ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অসুখের শিরোনাম: বুনো বলে কিছু নেই | হিমাংশু দেব বর্মণ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৭
অসুখের শিরোনাম: বুনো বলে কিছু নেই | হিমাংশু দেব বর্মণ অসুখের শিরোনাম: বুনো বলে কিছু নেই | হিমাংশু দেব বর্মণ

কবির কলম থেকে বেরিয়ে আসে মুক্তির মন্ত্র। সমাজের সংস্কার। পরিশুদ্ধ জীবনের নির্দেশনা। প্রত্যেকটা জীবই সংগ্রামী। মানুষ তো বটেই। এই মানুষই একমাত্র জীব, যার রূপ বহুমাত্রিক, বহু সত্ত্বার অধিকারী। এই মানুষই শোষক, আবার মানুষই তার দ্বারা শোষিত। শোষক আর শোষিতের মাঝখানে যে দালালি করছে- সেও মানুষ।
 

মানুষের জীবন ও চরিত্রকে বিশ্লেষণ করলে সমস্ত জীবের সঙ্গেই এক করে ভাবা যায়। যদিও এখানে মূল আলোচনা সেটা নয়।

কিন্তু কবি জাহিদ সোহাগের ‘অসুখের শিরোনাম’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর ধারাবাহিক বর্ণনায় যে বিষয়সমূহ ফুটে উঠেছে, তা এই কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়। মানুষের যেমন ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আকাঙ্ক্ষা, জৈবিক তাড়না ইত্যাদি রয়েছে। তা সব জীবের মধ্যেই বর্তমান। ওদের মাঝে মায়া-মমতা প্রেম-প্রীতি কোনোটাই কম নেই। এমন কী, মানুষের মাঝে যে সৃজনশীল ক্ষমতা রয়েছে, তা পশু-পাখিদের মধ্যে চাক্ষুষ বর্তমান। বনের পশুরা খেলা করে, দৌড়াদৌড়ি করে, মারামারি কামড়াকামড়ির অভিনয় করে। নদীতে সাঁতার কাটে। পাখিরা আকাশে ডিগবাজি দেয়, মধুর সুরে গান গায়। এগুলোকে আমরা তাদের পশুত্ব বলে উড়িয়ে দিতে পারি না। বরং পরম উৎসাহ ভরেই বলতে পারি, মেনেও নিতে হবে এটা তাদের সৃজনশীলতার চূড়ান্ত নিদর্শন। কবি তার কবিতায় পরিষ্কার বলে দিয়েছেন ‘বুনো বলে কিছু নেই’। তাদের এই সৃজনশীলতার প্রতি যদি আমরা এতোটুকু সম্মান দেখাতে চাই তাহলে কবির কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর যদি অমান্য করি, তাহলে নিজেদেরকে (মানুষকে) জংলি বলে দাবি করার কোনো অপ্রাসঙ্গিকতা নেই এতোটুকু।
 
হ্যাঁ, এখানে প্রথমেই যে কথা বলা হয়েছে— মানুষই শোষণ করে, মানুষই শোষিত হয়। আবার মানুষই এক সময় ফুঁসে ওঠে সেই শোষকের বিরুদ্ধে। এই ফুঁসে ওঠার জন্য যে চেতনার প্রয়োজন তা মূলত বের হয়ে আসে সমাজের বোদ্ধা বা চিন্তাশীল ব্যক্তির কলমের মুখ দিয়ে। আমরা তাদেরকে নিঃসন্দেহে বলতে পারি সমাজের সাধক। আর সাধকের সেই সত্ত্বাটা হয় কবিসত্ত্বা।
 
সবার কাছে যা মামুলি, একজন কবির কাছে তা অনিবার্য। আবার কিছু বিষয় ঠিক তার উল্টোটা। চল্লিশোর্ধ্ব পর্বে বিন্যস্ত এই কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ পর্বেই দেখা গেছে কবি তার দৃষ্টি বারবার ফিরিয়েছেন নারীর দিকে। তাকে কখনও মাতা, ভগ্নি কখনও বা সঙ্গী, প্রিয়তমা রূপে। তবে এখানে যেটা পরিষ্কার বোঝা যায়, তা হলো কবি যখন কাব্যচর্চায় মগ্ন। তখন সে নারীচরিত্রের কাছে তিনি তার কবিকেই জাগিয়ে রেখেছেন। কবির ভাবনা যেখানে থিতু, সেখানে আবার দু’টি ভাগে বিভক্ত দু’টি সত্ত্বা। ব্যক্তি বা পুরুষসত্ত্বা আর কবিসত্ত্বা।
 
