ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর আবৃত্তি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৬ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৭
জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর আবৃত্তি কবি জীবনানন্দের হস্তাক্ষর সম্বলিত প্রতিকৃতির কোলাজ

সুবিখ্যাত সিগনেট প্রেসের কর্ণধার ছিলেন দিলীপ কুমার গুপ্ত। সংক্ষেপে তাঁকে সবাই ডাকতো ডি,কে বলে। ডি,কে যখন ছাত্র, তখন তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু এবং অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের মতো বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির দু’জন সাহিত্যিক। বুদ্ধদেব বসুর কোলকাতার জীবন শুরু হয়েছিলো ডি, কে-কে পড়ানোর মধ্যে দিয়ে। এ রকম দু’জন অসামান্য সাহিত্যিকের সাহচর্যে আসার কারণে এবং তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভের সুযোগে সাহিত্য বিষয়ে ডি,কে-র রুচি চলে গিয়েছিলো খুবই উঁচু পর্যায়ে।

ডি, কে-র সাথে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সুনীল যখন তরুণ সেই সময়টাতে এই সম্পর্কের সূত্রপাত হয়।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন কৃত্তিবাস পত্রিকা চালান। এই সূত্রে প্রাথমিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তবে আসল সম্পর্ক তৈরি হয় মূলত থিয়েটারকে কেন্দ্র করে। ডি, কে একটা সৌখিন থিয়েটারের দল খুলেছিলেন। এই দলের সেক্রেটারি ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

দিলীপকুমার গুপ্তের মালিকানাধীন সিগনেট প্রেসেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জীবনানন্দ দাশকে প্রথমবার দেখেন। একবার নয়, বেশ কয়েকবার দেখেছেন তিনি তাঁকে। কিন্তু, কথা বলার সাহস পাননি কখনো। সুনীল তখন অখ্যাত একজন তরুণ, আর জীবনানন্দ দাশ মধ্য বয়সের খ্যাতিমান কবি। যদিও সেই খ্যাতি বিস্তৃত নয় সাধারণ মানুষের মাঝে। সাহিত্যরসিক যাঁরা, তাঁরা শুধু জানেন জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা। তারপরেও, এই বাধাই জীবনানন্দ দাশের সাথে কথা বলার সাহস দেয়নি তরুণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে।

সিগনেট প্রেসে জীবনানন্দ দাশের আসার মূল কারণ হচ্ছেন ডি, কে। বুদ্ধদেব বসু তখন ‘কবিতা’নামের একটা পত্রিকা বের করতেন। নামেই শুধু কবিতা না, এই পত্রিকাটা পুরোপুরিই ছিলো কবিতা বিষয়ক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি সমসাময়িক কবিদের উৎসাহ দিয়ে যেতেন ক্রমাগত। শুধু‘কবিতা’পত্রিকায় কবিতা ছাপিয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকতেন না, বাছাই করা কয়েকজন কবির কবিতা নিয়ে কিছু কিছু কবিতার বইও প্রকাশ করতেন। মাত্র ষোল পৃষ্ঠার চটি বই হতো সেগুলো। দাম ছিল মাত্র চার আনা বা ষোল পয়সা। অর্থাৎ বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠার দাম মাত্র এক পয়সা। এই এক পৃষ্ঠার দাম এক পয়সা হবার কারণে এই সিরিজটির নাম হয়ে গিয়েছিল ‘এক পয়সায় একটি’। এই এক পয়সার সিরিজ থেকেই বের হয়েছিল জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’। বইতে মাত্র বারোটি কবিতা ছিল। ছাপা, বাঁধাই কোনো কিছুই ভালো ছিল না। সস্তা জিনিসের যা দশা হয়, সেই রকম জীর্ণ দশাতেই বের হয়েছিল বনলতা সেন। ডি,কে এই বইটাকে খুঁজে বের করলেন। এর সঙ্গে আরও আঠারোটি কবিতা যোগ করলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়কে দিয়ে এর প্রচ্ছদ করালেন। তারপর অসাধারণ মুদ্রণ সৌকর্য দিয়ে প্রকাশ করলেন ঝকঝকে-তকতকে এক ‘বনলতা সেন’। নতুন সংস্করণে ‘বনলতা সেন’দেখে জীবনানন্দ খুবই খুশি হয়েছিলেন। শুধু প্রচ্ছদে বনলতা সেনের যে ছবি দেওয়া হয়েছিল, সেটা নিয়ে সামান্য কিছুটা অখুশি ছিলেন তিনি। মন্তব্য করেছিলেন যে, রাজকুমারী অমৃতা করের মতন দেখতে হয়ে গেছে। রাজকুমারি অমৃতা কর সেই সময় ভারত সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, নিজের স্বাস্থ্য খুবই খারাপ ছিল ভদ্রমহিলার। একেবারেই রোগা পাতলা ছিলেন তিনি। আজকের যুগের জিরো ফিগারের মতো। এই জিরো ফিগার এখন সৌন্দর্য হিসাবে দারুণ চলে, কিন্তু সেকালে এটা অচল ছিল।

