। উঠে এসেছে দুই শতাধিক সম্মুখ সমরের গল্প। লিপিবদ্ধ হয়েছে সহযোদ্ধার চোখে দেখা ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (বীরশ্রেষ্ঠ) ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজের (বীর উত্তম) দুঃসাহসী অভিযান ও শহীদ হওয়ার মুহূর্ত। এমন অসংখ্য জানা, অজানা ঐতিহাসিক ঘটনাকে অত্যন্ত নির্মল ও নির্মোহ সত্যের আদলে গ্রন্থটিতে স্থান দেয়া হয়েছে।

কথ্য ইতিহাসের উপাদানের আধিক্য গ্রন্থটিকে অনেকাংশে সমৃদ্ধ করলেও, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় গ্রন্থটির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণায় সংশ্লিষ্ট ঘটনার স্থান, কাল ও পাত্রের সাথে লেখক কেবলমাত্র সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন। প্রথাগত ইতিহাস রচনায় দ্বান্দ্বিক পরিসরে কোনো বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেভাবে যুক্তি-তর্কের অবতারণায় দাবি ও তথ্য উপস্থাপন করা হয় তেমনটা দেখা যায়নি। লেখক অবশ্য এজাতীয় পরিসর থেকে কৌশলে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। কেননা লেখকের রচনায় উঠে আসা অনেক মুক্তিযোদ্ধাই প্রান্তিক পর্যায়ের যোদ্ধা। কেবলমাত্র তাদের দাবীর ভিত্তিতে কোন বিদ্যমান তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করতে গেলে, অন্যান্য উৎসে প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্তের অভাব হবে। লেখকের ভাষ্যমতে তার এই প্রয়াস কোন ইতিহাসগ্রন্থ নয়, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন স্মৃতিকথা।

দোয়েল প্রকাশিত ৮০০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি যদিও স্মৃতিকথা তবুও ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের ধারা, সমন্বয় ও সন্নিবেশন গ্রন্থটিকে ইতিহাস আশ্রয়ী মৌলিক গ্রন্থে পরিণত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় ঐতিহাসিকরা সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ থেকে মৌলিক ইতিহাস রচনার উপাদান খুঁজে পাবেন মর্মে লেখক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

আতিয়া আক্তার: প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি এম. এম. আলী কলেজ, টাঙ্গাইল

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২২
এমজেএফ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।