ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

করাত | মাহফুজুল আলম খান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৭
করাত | মাহফুজুল আলম খান করাত | মাহফুজুল আলম খান

চাকরি পেলাম 'পরিবর্তন' নামে এক এনজিও সংস্থায়। নতুন চাকরি। যেহেতু এর আগে আমার পুরনো কোনো চাকরি ছিলো না সে হিসেবে নতুন না বলে জীবনের প্রথম চাকরিই বলা যায়।

সারাদেশে এই সংস্থার অনেকগুলো জনকল্যাণ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রজেক্ট রয়েছে। যে প্রজেক্টে আমাকে দেয় সেখানেই কাজ করতে হবে- এ শর্তটি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে।

শর্ত যা-ই থাকুক; আপত্তি নেই, আমার চাকরিই চাই। ভেতরে ভেতরে খুব খুশি আমি। মাস ঘুরলেই নিশ্চিত আয়। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বান্ডেল।

পরিবারের 'টেনে আনতে ছিঁড়ে যায়' অবস্থা থেকে উত্তরণে একটু হলেও ভূমিকা রাখা যাবে। অনেকদিন ধরে বড় ভাইয়ের উপর সংসার চালানোর ধকল যাচ্ছে।

এই অকর্মা 'আমাকে' নিয়ে সবসময়ই আমি সংশয়ে ছিলাম যে, "আমাকে দিয়ে কিছু হবে কিংবা আমাকে কেউ চাকরিতে নেবে না" এই টাইপের।

টিউশনি করতেও 'জোর' লাগে। মাথার জোর। মোটামাথা দিয়ে মোটাতাজা টিউশনি জোটে না। কৃশকায় টিউশনের টাকায় শুধু আমার হয়। ঘরে কিছু দেওয়া যায় না।

চাকরিটা হওয়াতে পরিচয় দেয়ার মতো একটা জিনিস হলো। হঠাৎ নিজেকে কেমন যেনো যোগ্য যোগ্য ভাবতে লাগলাম। আসলে নিজেকে যতোটা অযোগ্য ভেবেছিলাম মনে হয় ঠিক সেরকম অযোগ্য আমি নই। নইলে এতোগুলো পরীক্ষা উতরে গেলাম কী করে! ইন্টারভিউতে ঘাগু ঘাগু সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েই তো চাকরি হলো। বেকার জিনিসটা অসহ্য এক জিনিস। সকালে ঘুম থেকে ওঠে আবার ঘুমানো পর্যন্ত এই অসহ্য তকমা নিয়ে সারাদিন ঘুরতে হয়। কতো সুন্দর সুন্দর ছেলেকে দেখি বেকার পরিচয়ে চেহারার মধ্যে কেমন একটা ভ্যাবদা ভ্যাবদা ভাব!

আমার পোস্টিং হলো চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে। চিরসবুজ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বে এই অঞ্চলটি পিছিয়ে নেই মোটেও। সবগুলো রাস্তাই পিচঢালা। দু'পাশে গাছ-গাছালি। রাস্তার পাশে পাশে ছোট খাল। এরপরে সবুজ ধানক্ষেত। বিকেল বেলায় রাস্তার পাশে, দক্ষিণ দিকে মুখ করে বসলে মনে হবে কোথাও যেনো লাখ খানেক এয়ারকন্ডিশন বসিয়ে রাখা হয়েছে। সা সা বাতাস। প্রকৃতির আদরে চোখ বুজে বুজে আসত বারবার।

জয়েন করার জন্য গিয়েছিলাম শাহরাস্তি'র হেড অফিসে। বস টাইপের দুইজন মধ্যবয়স্ক মানুষ বসা ছিলো দুই টেবিলে। আমার পরিচয় সবিস্তারে পেশ করে, নিয়োগ পত্রটি দুইজনের মধ্যে কাকে দেব, কে এক নম্বর বস, কে দুই নম্বর বস এটা নিয়ে যখন মাথার ভিতর হিসাব মিলাচ্ছিলাম তখন একজন হাত বাড়িয়ে আমার নিয়োগপত্রটি নিলেন। বুঝলাম, ইনিই এক নম্বর বস। তারা দু’জন একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। মুখ টেপাটেপি করে হাসলেন। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটু ভাব নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। চেয়ারের হেলান জায়গায় একটু অতিরিক্ত হেলান দিয়ে, পায়ে চাপ দিয়ে চেয়ারটাকে মৃদু ঘোরানোর চেষ্টা চলছে। তারা দু’জনেই নিচুস্বরে কী যেনো বলাবলি করলেন, তারপর আমি যাকে এক নম্বর বস মনে করলাম তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি চিতোষী এরিয়ার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আপনি কাল ওখানেই জয়েন করবেন”।
আমি যতোদূর সম্ভব বিনয়াবনত হয়ে বললাম- জ্বি, স্যার।

