ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মহীবুল আজিজের মরমী জগৎ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৭
মহীবুল আজিজের মরমী জগৎ ড. মহীবুল আজিজ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ও সভাপতি ড. মহীবুল আজিজ সমকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় একজন উল্লেখযোগ্য নাম।

নায়করাজ রাজ্জাকের প্রয়াণের পর পরই তিনি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ ইংরেজিতে শোক-জ্ঞাপক কবিতা প্রকাশ করেছিলেন এবং সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘একবিংশ শতকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম: সন্ধিক্ষণ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে অন্যতম আলোচক হিসাবে প্রযুক্তি ও পরিবর্তনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন।

বুধবার (১৮ অক্টোবর) তিনি ভাব-বৈভবে পরিপূর্ণ ‘ভরসানামা’ নামে গানের সংকলন উপহার দিয়ে নিজের মরমী জগতটিকে উন্মোচিত করলেন।

বহুমাত্রিকতার দ্যোতনায় মহীবুল আজিজ গ্রবন্ধ, গবেষণা, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও অনুবাদে ইতিমধ্যে অর্ধ-শত গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘ভরসানামা’ ছাড়াও এ মাসেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর তিনটি গ্রন্থ: বেঙ্গল পাবলিকেশন থেকে ইতালো কালভিনো-এর গল্পের অনুবাদ, বলাকা প্রকাশন থেকে খালেদা হানুম: মননে ও সৃজনে এবং লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনী থেকে স্বরচিত ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ প্রাইভেট মোমেন্টস। নিজের নিভৃতিতে বসবাস করে সাহিত্যের গতিশীল প্রবাহে তিনি প্রতিনিয়ত মননশীল ও সৃজনশীল কর্ম সম্পাদনের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।    

মহীবুল আজিজের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বর্ণময়। বৃহত্তর নোয়াখালীর জাতক হলেও তিনি জন্মেছেন বৃহত্তর যশোরে। শৈশব, তারুণ্য কেটেছে দেশের নানা স্থানে। যৌবন ও কর্মজীবনের দীর্ঘ বছরগুলো কাটছে চট্টগ্রামে। অবস্থান করেছেন ক্যামব্রিজে। ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের বহুদেশ। এবং নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছেন স্টিভেন হকিংস, চিনুয়া আবেচে, আরকে নারায়ণ, নীরোদ সি চৌধুরী, তপন রায় চৌধুরী, গোলাম মুরশিদ প্রমুখ বিদগ্ধজনের। যে কারণে তাঁর গল্প বা উপন্যাসে ইউরোপ, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার পটভূমি স্ফূর্তি লাভ করেছে এবং চূড়ান্ত বিবেচনায় পাশ্চাৎ ও প্রাচ্য পরিভ্রমণের পর তাঁর অন্তরাত্মায় যে পূর্বদেশের মরমিয়া-সহজিয়া ভাবপ্রবণতা রয়েছে, সেটাকেও তিনি লুকিয়ে না রেখে উন্মোচিত করেছেন।

‘ভরসানামা’ ৪০টি গানের সংকলন, যেগুলো উৎসর্গ করা হয়েছে রুমি, সাদি, হাফিয ও খৈয়ামকে। ফলে গানগুলোর প্রবণতা যে উচ্চাঙ্গের সুফিতত্ত্বমূলক, সে কথাটি আর খুলে বলতে হয় না। উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, গানগুলোতে অনেকেই সুর দিয়েছেন। মহীবুল আজিজ শর্ত দিয়েছেন যে, “বাকি গানগুলোও যে কেউ সুর করতে পারবে, তবে প্রকাশের আগে রচয়িতার অনুমতি লাগবে এবং গানের স্বরলিপি লিপিবদ্ধ করতে হবে। রচয়িতার অবর্তমানে কেউ গানগুলোতে সুরারোপ করতে চাইলে তাকে অবশ্যই লোকসুরের অনুসারী হতে হবে এবং গানের স্বরলিপি সংরক্ষণ করতে হবে। ”  

