ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের দিনগুলোতে কবিগুরু

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১৭
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের দিনগুলোতে কবিগুরু জীবনের অন্তিমলগ্নে রবীন্দ্রনাথ

২২শে শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। ৭৬ বছর আগে এই দিনটিতেই কবিগুরু আমাদের ছেড়ে চলে যান। কবি তার হাজারো সৃষ্টির মহিমায় বাংলা সাহিত্যকে করে গেছেন মহিমান্বিত। প্রকৃতিতে প্রতি বছর ফিরে আসা শ্রাবণের মতো পুনঃপুন উচ্চারিত হয় তার কবিতা। সুরের ধারার মতো বর্ষিত হয় তার গান। কবিগুরুর গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস বারবার আলোচিত হয় নাটক চলচ্চিত্র সহ নানাবিধ অনুষ্ঠানে। তিনি যে বিশ^কবি। বাঙালির হিয়ার মাঝে তিনি অম্লান। তার সৃষ্টি মিশে গেছে বাঙালির নিত্যদিনের জীবন-চর্চায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বহুমুখী রচনার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধের বিভিন্ন দিক জাতীয় জীবন থেকে সমাজজীবন পর্যন্ত একই সূত্রে গ্রথিত করেছেন। কবি প্রতিভার যত রকম বিকাশ ঘটানো সম্ভব তা তিনি করেছেন তার অনবদ্য রচনার মাধ্যমে।

শ্রাবণের বহুমাত্রিক রূপ ধরা পড়েছে কবির অসংখ্য কবিতা ও গানে। আর এই শ্রাবণেই প্রকৃতি বিদায় দেয় তাকে। যদিও সেদিন আকাশে ছিল না মেঘের ঘনঘটা। মর্ত্যরে অন্তিম প্রীতিরসে, জীবনের চরম-প্রসাদ ও মানুষের শেষ আশীর্বাদ নিয়ে, কবি চলে গেছেন অনন্তলোকে, বেঁচে আছে তার সৃষ্টি। কেমন ছিল কবিগুরুর অন্তিম দিনগুলো?

১৯৪১ সালে জীবনের শেষ দিনগুলোয় অসুখে ভুগেছিলেন কবি। সমগ্র জীবন চিকিৎসকের কাঁচি থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছিলেন, এ যাত্রায় বুঝি আর সম্ভব হলো না। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি চলছেই। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কবি তখন শান্তিনিকেতনে, এরই মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ বেশ কিছু গল্প লিখেছিলেন। সেগুলি পড়ে দারুণ আনন্দ পেয়েছিলেন কবি। বলেছিলেন আরও লিখতে। অবনঠাকুর রানী চন্দকে গল্প বলে যান, রানী চন্দ সে গল্প শুনে লিখে ফেলেন। তারই কিছু আবার দেওয়া হলো রবীন্দ্রনাথকে। কবি পড়লেন, হাসলেন, কাঁদলেন। রানী চন্দ এই প্রথম এমন করে রবিঠাকুরের চোখ থেকে জল পড়তে দেখলেন।

রানী চন্দ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ভাজন, শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী ও চিত্রশিল্পী এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের স্ত্রী। চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের কথাই বললেন কিন্তু কবিগুরুর এতে মত নেই।

তিনি বললেন, ‘মানুষকে তো মরতেই হবে একদিন। একভাবে না একভাবে এই শরীরের শেষ হতে হবে তো, তা এমনি করেই হোক না শেষ। মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছেঁড়ি করার কী প্রয়োজন? কিন্তু যে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন তিনি, তার উপশমের জন্য অস্ত্রোপচার করতেই হবে এই হলো চিকিৎসকের মতো। আর সেটা করতে হলে শান্তিনিকেতনকে বিদায় জানিয়ে চলে আসতে হবে কলকাতায়। তাই শেষবারের মতো শান্তি নিকেতন ছাড়লেন কবিগুরু।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এ ঘরেই কবির মৃত্যু হয়২৫ জুলাই বেলা তিনটা পনেরো মিনিটে রবীন্দ্রনাথ এলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। খবরটা গোপন রাখায় স্টেশন কিংবা বাড়িতে ভিড় ছিল না। পুরনো বাড়ির দোতলায় ‘পাথরের ঘর’-এ তিনি উঠলেন। স্ট্রেচারে করে দোতলায় নিতে হলো তাকে। ২৬ জুলাই কবিগুরু ছিলেন প্রফুল্ল। ৮০ বছরের খুড়ো রবীন্দ্রনাথ আর ৭০ বছর বয়সী ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ অতীত দিনের নানা কথা স্মরণ করে হাসলেন প্রাণখুলে।