এই ডি, কে একবার বিশাল এক কবি সম্মেলনের আয়োজন করলেন। এই আয়োজন হয়েছিল ১৯৫৪ সালের ২৮ এবং ২৯ শে জানুয়ারিতে। যদিও কবি সম্মেলনের আহবায়ক ছিলেন নীহাররঞ্জন রায় ও আবু সয়ীদ আইয়ুব, কিন্তু প্রধান উদ্যোক্তা এবং সবকিছুর দায়িত্বে আসলে ছিলেন ডি,কে। সব পরিকল্পনা তাঁর। খরচপাতিও সব তিনিই যুগিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’পত্রিকাকে তখন কবির মানদণ্ড হিসাবে বিবেচিত হতো। এতে যাঁরা কবিতা লিখেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে তালিকা করে কবিদের আমন্ত্রণ জানানো হলো সে কবি সম্মেলনে কবিতা পড়ার জন্য। এই তালিকার শীর্ষ নামটা ছিল জীবনানন্দ দাশের।

এই সম্মেলন হয়েছিল সুবিশাল সিনেট হলে। মাইকের সামনে কীভাবে কবিতা পড়তে হয়, তার রিহার্সেল ডি,কে অনেক কবিকে দিয়েই করিয়েছিলেন সম্মেলনের দুই একদিন আগে। এমনই যত্ন ছিলো তাঁর অনুষ্ঠানটার প্রতি। জীবনানন্দ দাশ অবশ্য সেই রিহার্সেলে ছিলেন না। তিনি রিহার্সেল ছাড়াই মঞ্চে উঠে কবিতা পাঠ করেছিলেন। এখানেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম তাঁর আবৃত্তি শোনেন। তিনি তাঁর ‘আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার’ প্রবন্ধে লিখেছেন, "জীবনানন্দ রিহার্সাল দেননি। তাঁর পাঠ করার ভঙ্গিটি ছিল অদ্ভুত। হলে কয়েক হাজার দর্শক। তিনি তাদের দিকে একবারও তাকাননি। বইতে আবদ্ধ চোখ। যাঁর কবিতায় এত কমা, সেমিকোলন ও ড্যাশ, তিনি কিন্তু পাঠের সময় একটুও যতি দেন না, পড়েন অতি দ্রুত, যেন শেষ করার জন্য ব্যস্ত। শ্রোতাদের অনুরোধে তিনি সাত-আটটি কবিতা পড়েছিলেন। অনুরোধকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন উইংসের আড়ালে দাঁড়ানো দিলীপকুমার গুপ্ত স্বয়ং। "

জীবনানন্দ দাশের আবৃত্তি কেমন ছিল, কণ্ঠ কেমন ছিল, তার খুব একটা পরিষ্কার ধারণা এই বক্তব্য থেকে জানা যায় না। শুধু একটা তুলনা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় করেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে। তিনি লিখেছিলেন, "রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রধান পঞ্চকবির মধ্যে কবিতা সবচেয়ে ভাল পাঠ করতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। যেমন সুপুরুষ, তেমনই সুললিত কণ্ঠস্বর। একটু টেনে টেনে সুর করে পড়তেন, মোহিত করে দিতেন একেবারে। "

এই বক্তব্য থেকে এটুকু বোঝা গেল যে, জীবনানন্দের আবৃত্তি সুধীন্দ্রনাথের চেয়ে নিম্নমানের ছিল। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথই। রাজপুত্রের মতো দেখতে ছিলেন তিনি, ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান একজন দীর্ঘপুরুষ। তাঁকে ঘিরে থাকতো আভিজাত্য। হাজার লোকের মধ্যে তাঁকে আলাদা করে ফেলা যেতো নিমিষেই। তাঁর সাথে সাধারণ চেহারার, সাধারণ জীবন যাপন করা জীবনানন্দকে তুলনা করলে কিছুই বোঝা যাবে না।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জীবনানন্দ দাশের কণ্ঠস্বর কেমন ছিল সেটা না বললেও, জীবনানন্দ দাশের হাওড়া কলেজের এক ছাত্রী প্রীতি চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন যে, তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল সুগম্ভীর। প্রীতি লিখেছেন, "বিস্মিত হতাম তাঁর বক্তৃতা দেবার ক্ষমতায়, তাঁর সুগম্ভীর স্বর যখন সমস্ত ক্লাসের মাঝে ছড়িয়ে গিয়ে আবার তা প্রতিধ্বনিত হয়ে এক অপূর্ব রহস্যময় আবহাওয়ার সৃষ্টি করতো। "

