ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

জমেলা বানুর জলাতঙ্ক | শিল্পী নাজনীন

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৭
জমেলা বানুর জলাতঙ্ক | শিল্পী নাজনীন জমেলা বানুর জলাতঙ্ক

বিজয়া দশমীর ঠিক পরের ভোরে গ্রামের শেষপ্রান্তে, পালবাড়ির বাঁধানো পুকুরের মধ্যভাগে বিসর্জিত দেবীপ্রতিমার কংকালের পাশে একটি স্ত্রীলোকের মরদেহ ভাসতে দেখা গেলো। গ্রামে হিন্দু তেমন একটা নেই। যে দু-চার ঘর আছে, তারা ছোট পরিসরে নমঃ নমঃ করে কোনো উপায়ে দেবীপূজা সেরে পালবাড়ির বড় পুকুরেই বিসর্জন দেয়।

এ গ্রাম থেকে নদী বেশ দূরে বলে তারা আর অধিক ঝক্কিতে যেতে চায় না। একসময় আমলাবাড়ির কালিবাড়িতে পূজা হতো অনেক বড় পরিসরে।

এখনও হয়। তবে ছোট করে। এখন আর তেমন জমে না বলে এ গ্রামের হিন্দুরা বড় একটা যায় না সেখানে। সেদিন ভোরে, পূজার রেশ কাটতে না কাটতেই ঘুম ভেঙে গ্রামের পুকুরে এমন খাপছাড়া ঘটনায় বেশ একটা হুলুস্থুল পড়ে গেলো গ্রামে। গ্রামসুদ্ধ লোক ভিড় করল ঘটনা কী দেখতে। লাশ তুলতে নেমে গেলো কয়েকজন। ডাঙায় তুলতেই চেনা গেলো, জমেলা বানু। মৃগীরোগ ছিলো তার। জল আর আগুন থেকে দূরে থাকত বরাবর।
 
পদ্মার কোলঘেঁষা গ্রাম। ঠিক গ্রামও নয়। পাড়া। পদ্মাতীরের ছোট এই জনবসতিতে বেশ ক’টা পাড়া। তার মধ্যেই একটা কুঠিপাড়া। এমন অদ্ভুত নাম নিয়ে প্রশ্ন করলে কেমন একটা গা ছমছমে উত্তর পাওয়া যায়। যা শুনে কিছু দৃশ্য চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। চোখে ভাসে, সাহেবী পোশাক আর গামবুট পরা লালমুখো অত্যাচারী কতোগুলো ইংরেজ একটা কুঠিবাড়িতে পায়চারী করছে, শুয়ে, বসে গুলতানি মারছে, মদ খেয়ে মাতলামি করছে কিংবা কঠিনমুখে খিস্তি করছে কতোগুলো হাড়-চামড়া সর্বস্ব, নিরক্ষর, খেটে খাওয়া মানুষের উপর আর ময়লা, ছেঁড়া কাপড় পরা অসহায় মানুষগুলো হাতজোড় করে, কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে। প্রায়শ্চিত্ত করছে মীরজাফর নামক বহুদূরের কোনো এক অদেখা, অচেনা লোকের বিশ্বাসঘাতকতার। নীলচাষের অত্যাচারে যাদের জীবনে শুরু হয়েছে এক নিদারুণ হাহাকার। মুখে মুখে শোনা এই নামটার প্রতি তাদের অবশ্য তেমন ক্ষোভ বা আক্রোশ কিছু নেই। অভাবী, মূর্খ এ মানুষগুলো, নিষ্পেষিত হতে হবে আজীবন, এটুকুই জানে। দেশীয় অত্যাচারী জমিদার বা ভিনদেশি লালমুখো প্রভু, দুইই তাদের চোখে এক। শোষক। শোষকের চেহারা, আর শোষণের ধরন, এই দুইয়ে যা তফাৎ।
 