‘ভরসানামা’র গানগুলোতে কি বলতে চেয়েছেন মহীবুল আজিজ? উদাহরণ দেওয়া যাক: ‘দিন কাটল পরশ পাথর খুঁজে/রাত্রি গেল দু‘টি চক্ষু বুঁজে/তবু আমার শূন্য রইল হাত/হায়, আমার জীবন দেখল না প্রভাত। ’

আরও কয়েকটি উদাহরণ: ১. ‘ধৈয্য ধইরা বরফ হাতে রাখো/গললে বরফ ঠাণ্ডা থাকে নাকো। ’ ২. ‘জ্ঞানের সাগর সাঁতরাইলাম এক অধম অজ্ঞানী/তবু আমি জ্ঞানের এক কণা না জানি। ’ ৩. ‘খুলতে খুলতে জীবন গেল ফুরসত পাইলাম না/একটা খুললে আরেকটা আসে আলো দেখলাম না/আঁধার শুধু আঁধার রইয়া যায়/দেহ শুধু বন্ধ হইয়া যায়। ’ ৪. ‘মানুষ মরে, মানুষ মারে ফন্দি-ফিকিরে/আমার জীবন চইল্যা যায় ফতুর জিকিরে। ’ ৫. ‘একজনে কয়, আমায় দিব তাজমহল/আরেকজনে গছায়া দেয় রূপমহল। ’

গানগুলো ছোট ছোট কাঠামোতে বায়েত বা গজলের আবেশে ভরপুর। লোকজ শব্দ ও অনুসঙ্গ যুৎসই প্রয়োগে ঠাসা। চর্যাপদের প্রাচীন প্রজ্ঞান যেমনভাবে সহজিয়া কবিরা প্রকাশ করেছিলেন রূপকের হাত ধরে আলো-আঁধারময় রহস্যঘেরা সান্ধ্যভাষায়, এই গানগুলোতে আকারে-ইঙ্গিতে নানা দার্শনিকোচিত উক্তি করা হয়েছে। উক্তিগুলো ভাব ও বোধের অতল থেকে ছেনে আনা এবং অধ্যাত্মবাদের জারক রসে সিক্ত।

চট করে পাঠ করলে বা গান হিসাবে শুনলে মনে হবে বাণী ও কথাগুলো বলছেন বাংলার চিরায়ত প্রান্তর ছোঁয়া কোনও দেহতত্ত্বের সাধক, আউল কিংবা বাউল।   জিন্স, সানগ্লাস, টি-শার্ট গায়ে ব্রাজিলিয়ান শুদ্ধতম কফি পেয়ালা হাতে মহীবুল আজিজের মতো একজন বৈশ্বিক নাগরিক যখন এমত উচ্চারণ করেন, তখন পাঠকের চোখ এক্স-রে হয়ে তাঁর বুকের গভীরে চলে যায়; খুঁজে অতলান্ত জীবন-জিজ্ঞাসায় পূর্ণ একটি অদেখা সরোবর। তাঁর ঘনিষ্ঠ জীবন সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে নিবিড়ে জড়িয়ে রেখেছে পদার্থ বিজ্ঞানকে। তবে কি তাঁর অন্তর্গত সত্তার সুগভীর স্তরে লুক্কায়িত মানবিকতা ও বিজ্ঞানের সম্মিলনে একটি সুপ্ত অগ্নিগিরি অবশেষে জাগ্রত হয়েছে?

এই কথার উত্তর এক কথায় দেওয়া যাবে না, জানি। গবেষণার সন্দর্ভে কিংবা বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতেও অনুভূতির উচ্চতর আবেগ, অভিব্যক্তি ও ব্যঞ্জনাকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। জাগতিক কোন কাজি নন, লোকায়ত মানবমণ্ডলী ও শ্বাশত নিসর্গ আর প্রকৃতিই হয়ত ভাবীকালে ভালোবেসে জানিয়ে দেবে সেই কাঙ্খিত উত্তর। এবং কাল-কালান্তর উন্মুক্ত করে দেবে অন্য এক মহীবুল আজিজের মরমী জগতের রূপ-অপরূপ আলোকচ্ছটা।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। অধাপক, চট্টগাম বিশ্ববিদ্যালয়।     

বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।