ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রকৃতি-পাগল সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ | নীল রফিক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৭
প্রকৃতি-পাগল সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ | নীল রফিক নিবন্ধ ~ শিল্প-সাহিত্য

সাধারণ কাহিনীকে অসাধারণ শিল্পকুশলতায় পাঠককে মুগ্ধ করার ক্ষমতা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আগমন ঘটেছিল 'বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি পাঠককে কাহিনী বলেননি, কাহিনী দেখিয়েছেন। অর্থাৎ তার রচনার বর্ণনাভঙ্গি পাঠককে এতোটাই মুগ্ধ করে যে, পাঠক মনের আয়নায় সেই বর্ণনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। 

২০১৩ সালে বিভূতিভূষণের 'অপুর সংসার' গল্পটি পড়ার পর সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্রটিও দেখি। সত্যজিতের অসাধারণ নির্মাণে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম অপুর প্রতি যে, ওই রাতেই 'পথের পাঁচালী' (১৯২৫-১৯২৮) উপন্যাসটি পড়েছিলাম।

১৯২৫ সালে উপন্যাসটির রচনা শুরু করেন এবং ১৯২৮ সালে শেষ করেন। তিন বছরে তিন পরিচ্ছেদ লিখেছেন কিনা জানি না তবে উপন্যাসের তিনটি পরিচ্ছেদ জীবনের তিনটি অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে।  

যাহোক, 'পথের পাঁচালী' লেখকের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলে আমার মত। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেন। তিনি ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার মুরারিপুর গ্রামের মাতুলালয়ে জন্ম নেন। ১৯৫০ সালের ০১ সেপ্টেম্বর ব্যারাকপুরের ঘাটশিলায় অন্যলোকে পাড়ি জমান। ছাপ্পান্ন বছরের জীবনে আঠাশ বছর সাহিত্য রচনা করেন। অপুর সংসার গল্পটি পড়ার পরই তার রচনার প্রতি যে টান অনুভব করি তা অপু চরিত্রের জন্যই। অপু চরিত্রটিকে আমার নিজের প্রতিচ্ছবি মনে হয়েছে। শুধু আমার কেন? আমার মতো হাজারও গ্রাম্য কিশোরের প্রতিচ্ছবি এই অপু। অপুর কল্পনাপ্রবণ মানসিকতা যেনো প্রতিটি পল্লী কিশোরের কল্পনা। অপু যখন লাঠি নিয়ে একা একা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে, মনে হয় এটা যেনো আমিই। ট্রেন দেখার জন্য বাবার কাছে অপুর যে আবদার; তেমনি কল্পনা মিশে রয়েছে প্রতিটা পল্লী বালকের মনে।  

বিভূতিভূষণ এতোটাই গভীর মমতা দিয়ে তার চরিত্রগুলো এঁকেছেন যা সব পাঠককে চুম্বকের মতো টানে এবং মুগ্ধ করে, তৃপ্ত করে। তিনি যেভাবে পথের পাঁচালীতে ইন্দুরণ ঠাকুরণ চরিত্র দিয়ে অতীতের অবসান ঘটিয়ে দূর্গা-অপুকে দিয়ে বর্তমানের ক্রমব্যাপ্তি এবং অপুকে দিয়ে অজানা ভবিষ্যতের ইঙ্গিত করে, চরিত্রের বৈচিত্রপূর্ণ যে ব্যাপ্তি দেখিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে কেন বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল। আর তাইতো তার রচনার সবচেয়ে আকর্ষিক দিক বৈচিত্রপূর্ণ চরিত্রের অসাধারণ ব্যাপ্তি আর ভাষাগত মাধুর্যতা। পথের পাঁচালীর যে অপু সহজ-সরল বালক, সেই অপুই শহুরে পরিবেশে মিশে যাওয়া যুবক, যে কিনা বাসা ভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে তর্কও করে। গ্রামের কল্পনাপ্রবণ বালকটি ধীরে ধীরে বড় হয়ে পরিবেশের সঙ্গে যেভাবে খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয়, তেমনি করে বাঙালি গ্রাম্য ছেলের জীবনকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন বিভূতিভূষণ।

অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে 'প্রকৃতি-পাগল সাহিত্যিক' বলে আখ্যায়িত করেছেন। কথাটি যথার্থই বলেছেন তিনি। বিভূতিভূষণ তার উপন্যাসের শরীরের প্রতিটা পশমের গোড়ায় প্রকৃতি নিবিড় ভালোবাসার ছোঁয়া লাগিয়ে, মমতা মাখিয়ে এতোটাই মায়াময়ী রূপ দিয়েছেন যে, প্রকৃতি আর বিভূতিভূষণ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তার ছোটবেলা দরিদ্রতার মধ্যে কেটেছে। জীবন বাস্তবতার এই ছাপটা ঔপন্যাসিক অপু চরিত্রের মধ্য দিয়ে 'পথের পাঁচালী'তে এঁকেছেন। তাই তো জীবন ঘনিষ্ঠ এই আবেগটুকু পাঠকের মনে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়। 'পথের পাঁচালী'কে তাই একদিকে যেমন জীবনের পাঁচালীও বলা যায়, তেমনি অপুর পাঁচালীও বলা যায়।
 
'পথের পাঁচালী' শুধুমাত্র একটি উপন্যাস হয়েই থাকেনি, এরমধ্যে রয়েছে বিভূতিভূষণের পল্লী-প্রীতি ও নৈসর্গিক চেতনা। 'পথের পাঁচালী'তে শেখার কিছু নেই। কিন্তু অনেক কিছু দেখার আছে। এ সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের উক্তি বলা যেতে পারে। 'পথের পাঁচালী' সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এই বইখানিতে পেয়েছি যথার্থ গল্পের স্বাদ। এর থেকে শেখা হয়নি কিছুই। দেখা হয়েছে অনেক যা পূর্বে এমন করে দেখিনি’।

দেখা যাবেই বা না কেন! বিভূতিভূষণ পল্লী প্রকৃতির নিসর্গ জীবন তুলে ধরেছেন, ভাষা মাধুর্যের মধ্য দিয়ে মানব জীবনের অন্তর্লীন সত্তার সঙ্গে। তার 'পথের পাঁচালী' যেনো প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ গায়ে মেখে বেড়ে ওঠা 'অপু' বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রের একটি। অপুর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় নিজ শৈশব আর কৈশোরের যাবতীয় বাস্তবিক স্বাদ। অপুর মধ্য দিয়ে যেমন গ্রাম্য কিশোরের স্মৃতি জাবর কাটা যায় তেমনি দূর্গাকে দিয়ে গ্রাম্য বালিকার বাস্তবিক স্মৃতি মেলে।

এ দুটি চরিত্র দিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আজীবন বাংলা সাহিত্যে বেঁচে থাকবেন। তিনি ছিলেন গ্রামীণ পটভূমির সার্থক শিল্পী। 'পথের পাঁচালী' নামক যে চিত্র তিনি এঁকেছেন তা আমাদের গল্প শুনিয়ে, বুঝিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কত মমতায় জড়ানো আমাদের জীবন!
 
বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার শিল্পকৌশলতা স্বতন্ত্র এবং সময় অতিক্রান্ত। তাই ১২ সেপ্টেম্বর তার ১২৩তম জন্মবার্ষিকীতে গভীর ভাবে মনে পড়ে। গ্রাম-লালিত এই কথাশিল্পীর প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।
 
বাংলাদেশ সময়:  ০৯৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।