আমার শিক্ষানবিশ পিরিয়ড তিনমাস। চিতোষী ব্রাঞ্চের পুরনো ম্যানেজার মানিক লাল রায় আমার সঙ্গে থাকবেন তিনমাস তারপর রিটায়ার্ড। এই তিনমাসে তিনি আস্তে আস্তে সব নিয়ম কানুন বুঝিয়ে দিয়ে পুরো ব্রাঞ্চটা আমার ঘাড়ে তুলে দেবেন। একজন বুড়ো মানুষ পেলাম আমার ট্রেইনার হিসেবে। বুড়ো মানুষের সঙ্গে চলাফেরার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার নেই। তিনি আমার সহকর্মী, কেমন যেনো দাদা দাদা লাগে। আমাকে 'মনছুর সাহেব' বলে ডাকেন। নামের সাথে সাহেব শুনে একটু লজ্জাও করছিল আমার। আমি তাকে ‘মানিকদা’ বলে ডাকবো, সেটা মনে মনে স্থির করে নিলাম।

আমাদের পুরো ব্রাঞ্চটাই ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের। 'পরিবর্তন' সংস্থার অন্যতম একটি প্রকল্প। মানিকদা বললেন, এটি হচ্ছে 'পরিবর্তন' সংস্থার 'মা' প্রকল্প।

এই প্রকল্প দিয়েই এই সংস্থার কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য প্রকল্প, স্যানিটেশন প্রকল্প, শিক্ষা প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প নিয়ে এই সংস্থা ডালপালা বিস্তার করে।

আমার অধীনে দশজন মাঠকর্মী। সকাল হতেই তারা চিতোষী এরিয়ার পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। যাদেরকে ঋণ দেওয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে সাপ্তাহিক কিস্তি তুলে নিয়ে আসে। কাউকে নতুন ঋণ দেয়। আমার কাজ হলো সেগুলো তদারক করা।

কর্মীদের সামনে দেখি মানিক দা'র চোখ সবসময় লাল। কোনো কিছুতেই ছাড় নেই। সকাল আটটায় হাজিরা খাতায় সাইন করতে হবে। আটটা মানে আটটা এক মিনিট নয়। কেউ একটু লেইট করলে তাকে সাইন করতে দেওয়া হয় না। সাইন না করা মানে ওই দিনের বেতন শেষ। লেইট করা অনেকেই হাতদু’টো কচলে কচলে মাথানিচু করে মানিকদা'র সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।

মানিকদা'র চোখ লাল। লাল চোখে বলেন, “ঠিক আছে সাইন করো, তবে তিনদিন এভাবে লেইট আসলে একদিনের বেতন কেটে নেওয়া হবে”।

এই অপরাধে একদিন রফিকের বেতন কেটে নেওয়া হলো। বেচারা মুখ কাঁচুমাচু করে অপূর্ণ বেতন নিয়ে চলে গেলো।

একজন কর্মীর অধীনে এক একটি পাড়ায় গড়ে প্রায়ই বিশ-পঁচিশজন ঋণগ্রহীতা থাকেন। সবার কাছ থেকে নির্ধারিত দিনে, নির্ধারিত হারে কিস্তি আদায় করে নিয়ে আসতেই হবে। কোনোভাবেই একটি কিস্তিও বকেয়া রাখা যাবে না। সাথে দশ টাকার একটি সঞ্চয়ও আছে। এটি ঋণগ্রহীতার সঞ্চয়। কারও কিস্তি বকেয়া পড়লে সেটা কর্মীর পকেট থেকে দিয়ে পূরণ করে নিয়ে আসতে হবে। যেটা ব্রাঞ্চ অফিসে জানানোও যাবে না।