শোনা যায়, এখানে ছিলো ইংরেজদের নীলকুঠি। নীলচাষ করে প্রজারা তা এখানে জমা করত, আর সাহেবরা তা স্টিমারে তুলে, ভেঁপু বাজিয়ে, পাইপ টানতে টানতে, স্টিমার আর পাইপের ধোঁয়া যুগপৎ ছাড়তে ছাড়তে পদ্মা দিয়ে ভেসে যেত সেই সুদূর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশে। পেছনে পড়ে থাকত অশিক্ষিত, অসহায় নীলচাষীদের কান্না ও চোখের জল, পড়ে থাকত তাদের ক্ষুধা ও হাহাকার। সেই নীলকুঠি থেকেই এ পাড়াটার নাম হয়েছে কুঠিপাড়া। অদূরে আরেকটা পাড়া ছিলো। সে পাড়াকে বলা হতো বুনোপাড়া। সে পাড়ার বাসিন্দারা শুয়োর পালতো। সাহেবরা শুয়োরের মাংস খেত, শুয়োরের মাংস আসতো এই বুনোপাড়া থেকে। শোনা যায়, ও পাড়ায় বড় একটা যেত না কেউ। ঘন জঙ্গলে ছিলো ঢাকা। সাপ-খোপ তো ছিলোই এমনকি দিনদুপুরেই নাকি বাঘ-ভালুকও চোখে পড়ত হঠাৎ হঠাৎ। শুয়োর পালতো বলে বুনোপাড়ার বাসিন্দাদেরকে অন্যপাড়ার সবাই দেখত ঘৃণার চোখে, নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে চলতো সবাই, এমনকি তাদেরকে বুনো বলে সম্বোধন করত বেশিরভাগ মানুষ। সে নিয়ে বুনোপাড়ার মানুষদের তেমন মাথাব্যথাও ছিলো না শোনা যায়। সারাদিন শুয়োর চরিয়ে দিনশেষে চোলাই মদ গিলে সন্ধ্যা হতে না হতেই নাক ডাকিয়ে ঘুমাত তারা। পালা শুয়োর আর তাদের মধ্যে তফাৎ বলতে তারা শুয়োরগুলোকে পালতো আর তাদেরকে পালতো স্বয়ং ভগবান, তাদের মতে। অভাব পুরো বসতি জুড়ে থাকলেও শ্রেণিবৈষম্যের সুক্ষ্ণ একটা পর্দা সেই তখন থেকেই ছিলো। দিন যতো গেছে ততো তা প্রকট হয়েছে আরও।
 
এখন সে নীলকুঠি নেই, সেই ইংরেজ নেই, নীলচাষের সে ব্রহ্মদৌত্যিও নেই তবু কুঠিপাড়া ঠিকই তার নাম নিয়ে জেগে আছে। শুধু বুনোপাড়া নেই। সে বুনোরাও নেই। তারা সবাই ধর্মান্তরিত হয়ে কেউ রহিম আলী, কেউ করিম আলী নাম নিয়ে চলে গেছে অন্য বসতিতে। অতীত কেউ মনে রাখেনি আর। অতি প্রাচীন দু-চারজন মাঝে মাঝে সে নিয়ে হা হুতাশ করে জাত্যাভিমান জাহির করতে চায় বটে তবে ছেলে-ছোকরারা ওসব কানে তোলে না বড় একটা। তাদের কাছে ওসবের কোনো মূল্য-ফুল্য নেই। এ অঞ্চলের অধিকাংশ লোকই হিন্দু ছিলো আগে, নিম্নবর্ণ। উচ্চবর্ণ যে দু-চারঘর হিন্দু ছিলো তাদের কারও কারও দাপটে আর অত্যাচারে নিম্নবর্ণ হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে বেঁচেছে এবং তামাশার ব্যাপার হলো, দেশভাগের সাথে সাথে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের অধিকাংশ পরিবারকে ধর্মান্তরিত এসব নব্য মুসলমানদের দাপটে বাধ্য হয়ে ওপার বাংলায় পালাতে হয়েছে। এই পলায়নের ষোলকলা প্রায় পূর্ণ হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়। জীবন বাঁচাতে অনেক মুসলমান যেমন ভারতে পালিয়েছিল তেমনি পালিয়েছিল হিন্দুরাও। তবে তাদের পালানোটা ছিলো আরও হৃদয়বিদারক। মুসলমান যারা, তারা জানত দেশ স্বাধীন হলেই তারা ফিরে আসবে। কিন্তু হিন্দু যারা, তারা জানত গণেশ উল্টে গেছে। তারা এখানে ফিরলেও আতংক পিছু ছাড়বে না তাদের। তবু বেশ কিছু পরিবার ফিরেছিল। বাধ্য হয়ে অনেকেই রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে আবার। নব্য মুসলমানেরা অতীতের দেনা সুযোগ পেয়ে শোধ দিয়েছে সুদে-আসলে। নিরীহ অনেক হিন্দু পরিবারকেও দাম দিতে হয়েছে চড়া। ধর্ম নামক ছোট একটা শব্দ তছনছ করে দিয়েছে অনেক পরিবার, ওলোট-পালোট করে দিয়েছে বহু মানুষের জীবন। ঠিক ধর্মও নয়, লোভ। সম্পত্তির লোভ। হিন্দুদের ভিটে-মাটি ছাড়া করে তাদের সব সম্পত্তি রাতারাতি গ্রাস করার লোভ। প্রতিহিংসা। ওপার থেকেও এসেছে অনেক মুসলমান এপারে, তবে তার প্রভাব এই ছোট্ট বসতিতে পড়েইনি বলা চলে। নিম্নবর্ণ ধর্মান্তরিত হিন্দুরা তাদের পূর্বপরিচয় ভুলে গেছে ঢের আগে। উচ্চবর্ণ, অত্যাচারী হিন্দুদের দেশত্যাগে তাদের ভূমিকা বেশ জোরালো ছিলো এবং এতে তারা মোটেই অখুশি নয়। তবে উচ্চবর্ণ সব হিন্দুই অত্যাচারী ছিলো না। অনেক দেশান্তরী হিন্দু পরিবারের জন্যই এখনও প্রাচীনদের অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখ অশ্রুসজল হয়। বিশেষ করে পূজা-পার্বণে। এখানে এখনও যে দু-চারটি হিন্দু পরিবার রয়ে গেছে তাদের পূজা-পার্বণে গিয়ে তারা সেসব স্মৃতির জাবর কাটে। ভারী একটা শোকের পরিবেশ তৈরি হয় তখন, সেই সঙ্গে পূজার ক্ষীণ আনন্দও ছড়ায় গ্রামে।
 