একজন কবি কেবল কল্পনায় নয়। বাস্তবেও যখন নগ্ন নারীর রূপ দেখবেন তখন তা থেকে কেবলই জন্ম নেবে কবিতা। যতোক্ষণ তার ভেতরের কবি জাগিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু যখন ভেতরের পুরুষ জেগে উঠবে। তখনই অপমৃত্যু ঘটবে তার কবির। পুরুষ হয়ে উঠবে সিংহ। পাবে কেবলই রক্ত-মাংসের গন্ধ স্বাদ। ছন্দ বিলীন হয়ে যাবে নারীর মাঝে। এই কাব্যগ্রন্থ রচনাকালে কখনও কবির অপমৃত্যু ঘটেনি। জেগে ওঠেনি কালপুরুষ।
 
হ্যাঁ, সঙ্গম ছাড়া কোনো কিছুরই জন্ম বা সৃষ্টি হয় না। যেমন একটি কবিতার জন্ম হতেও কাগজ ও কলমের সঙ্গম ঘটাতে হয়। ঠিক নারী-পুরুষের সঙ্গম যে সমস্ত সৃষ্টিশীল কর্মের মূলে অতি সুক্ষ্মভাবে একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখে একথাও আমাদের স্মরণে আসে এ-গ্রন্থ চর্চায়।
 
যেদিন কবিতা পড়তে শুরু করি। সেদিন তো আর জানতাম না কবিতা কেন লেখে, কীভাবে লেখে। আজও তাই। এসব প্রশ্ন মাথার মধ্যে খেলে বেড়ায় সারাক্ষণ। হ্যাঁ, এটা একবাক্যে মেনে নেওয়া যায় যে মানুষ আত্মার খোরাক যোগাতে, মনের টানে লিখে যায় কবিতা। আর হয়ে ওঠেন কবি। ব্যক্তিজীবনের প্রেম-রোমাঞ্চ, ঘাত-প্রতিঘাত, সমাজজীবনের অনাচার-কুসংস্কার, জীবন, জগৎ সব মিলে এলোমেলো ভাবনাগুলো তার শব্দের গাঁথুনীতে গেঁথে কবি লিখে যান। আর সেই লেখা যখন বাস্তবতার সঙ্গে খাপেখাপ, তখন তা হয়ে ওঠে সার্থক কবিতা। কল্পনা আসে মন থেকে। আর ভাবনা আসে বাস্তব থেকে। মনের কল্পনার সঙ্গে বাস্তব ভাবনার মিশ্রণ ঘটিয়ে কবি তার মনের মাধুরী মিশিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর কাব্যময় করে তোলেন তার লেখনী। যেমন ধরুন, কবির কল্পনায় এলো তার সৃষ্ট নায়ক-নায়িকা এখন রিকশায় চড়ে ঘুরতে গেলো শহরের কোনো বস্তিতে। অথবা নির্জন কোনো গলিতে। সেখানকার বাস্তব রূপটা কী হবে? বস্তিবাসীদের করুণ ছবি। কিংবা নির্জন গলির গাঁজার গন্ধ, পকেটমার বা ছিনতাইকারীর উৎপাত। অথবা ব্যস্ত সড়কের যানজটে রিকশা দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাড়ির কালো ধোঁয়া লেগে নায়িকার উপর্যুপরি হাঁচি।
 
নবরসে জীবন। সেই রসগুলোর সব রসই একসাথে আসে না কারও জীবনে। আজ যে শিশু মায়ের স্তন কেড়ে দুধ পান করে, যৌবনে সেই শিশুই প্রিয়ার স্তন ছুঁয়ে পরম তৃপ্তি লাভ করে স্বপ্ন দেখে অনাগতের। কবির ভাবনায় কবিতার আসা-যাওয়াটাও ঠিক তেমন। কবিতাভাবনা আসে তার নিজস্ব গতিতেই। তবে তার আসাটা যদিও প্রেম দিয়ে শুরু হয়। তাকে ধরে রাখতে হয় বাৎসল্য দিয়েই। সৃষ্টি তো বাৎসল্য থেকেই হয়। আমার মনে প্রেম জেগে উঠলে আমি প্রেমিকাতেই মগ্ন থাকব। তাকেই কাছে টানব। পাওয়ার আশা করব। এটাই স্বাভাবিক। যতোক্ষণ সেই প্রেমে বাৎসল্যের মিশ্রণ না ঘটবে। ততোক্ষণ নতুনের সৃষ্টি, বা কোনো কিছুর জন্ম হবে না। সে হিসেবে আমরা কবিতা হোক, গল্প বা যে কোনো সৃষ্টিশীল কাজের ক্ষেত্রে প্রথমেই বাৎসল্যকে স্থান দিতে পারি চোখ বুজে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।