মানিকদা একদিন কর্মীদের সম্পর্কে আমাকে সতর্ক করে বললেন, এদেরকে চিনেন না মনছুর সাহেব, এরা হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। একদম লাই দিবেন না। লাই দিলে এরা আপনার চাকরি খোয়াবে।

'চাকরি খোয়াবে' ব্যাপারটা প্রথমে বুঝিনি। পরে মানিকদা বুঝিয়েছেন। বললেন, “এই দশজনের উপর আমার চোখ লাল কেন জানেন, যদি আমার ব্রাঞ্চে একটি কিস্তিও বকেয়া থাকে তাহলে আমার বস আমার বেতন থেকে কেটে নেবেন। যদি দশজনে দশটি কিস্তি বকেয়া রাখে তাহলে আমার বেতনের কী হবে ভেবে দেখছেন”?

আমি এমনভাবে মাথা নাড়ালাম যেনো এর গুরুত্ব একটুও আমার মাথার বাইরে যায়নি। বুঝলাম, এই মানুষটির দীর্ঘ সময়ের চাকরি জীবনে অনেক ঝড়-ঝঞ্জা আছে। আমাকে টিকে থাকতে হলে সবগুলো কৌশল শিখে রাখা দরকার।

একদিন মানিকদা লাল চোখের ফিরিস্তিও দিলেন। বললেন, "বুঝলেন মনছুর সাহেব, আমার উপর আছে এরিয়া ম্যানেজারের লাল চোখ, তার উপরে আছেন রিজিউনাল ম্যানেজার, তার উপরেও ডিভিশনাল ম্যানেজার। এর উপরেও লাল চোখ আছে। সবার উপরে থাকার কথা আমাদের এমডি স্যারের লাল চোখ। তবে তার চোখ কখনই আমি লাল দেখিনি। বড় বড় সম্মেলনে তিনি আমাদেরকে সামনে নিয়ে কথা বলেন। তার কথায় মনের মধ্যে একটা শান্তি শান্তি ভাব এসে যায়। তিনি শান্ত, অমায়িক প্রকৃতির মানুষ। ছোট বাচ্চাদের সাথে কেমন হেসে হেসে কথা বলেন। সবার জীবনের মানোন্নয়নের কথা বলেন। সমাজ সেবায় অবদানের জন্য তিনি দেশ-বিদেশের অনেকগুলো পুরস্কারও পেয়েছেন”।

আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি এমডি স্যারের কথা। যার চোখ সবচেয়ে লাল হওয়ার কথা তার চোখ লাল নয়। তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা আমার গলে গেলো।

মানিকদা'র মোটরসাইকেল আছে। কোম্পানি থেকে দেওয়া হয়েছে। আমিও একটি মোটরসাইকেল পাব মাস ছয়েক পর। আমি চালাতে জানি না। তবে এর মধ্যে হাতটা পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। প্রায় প্রতিদিনই মানিকদা'র পেছনে করে পাড়ায় পাড়ায় কালেকশন কেন্দ্র পরিদর্শন করতে যাই। কর্মীদের দক্ষতা, ঋণ গ্রহীতাদের আচার-আচরণ ইত্যাদি আমাদের পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। উপরের বসকে রিপোর্ট করতে হবে।

উপরের বস সপ্তাহে দু'বার আসেন আমাদের ব্রাঞ্চে। তার মুখটাতে হাসি কী জিনিস কখনও দেখিনি। সবসময় গম্ভীর মুখ। চোখ জোড়া লাল। ভাবখানা এমন যে, তার ঘরে আজ সিঁদ কাটা হয়েছে এবং আমরা উপস্থিত থেকেই তা করিয়েছি। বস আসলে মানিকদা একেবারে চুপসে যান। জোড়া হাত দু’টো যেনো নিচে নামতেই চায় না। কচলাতে থাকে সারাক্ষণ। কথা বলার সময় শব্দগুলো আটকে যায়। একবার বস ধমক দিয়ে কী একটা জিজ্ঞেস করাতে মানিকদা থতমত খেয়ে উত্তর দিলেন, “স্যার, আমি তখন তুছিটে ছিলাম”।
আমি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম 'তুছিটে' কী জিনিস?
পরে আবিষ্কার করলাম তিনি তখন 'ছুটিতে' ছিলেন।