আমলাবাড়ির কালীবাড়িতে এই ক’বছর আগেও ভারী জাঁকজমক করে দূর্গাপূজা হতো। কলকাতা থেকে বাবুরা ঠিক হাজির হতেন ভিটে-মাটির টানে। আনন্দে আহ্লাদে দূর্গোৎসব শেষে আবার তারা চোখের জল মুছতে মুছতে চড়ে বসতেন গিয়ে খোকসা স্টেশনের লক্কর-ঝক্কর মেইল ট্রেনে। ট্রেন গিয়ে থামতো পোড়াদহ স্টেশনে। সেখান থেকে বর্ডার পার হয়ে আবার কলকাতাগামী ট্রেন। তা এখন সেসব চুকেবুকে গেছে। এখন আর দূর্গোৎসবে প্রাণ নেই। করতে হবে তাই করা। যে দু-চার ঘর হিন্দু আছে তারাও থাকে ভয়ে ভয়ে। সময়টা খারাপ এখন। যেকোনো সময় যে কারও ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। আর তাহলেই সর্বনাশ। আজকাল মানুষ খুব বেশি অনুভূতিপ্রবণ। সামান্যতেই তাদের অনুভূতিতে ঘাঁ লাগে।

পদ্মার তীরঘেঁষা যে জায়গাতে কুঠিবাড়ি ছিলো সে জায়গাটা অন্যান্য জায়গা থেকে ছিলো বেশ উঁচু। ঘন জঙ্গল সাফসুতরো করে, মাটি ফেলে উঁচু করে, ইট দিয়ে বাঁধিয়ে সে জায়গাতে ইংরেজরা নীলকুঠি তৈরি করেছিল নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে। বর্ষাকালে বন্যা হলে পুরো এলাকা চলে যেত পানির নিচে। পদ্মার পাড়ে হওয়ায় স্টিমারে চড়ে এসে তারা নীলকুঠিতে উঠত, বন্যার পানি অতো উঁচু পর্যন্ত পৌঁছাত না। কালক্রমে ইংরেজ চলে গেছে, কুঠিবাড়িও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কিন্তু কুঠিবাড়ির সে উঁচু ভিটেটা আছে। এলাকার লোকজন ভিটেটাকে অন্য কাজে লাগিয়েছে। সে ভিটে এখন কবরস্থান। গ্রামের মানুষ আসলে ইংরেজদের অত্যাচারের স্মৃতিকে কবর দিতে, নাকি বর্ষায় যেহেতু পুরো অঞ্চল তলিয়ে যেত পানির নিচে, সে আতংকে স্বজনদের মরদেহ নির্বিঘ্নে দাফন করার অভিপ্রায়ে এ স্থানটা বেছে নিয়েছিল, সে কথা বলা মুশকিল। তবে এক্ষেত্রে দ্বিতীয় কারণটাই বেশি যুক্তিপূর্ণ। বেশ কিছু দূরে, অন্য পাড়ায়, আরও একটা কবরস্থান আছে। তবে, সে কবরস্থান এতোটা উঁচু নয়। বর্ষাকালে সেখানে একহাঁটু পানি উঠে যায়। সেসময় কেউ মারা গেলে সেখানে কাউকে কবরস্থ করা বহুত ঝক্কি ছিলো। তবে কুঠিপাড়ার কবরস্থান সাধারণত এ পাড়ার স্থানীয় এবং মাতবরগোছের লোকজন ও তাদের স্বজনদের জন্যই বরাদ্দ। অন্য পাড়ার লোকজন এ কবরস্থানে জায়গা পাওয়ার জন্য তেমন চিন্তিত নয়। আদতে জীবিত মানুষ বেঁচে থাকা অবস্থায় ঠিক মন থেকে বিশ্বাস করতে পারে না যে সেও একদিন মারা যাবে, কিংবা তারও স্থান হবে কোনো এক কবরের অন্ধকার গুহায়। তবে এ ব্যাপারে পাশের গ্রামের জমেলা বানুকে বেশ ব্যতিক্রম দেখা গেলো।
গ্রামে সেবার এলো ভয়াবহ বন্যা। পদ্মা যেনো ফুঁসে উঠল আক্রোশে। চারদিকে থই থই জল। গ্রামের মানুষের দুর্দশার অন্ত নেই। ঠিক সেসময় শুরু হলো কলেরা। পটাপট মরতে শুরু করল গ্রামের মানুষ। গোসাইডাঙ্গীর গোরস্থান তখন দুই হাত পানির নিচে। কুঠিপাড়ার গোরস্থানে অল্প কিছু মরদেহ নিয়মানুযায়ী দাফন করা হলো। বাকি লাশগুলো গোসাইডাঙ্গী গোরস্থানে ঠিক কী উপায়ে দাফন করা হলো সে বিষয়টা স্পষ্ট বোঝা গেলো না।
 
বন্যা নেমে গেলো একসময়। আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো জনজীবন। যাদের স্বজন মরেছে তারাও শোক ভুলে মন দিলো প্রাত্যহিক কাজকর্মে। শুধু জমেলা বানুকে দেখা গেলো সময় নাই অসময় নাই কুঠিপাড়ার গোরস্থানের পাশে উদাস উদাস মুখে বসে থাকতে। তার এমনিতেই মাথার দোষ। গ্রামের লোকেরা বলে ‘উপরি দোষ’। হঠাৎ হঠাৎ ফিট হয়ে পড়ে যায়, মুখ দিয়ে তখন গ্যাঁজলা বের হয়, শরীরে খিঁচুনি ওঠে। সামান্য সেবা শুশ্রুষা পেলে খানিক পরেই সে আবার ফট করে উঠে বসে, হি হি হাসে। যেনো সাত জম্মেও তার কোনো রোগবালাই ছিলো না। এসব দেখে পাড়ার লোক অভ্যস্ত। ওতে তারা আর ভড়কায় না। কিন্তু কুঠিপাড়ায় জমেলার বাড়ি নয়, এ পাড়ায় তাকে তেমন চেনেও না কেউ। অমন অচেনা, বয়স্ক একজন মহিলাকে দিনদুপুরে, উষ্কখুষ্ক চেহারায়, এলোচুলে গোরস্থানের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখে লোকজনের কৌতূহল হলো। তারা কাছে গিয়ে জমেলার সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করল, সে কী চায়।
 