২৭ জুলাই সকালে রবীন্দ্রনাথ মুখে মুখে বললেন একটি কবিতা, টুকে নিলেন রানী চন্দ। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তি হলো : ‘প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্তার নতুন আবির্ভাবে, কে তুমি, মেলেনি উত্তর। ’ ৩০ জুলাই ঠিক হয়েছিল তার দেহে অস্ত্রোপচার হবে। কিন্তু সেটা তাঁকে জানতে দেওয়া হয়নি। তিনি ছেলে রথীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কবে অপারেশন হবে?’ রথীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কাল-পরশু’। আবার রানী চন্দকে ডাকলেন কবি, লিখতে বললেন: ‘তোমার সষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী। ’ ডা. ললিত এলেন একটু পরে। বললেন, ‘আজকের দিনটা ভালো আছে। আজই সেরে ফেলি, কী বলেন? হকচকিয়ে গেলেন কবি। বললেন, আজই!’ তারপর বললেন, ‘তা ভালো। এ রকম হঠাৎ হয়ে যাওয়াই ভালো। ’ (গুরুদেব, রানী চন্দ)

বেলা ১১টায় স্ট্রেচারে করে অপারেশন টেবিলে আনা হলো কবিগুরুকে। লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অপারেশন করা হচ্ছে। ১১টা ২০ মিনিটের দিকে শেষ হলো অস্ত্রোপচার। ভারী আবহাওয়া উড়িয়ে দেওয়ার জন্য কবি রসিকতা করলেন, ‘খুব মজা, না?’ শরীরে যথেষ্ট যন্ত্রণা হয়েছিল অপারেশনের সময়। কিন্তু তা বুঝতে দেননি কবি। সেদিন ঘুমালেন।

পরদিন ৩১ জুলাই যন্ত্রণা বাড়ল। গায়ের তাপ বাড়ছে। নিঃসাড় হয়ে আছেন কবিগুরু। ১ আগস্ট কথা বলছেন না কবি। অল্প অল্প পানি আর ফলের রস খাওয়ানো হচ্ছে তাকে। চিকিৎসকেরা শঙ্কিত। ২ আগস্ট কিছু খেতে চাইলেন না, কিন্তু বললেন, ‘আহ! আমাকে জ্বালাসনে তোরা। ’ তাতেই যেন সবাই খুশি। ৩ আগস্টও যথারীতি শরীরের কোনো উন্নতি নেই। ৪ আগস্ট সকালে ৪ আউন্সের মতো কফি খেলেন। জ¦র বাড়ল। ৫ আগস্ট ডা. নীলরতন বিধান রায়কে নিয়ে এলেন। রাতে স্যালাইন দেওয়া হলো কবিকে। অক্সিজেন আনিয়ে রাখা হলো। ৬ আগস্ট বাড়িতে উৎসুক মানুষের ভিড়। হিক্কা উঠছিল কবির। পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ডাকছিলেন, ‘বাবা মশায়’! একটু সাড়া দিলেন কবিগুরু। রাত ১২টার দিকে আরও অবনতি হলো কবিগুরুর।

৭ আগস্ট ছিল ২২শে শ্রাবণ। কবিকে সকাল নয়টার দিকে অক্সিজেন দেওয়া হলো। নিশ্বাস ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকল কবির। কানের কাছে পড়া হচ্ছিল তার জীবনের বীজমন্ত্র ‘শান্তম্, শিবম্, অদ্বৈতম’। খুলে দেওয়া হলো অক্সিজেনের নল। ধীরে ধীরে কমে এলো পায়ের উষ্ণতা, তারপর একসময়ে থেমে গেল হৃদয়ের স্পন্দন। ঘড়িতে তখন বাজে দুপুর ১২টা ১০ মিনিট। জনারণ্যে পরিণত হয়েছে তখন ঠাকুরবাড়ি। কবিকে বেনারসি-জোড় পরানো হলো। কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, চাদর, কপালে চন্দন, গলায় মালা দিয়ে সাজানো হলো। রানী চন্দ কবির বুকের ওপরে রাখা হাতে ধরিয়ে দিলেন পদ্মকোরক। কবি চললেন চিরবিদায়ের পথে। সাহিত্যিক ও বিশ^ভারতীর গ্রন্থনবিভাগের অধ্যক্ষ রামকুমার মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছিলেন কবি নিজে এইভাবে নিজের শেষটা চাননি। তার ইচ্ছা ছিল, ‘কোনো জয়ধ্বনি ছাড়া সাধারণভাবে শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির কোলেই তিনি যেন মিশে যেতে পারেন। তার শেষ ইচ্ছাটা আর রাখা যায়নি। ’

প্রয়াণ দিবসে বিশ্বকবি, আপনার প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।