ঋণগ্রহীতারাও মাঝে মাঝে বেয়াড়া হয়ে ওঠে। তাদের বেয়াড়াপনার খেসারত দিতে হয় আমাদের মাঠকর্মীদের। যারা কিস্তি দিতে গড়িমসি করে তাদের শায়েস্তা করার জন্য উপরের বস থেকে মাঝে মধ্যে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হই আমরা। এই ট্রেনিংগুলো কর্মীদের মাধ্যমে বেয়াড়া ঋণগ্রহীতার উপর প্রয়োগের নির্দেশনা আছে। সব কর্মীদের ডেকে চোখ লাল করে মানিকদা বলে দেন, ''কোনো অবস্থাতেই কারও কিস্তি খেলাপি মেনে নেওয়া যাবে না। যদি কোনো ঋণগ্রহীতা কিস্তি দিতে না পারে তাহলে উঠোনে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় তাকে শাসিয়ে দেবে। পুলিশের ভয় দেখাবে। ঘরের দরজায়, বেড়ায় হালকা লাথি-গুতো দেবে। তাহলে তারা ভয় পেয়ে যাবে। মান-সম্মানের ভয়ে কিস্তি দিতে আর গড়িমসি করবে না। গরীবদের মান-সম্মান একটু বেশি থাকে”।

একদিন সত্যি সত্যি ট্রেনিং প্রয়োগের সময় হয়ে গেলো। মোল্লা পাড়ার শাহানা বেগম পরপর চারটা কিস্তি খেলাপ করে দিলেন। শাহানা ছিলেন মাঠকর্মী মোসাদ্দেক আলীর অধীনে। যেখানে একটি কিস্তি খেলাপ হলে ম্যানেজারের ভর্ৎসনায় জানটা ফালা ফালা হয়ে যায় সেখানে চার চারটা কিস্তি খেলাপ! ম্যানেজার আজ তাকে আস্ত খেয়ে ফেলবে! চাকরিটা বোধহয় চলেই যাবে আজ! দুঃখে আর অগ্রিম অপমানে চেহারা-ছুরত জ্বলে গেলো মোসাদ্দেকের। মানিকদাকে সরাসরি বলার রিস্কটা না নিয়ে সুযোগ বুঝে সে কথাটা আমার কাছে পাতলো।

মোসাদ্দেক ছেলেটা একটু নরম প্রকৃতির। কারও দুঃখ, শোক সহ্য করতে পারে না। শাহানার কান্নাকাটিতে এক কিস্তি নিজের পকেট থেকে দিয়েছিল। এরপর থেকেই বিপত্তি। কিস্তি আর আদায় করা যাচ্ছে না। কী যেনো অসুখে ধরেছে শাহানাকে। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর থেকে ট্যাঁ ট্যাঁ করে।

বড় ছেলের এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময় অন্য কোথাও ধার-কর্জ না পেয়ে সামশুন্নেছার বুদ্ধিতে 'পরিবর্তন' থেকে তিন হাজার পাঁচশো টাকা ঋণ নিয়ে বসে মোল্লা পাড়ার শাহানা। আড়াইশো করে ষোল সপ্তাহে ষোল কিস্তি দিতে পারলেই তার সুদে-আসলে পুরো টাকা পরিশোধ হয়ে যায়। প্রথম দুইমাস ঠিকঠাক কিস্তি চালিয়েছিল শাহানা। গত মাস থেকে হঠাৎ হাটু দু’টো ফুলে গিয়ে অসহ্য ব্যথা চলে আসে কোত্থেকে। সেই থেকে শাহানার কিস্তি খেলাপ শুরু হয়। কিস্তি খেলাপ মানে মাঠকর্মীদের উপর বসদের অত্যাচার। উপরওয়ালাদের কাছ থেকে এমন এমন কথা শুনতে হয়, আমার মনে হয় ঘুমের মধ্যেও এরা অপমানে চমকে চমকে ওঠে।