জমেলা কথা বলে না। সে তেমনি ঘোলা, উদাস চোখে গোরস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে কী সব বলে, ঠিক বোঝা যায় না। লোকজনের কৌতূহল বাড়ল। পাগলকে নিয়ে কৌতুকের যে চিরাচরিত নিয়ম সে অনুযায়ী গ্রামের ছেলে-ছোকরাদের উৎপাতও সহ্য করতে হলো জমেলা বানুকে নিয়মিত। কিন্তু তাতে তাকে তেমন চিন্তিত দেখা গেলো না। কৌতূকের উত্তরে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে সে ততোধিক কৌতুকের যোগান দিলো আরও। ভারী আমোদ পেল অল্পবয়সীরা। অনেকে ঢিল ছুঁড়তে লাগল। জমেলা বানু চিৎকার করে, বকে, না পেরে শেষে তার নিয়মানুযায়ী ‘ফিট’ হয়ে গেলো আবার। এবার আশেপাশের বয়স্ক দু-চারজন এগিয়ে এলো ব্যাপারটা কী হলো দেখতে। দৌড়ে গিয়ে জল এনে চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল কেউ। উঠে বসল জমেলা। চোখ পিটপিট করল কিছুক্ষণ, যেনো বুঝতে চেষ্টা করল আদতে সে কোথায় আছে এখন। তারপর শুরু হলো, শরীর দুলিয়ে হাসি। হি হি হি… হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল সে। লোকজন ভয় পেল এবার। একে তো ভর দুপুর তখন, তারপর আবার গোরস্থানের পাশে, নির্জন জায়গা। জমেলা বানুর উপর নির্ঘাত কোনো জ্বীন-ভূতে আছর করেছে। ছোটদেরকে সাবধান করল বড়রা। তারপর চলে গেলো একে একে সবাই। আড়াল থেকে নজর রাখল জমেলা বানুর উপর।
 
জমেলা বানু কারও সাতে পাঁচে থাকে না। সে প্রতিদিন সকাল করে এসে গোরস্থানের দিকে মুখ করে রাস্তার লাগোয়া কবর ঘেঁষে বসে। বিকেল নাগাদ আবার ফিরে যায়। মাঝে মাঝে সে একাই মাথা ঝাঁকিয়ে, হাত নেড়ে, চোখ ঘুরিয়ে কী সব বলে বিড়বিড় করে। মাঝে মাঝে তাকে গোরস্থানের কাছের টিউবওয়েল থেকে জল খেতে দেখা যায়। কাছে পিঠে আছে একটা পেয়ারা গাছ। স্থানীয়রা বলে আমশবরি। খুব খিদে পেলে জমেলা বানুকে দেখা যায় সে গাছের নিচে গিয়ে আমশবরি পাড়ার কসরত করতে। নাগালের মধ্যে দু-চারটে পেলে সে ছিঁড়ে আনে, তারপর আগের মতোই গোরস্থানের পাশটিতে লেপটে বসে কচকচ চিবোয়। জগতে আমশবরির চেয়ে সুস্বাদু আর কোনো খাদ্যবস্তু যে আছে তা জমেলা বানুর ভাবভঙ্গিতে বিশ্বাস করা শক্ত।
 
কুঠিপাড়ার লোকজন জমেলা বানু সম্পর্কে খোঁজখবর করল প্রথম প্রথম। তারা ভাবল হয়তো সদ্য বিদায় নেওয়া কলেরায় তার কাছের কেউ মরেছে, তাই এই মাথার গণ্ডগোল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো সেসব কিছু নয়। জমেলা বানু নেহাত মাথা খারাপ উদ্বাস্তু ধরনের একজন মানুষ। তিনকুলে কেউ নেই তার। স্বামী যুদ্ধে গিয়ে ফেরেনি আর। বাপ-মা মরেছে ঢের আগে। এককালে তারা নাকি ছিল ‘বুনোপাড়ার’ বাসিন্দা। তবে রীতিমত কলেমা পড়ে মুসলমান হয়েছিল তারা। জমেলা বানু মানুষের বাড়িতে কাজ করে পেট চালায়। আজকাল মাথার সমস্যাটা সম্ভবত বেড়েছে তার। কারও বাড়িতে কাজটাজ তাকে বড় একটা করতে দেখা যায় না এখন। খিদে পেলে সে পরিচিত বাড়িতে গিয়ে বসে পড়ে। খাবার দিলে খায়, না দিলে অন্য বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। দিনের বাকি সময় তার কাটে গোরস্থানের দিকে ঘোলা চোখে বসে বিড়বিড় করে কী সব বলে।
 