মোসাদ্দেক বিড় বিড় করে বলে, "অভাবগ্রস্ত, গেঁয়ো, বেয়াড়া ঋণগ্রহীতারা এর মূল্য কী বুঝবে? একসাথে পাঁচ হাজার, দশ হাজার টাকার বান্ডেল তাদেরকে দেখিয়েছে কে? এর মর্ম কি বুঝবে তারা? শৃংখলা ভঙ্গ করে এমন শাহানা বেগমদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার”।

পরদিন মোসাদ্দেককে সাথে নিয়ে শাহানার বাড়িতে গিয়ে কিস্তি খেলাপের বিশদ বিবরণ জেনে আসলাম। পা ফুলা নিয়ে ভাঙাচোরা চৌকির এক কোণায় জড়সড় হয়ে বসে শাহানা যা জানাল তার সারমর্ম হয় এই-

শাহানার সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শাহানাই। বড় এক ছেলে আর ছোট ছোট দু’টি মেয়ে রেখে দিনমজুর স্বামী ওবায়দুল মারা যায় বছর তিনেক আগে।

কেঁদে কেঁদে বুক ভাসানোর মতো অফুরন্ত সময় তার হাতে ছিলো না। খাওয়ার জন্য চার চারটা মুখ সবসময় রেডি। অন্য সবকিছু বাদ দিলেও দু'বেলা দু'মুঠো পেটে দিতেই হবে। চোখের পানি-টানি বাদ দিয়ে মনকে শক্ত করে শাহানা।

এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে দুই তিন জায়গায় কাজ নেয় সে। আর তাতেই তাদের সবার আহারের বন্দোবস্ত হয়ে যায়। তার মধ্যে বড় ছেলেটা পড়েও। গোলমাল বাঁধে ছেলেটার এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময়। উপায়ান্তর না দেখে সে হাত দিয়ে বসে ক্ষুদ্র ঋণে। ঋণের বাড়তি টাকাটা পরিশোধের জন্য সে ইদ্রিস সাহেবের খামার বাড়িতে অতিরিক্ত কাজ নেয়। শরীর সুস্থ থাকলে এতোসব ঝামেলা পোহাতে হতো না। গতমাস থেকে হঠাৎ তার হাঁটু ফুলে যায়, সাথে ব্যথাও। প্রথম প্রথম ফোলা নিয়েও কাজে গিয়েছিল, পরে সে ভালোমতো হাঁটতেও পারে না। সেই থেকে ঘটে কিস্তি খেলাপের ঘটনা।

অফিসে এসে মোসাদ্দেক শেষমেশ কলজে চেপে ধরে মানিকদাকে বলেই ফেললো ঘটনা। যা ভেবেছিলাম তাই। রাগে আগুন বের হচ্ছে মানিকদা'র চোখ দিয়ে। মুখে যা আসে তাই বললেন মোসাদ্দেককে। চিৎকার করে পুরো ব্রাঞ্চ অফিস মাথায় তুললেন। ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলেন মাঠকর্মীরা সবাই।

পরদিন অফিসে দেখলাম জোড়ায় জোড়ায় লাল চোখ। শাহরাস্তি হেড অফিসের 'মুখ টেপাটেপির' দুই বস, তারাও এসেছেন। সবার মুখ গম্ভীর। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে অগ্নিকাণ্ডে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা ছাইয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। মানিকদা কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একপাশে।

এক নম্বর বস ধমক দিয়ে মানিকদাকে বললেন, “চার চারটা কিস্তি খেলাপ হয় এই অফিসে, আপনি কোথায় ছিলেন”?
মানিকদা থতমত খেয়ে মাথা চুলকে বললেন, “ঘটনা আমাকে বলেনি মোদাসসেক"।
বাজখাঁই গলায় বস জিজ্ঞেস করলেন, “মোদাসসেক! কোন মোদাসসেক”?
হাত কচলাতে কচলাতে মানিকদা বললেন, “জ্বি স্যার,আমাদের মোদাসসেক”।

আমি পাশে ছিলাম। ঘটনা বুঝতে পারলাম। এরকম একটা গম্ভীর পরিবেশেও আমার হাসি পাচ্ছিল 'মোদাসসেক' শব্দটা শুনে। ধমক খেয়ে মানিকদা'র কথায় অক্ষর উল্টে গেছে। বসের সামনে বিড়বিড় করে কথা বলতে গেলে মানিকদা'র এই ঘটনা ঘটে।

আমি একটু উঁচু গলায় বললাম, স্যার, আমাদের মাঠকর্মী মোসাদ্দেক।

তারপর অনেক হল্লা হয়ে গেলো। অফিসে আমাদের গাফিলতি, দায়িত্বহীনতা ও অবহেলা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার, এই জাতীয় ভর্ৎসনা ও ধমকের মধ্যেই কিছুক্ষণ কেটে গেলো।

এর কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছোটখাটো দল গিয়ে হাজির হলাম শাহানাদের উঠোনে। ভাবছি আজ হয়তো আমাদের প্রশিক্ষণের হাতে কলম পর্বটি নিজ চোখে দেখব। উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি শুরু হতেই আশেপাশের উৎসুক কিছু লোকজনেরও সমাগম হয়ে গেলো। শাহানা বেগম অতি কষ্টে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ঘোমটা টেনে দাওয়ায় এসে বসলেন। মানিকদা শাহানা বেগমকে ধমক দিয়ে তার ক্ষমার অযোগ্য স্পর্ধার কাজটি স্মরণ করে দিয়ে তাকে পুলিশে দেওয়ার হুমকি দিলেন।

শাহানা বেগম অনুনয় করে বললেন, তাকে যেনো কিছুদিন সময় দেওয়া হয়। সে সুস্থ হয়ে উঠলে সব টাকাই ঠিকঠাক পরিশোধ করে দেবে।

কে শোনে কার কথা। বসরা নাছোড়বান্দা। বললেন, টাকা আজই দিতে হবে।
শাহানা বেগম ঘোমটা দিয়ে নাক ও চোখ মুছলেন। মনে হচ্ছে বেচারি কাঁদছে।
তার পাশে আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে চার-পাঁচ বছরের একটা ছোট্ট মেয়েও। শাহানার মেয়ে হবে হয়তো। মায়ের কান্না দেখে সেও কাঁদছে। অপমান জিনিসটি না বুঝলেও সে ধরে নিয়েছে আজ তার মায়ের সাথে কষ্টের কোনো ঘটনা হচ্ছে। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে ফিসফাস শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। কেউ কেউ মুখ চেপে চেপে হাসছে। মনে হচ্ছে তারা মজার কোনো ঘটনা দেখছে।

কিছু কিছু মানুষ, অন্যের দুঃখ-কষ্টে, অপমানেও মজা খুঁজে পায়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে এই স্বভাবটা নেই। একবার অ্যানিম্যাল প্লানেট চ্যানেলের মধ্যে দেখেছিলাম, একটি ক্ষুধার্ত বাঘ বিপদে পড়া এক মোষের বাচ্চাকে সেবা করছে। কী আশ্চর্য!

শেষমেশ আমাদের দলটি শাহানার খেলাপ কিস্তির একটা বিহিত করেই ছাড়লেন। শাহানার ঘরের ভিতরে বাইরে ভালো করে দেখা হলো বিক্রয়যোগ্য কোনো জিনিসপত্র আছে কিনা। পাওয়া গেলো না। উঠানের কোণে দাঁড়িয়ে ছিলো একটি মোটাতাজা কড়ই গাছ। সেটা দর দেওয়া হলো। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে একজন আগ বাড়িয়ে এসে কিনে নিলেন গাছটি। বাজার দরের চেয়ে অনেক কম। লোকটি মহাখুশি! শাহানার চার কিস্তি শোধ হয়ে আরও এক কিস্তি অগ্রিম পরিশোধ হয়ে গেলো বারোশো পঞ্চাশ টাকায়।

শাহানার বাড়ি থেকে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আড়চোখে বসদের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চোখের লাল আভা কমে এসেছে। একটু হাসির আভা চোখ থেকে ঠিকরে পড়ে মুখের দুই পাশে ছড়িয়ে পড়েছে।

কড়ই গাছও মনে হয় বেশ শক্ত কারণ, শাহানার বাড়ি থেকে তখনও শোনা যাচ্ছিল গাছ কাটা করাতের সেই আওয়াজ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৭
এসএনএস

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।