মানুষের বিস্ময় বাড়ে, বাড়ে কৌতূহল। কেন অমন কাজকর্ম ফেলে, নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারাদিন গোরস্থানের পাশে বসে থাকে জমিলা বানু! তার মাথার ঠিক নেই বটে, তা বলে আর অন্য পাগলদের তো কই কখনও দেখা যায়নি অমনধারা অদ্ভুত আচরণ করতে! সবাই বরং গোরস্থানের ছায়াও মাড়ায় না ভয়ে। জমেলা বানুর ব্যাপারটা তাহলে কী!
দু-চারজন বউঝি ভয়ে ভয়ে জমেলার আশেপাশে ঘুরঘুর করে চেষ্টা করল তার মতলবটা আসলে কী তা জানার। কিন্তু জমেলা বলে না কিছুই। ড্যাব ড্যাব তাকিয়ে শুধু হি হি হি হাসে। বড় ফ্যাসাদ। গোরস্থানের কাছেই সর্দার বাড়ি। সর্দার বাড়ির কর্তা, গিন্নীকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, যেমন করে হোক পাগলীটাকে ডেকে বাড়িতে এনে তার পেট থেকে কথা বের কর। কেন সে অমন লেপ্টে সারাদিন বসে থাকে গোরস্থানের কাছে। আর কেনই বা মাঝে মাঝে হিহিহি হাসে। হঠাৎ হঠাৎ আবার কথা নেই, বার্তা নেই গলা ছেড়ে মরার কান্না কাঁদে। যতোসব ছন্নছাড়া কাণ্ড। মাথামুণ্ডু নেই কোনো। গোরস্থানের আশেপাশে ‘বেপর্দা মেয়েমানুষ’ ঘুরঘুর করা শরিয়তে জায়েয নেই। সর্দার গিন্নী কী করে জমিলাকে বাড়িতে ডেকে আনবেন ভেবে পেলেন না প্রথমে। শেষে বিরক্ত হয়ে তিনি নিজেই গেলেন গোরস্থানের দিকে। জমেলা বানু তখন উদাস চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে গভীর তত্ত্বচিন্তায় মগ্ন। সর্দার গিন্নীকে সে প্রথমে খেয়ালই করল না। সর্দার গিন্নী জমেলার ভাবগতিক দেখে বাজখাঁই গলায় তেড়ে উঠলেন। জমেলা আচমকা এমন উৎপাতে চমকে উঠল। সর্দার গিন্নীর দিকে বড় বড় চোখে পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। শেষে আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করল। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গোরস্থানের ভেতরকার বড় বড় গাছপালার দিকে তাকিয়ে সে আকুল হয়ে কী একটা ভাবনায় তলিয়ে গেলো। সর্দার গিন্নী কিছুটা দমে গেলেন। এ তল্লাটে তার কণ্ঠের কেরামতিকে তোয়াজ করে না এ এক পরম বিস্ময়। তথাপি তিনি ধৈর্য্য হারালেন না। পুনরায় কণ্ঠ কিঞ্চিৎ নরম করার চেষ্টা করে বললেন, এই পাগল! তুই বাত খাবি? খিদে লাগেচে রে?
জমেলা বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করল। বাতাস শুঁকে কিছু একটার আভাস পেতে চাইল সে। পাগলদেরও ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে, তাদেরও মাঝে মধ্যে খিদে পায়। জমেলারও পেয়েছিল। কিন্তু এখানে তাকে খেতে দেওয়ার মতো কেউ আছে তেমনটা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। সে কিছুটা ভয়ে ভয়ে বলল, কী কন?
সর্দার গিন্নী একই কথা আবার বললেন। এবার জমেলা উঠে দাঁড়াল। পরনের কাপড় থেকে ধুলোবালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, হ, খাব!
বারান্দায় জমেলাকে খেতে দিয়ে অদূরে বসে রইলেন সর্দার গিন্নী। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন জমেলার খাওয়া। জমেলা দ্রুতহাতে ভাত মুখে তুলছে, গপাগপ গিলছে। আর কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। খাওয়া শেষে সে আবার দ্রুতপায়ে গোরস্থানের দিকে হাঁটা দিলো। সর্দার গিন্নী যতো বললেন, এই দাঁড়া! শোন, শোন!
জমেলার হাঁটার গতি ততোই দ্রুত হলো। সে পুনরায় তার নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে গোরস্থানের দিকে মুখ করে বসে পড়ল। হতাশ সর্দার গিন্নী ফিরে গেলেন বাড়ি। কিন্তু এরপর থেকে জমেলা মাঝে মধ্যেই সর্দার বাড়িতে হাজির হয়ে সর্দার গিন্নীর কাছে খাবারের আবদার করতে শুরু করল। সর্দার গিন্নীর সাথে বেশ একটা খাতিরও জমে গেলো তার। ফলে সর্দার গিন্নী তার কাছ থেকে পুনরায় জানার চেষ্টা করল কেন সে সারাদিন এই গোরস্থানের কাছে এসে বসে থাকে একা। কিন্তু জমেলা মুখ খোলে না কিছুতেই। বেশ ক’দিন পর একটু সহজ হলো সে। সতর্কতার সাথে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল আর কেউ তাদের কথা শুনছে কিনা। তারপর, ভয়ে ভয়ে সর্দার গিন্নীর দিকে তাকিয়ে বলল, জবর বয় হরে!
সর্দার গিন্নী অবাক হয়ে বললেন, বয়? কিসির বয় হরে রে তোর?
পানির বয়। – ভয়ে শিউরে উঠে বলল জমেলা।
পানি? পানি কোনে রে? কিসির পানি?
ও যো! গুসাইডাঙ্গীর গোরস্তানে! বানের পানি উটে যায়! সপ ডুবে যায় সেহন!
তাতে তোর কী?
কী পাগল রে! বোজে না কতা! আমি মলি যদি হোনে মাটি দেয়? আমার জবর বয় হরে! পানির নিচে কেমবা থাকপোনে সেহন?
সর্দার গিন্নী থম ধরে কিছুক্ষণ জমেলার রুক্ষ্ণ, পাগলাটে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। হাসি চাপার চেষ্টা করলেন, শেষে না পেরে দমফাটা হাসিতে ভেঙে পড়লেন। হাসতে হাসতে চোখে জল এলো তার।
জমেলা বিরক্ত, রাগত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেষে চলে গেলো গোরস্থানের দিকে। আবার সে মগ্ন হলো নিজের ভাবনায়। কুঠিপাড়ার লোকজন জমেলার এই অদ্ভুত আচরণের কারণ আর তার চেয়ে অদ্ভুত রকমের ভয়ের কথা জানতে পেরে কিছুদিন হাসাহাসি করল খুব। ছেলে-ছোকরারা তাকে উৎপাতও করল বেশ কিছুদিন। তবে মুরুব্বীরা তাদের নিষেধ করায় শেষে তারাও নিরস্ত হলো একসময়। জমেলা বানু নিজের মনে আসে, যায়। মাঝে মাঝে সর্দার গিন্নীর কাছে গিয়ে খাবার চেয়ে খায়।
হঠাৎ একদিন সর্দার গিন্নীর খেয়াল হলো জমেলা অনেকদিন থেকে আসছে না আর। বেশ একটু চিন্তায় পড়লেন তিনি। কর্তাকে বললেন পাগলীটার একবার খোঁজ নিতে। জানা গেলো গোরস্থানের পাশেও তাকে দেখা যায় না অনেকদিন। খটকা লাগল। জমেলা বানুর গ্রামে লোক পাঠান হলো।

জল এবং আগুন থেকে দূরে থাকত জমেলা। মৃগীরোগের তেমনই বিধান। সে নিয়ম বড় একটা ভাঙতে দেখা যেত না তাকে। তবে, বিসর্জিত দূর্গাপ্রতিমার প্রতি কৌতূহল কিংবা স্রেফ গোসলের উদ্দেশ্যেই কিনা কে জানে, কখন, কোন ফাঁকে সেই সন্ধ্যায় অথবা রাতে পুকুরে নেমেছিল জমেলা। পরদিন সকালে দেবীমূর্তির কংকালের পাশে জমেলাকেও ভাসতে দেখা গেলে হুলস্থুল পড়েছিল সারা গ্রামে। গ্রামবাসী তাকে তুলে এনে আনুষ্ঠানিকতা শেষে গোসাইডাঙ্গীর গোরস্থানে দাফন করেছিল। জমেলার মৃত্যু এক গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে পৌঁছানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ছিলো না। দাফনের সময়ও গোসাইডাঙ্গীর গোরস্থানে ছিলো আধহাঁটু জল।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।