আমাদের দেশে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষকের প্রতি কিছুটা পক্ষপাত থাকে। সেটাকে আমলে না আনলে প্রীতি চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি কথা ভালোই বলতে পারতেন। মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল বক্তৃতা দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি আবৃত্তি ভালো করবেন, এটাই ভাবা যেতে পারে এই বক্তব্যকে বস্তুনিষ্ঠ বলে হিসাবে নিলে।

হাওড়া কলেজে অধ্যাপনা করার সময়ে একবার ছাত্রীরা কলেজে ২২শে শ্রাবণ তারিখে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবার্ষিকীর সভা আয়োজন করে। সে সভায় এসে জীবনানন্দ দাশকে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কিছু বলতে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু তিনি ছাত্রীদের এই অনুরোধ এড়িয়ে যান। তখন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল নিজে তাঁকে এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। প্রিন্সিপ্যালের এই অনুরোধ ফেলার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তিনি সভায় যান। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু না বলে‘সঞ্চয়িতা’থেকে দুটো কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। এই আবৃত্তি বিষয়ে প্রীতি লিখেছেন, "তিনি রবীন্দ্রনাথের‘বলাকা’ ও ‘তপোভঙ্গ’এই দুটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। কি অনির্বচনীয় সে আবৃত্তি, হৃদয়ের সমস্ত মাধুর্য তিনি ঢেলে দিলেন আবৃত্তির মাঝে। ...মরমী কবি ছাড়া আর কেউ পারবে না এমন করে সুধা ছানিয়া নিতে আর সেই সুধা দিতে। "

প্রীতি নামের এই ছাত্রীটির তাঁর শিক্ষক জীবনানন্দ দাশের প্রতি প্রীতি-ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা একটু বেশি ছিল বলেই মনে হয়। হয়তো জীবনানন্দ দাশের খুব প্রিয় ছাত্রী ছিলেন তিনি। সেই স্নেহের প্রতিদানই মনে হয় এই সব দয়ার্দ্র কথাবার্তা।

প্রীতি চট্টোপাধ্যায় অতিরঞ্জন করুক বা না করুক, হাওড়া কলেজের ছাত্রীদের মাঝে জীবনানন্দের আবৃত্তি যে জনপ্রিয় ছিল বা আবৃত্তিকার হিসাবে তাঁকে তারা গুরুত্ব দিত, সেটা জানা যায় জীবনানন্দ দাশের সহকর্মী অজিতকুমার ঘোষের কাছ থেকে। ছাত্রীরা তাঁর কাছে কবিতা আবৃত্তি দেখিয়ে দেবার জন্য আসতো। নীচের এই কাহিনি তাঁরই বয়ান করা।

“একদিন অবসর সময়ে প্রফেসার্স রুমে জীবনানন্দবাবু ও আমি পাশাপাশি বসে আছি। এমন সময় দেখি-কলেজের চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীর জনকয়েক ছাত্রী ঘরে ঢুকে জীবনানন্দবাবুর কাছে এসে দাঁড়াল। তাঁদের মধ্যে একজন জীবনানন্দবাবুকে বললে- স্যার, বনলতা সেন কবিতাটি একবার আবৃত্তি করে আমাকে দেখিয়ে দেবেন, কেমন করে আবৃত্তি করব?

দেখলাম, হঠাৎ একটি ছাত্রীর মুখে এই ধরনের কথা শুনে জীবনানন্দবাবু একটু বিস্মিত হয়ে গেলেন। তারপর ছাত্রীটিকে কিছু না বলে সসংকোচে আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমি জীবনানন্দবাবুকে বললাম- আবৃত্তি করে দেখিয়ে দিন না!

তিনি বললেন- আপনি বলেন কি! অধ্যাপক, অধ্যাপিকারা কি ভাববেন? তাছাড়া বাইরেও ছাত্রীরা কেউ শুনে ফেললে কি ভাববে?

-- কি আর ভাববে! কবি অনুরোধে পড়ে নিজের কবিতা আবৃত্তি করে দেখাচ্ছেন; এতে কার কি ভাববার আছে!

-- না, তা কখনও হতে পারে না, অসম্ভব।

-- তবে এক কাজ করুন, কলেজের গেটের ধারে সেই ফাঁকা ঘরটায় ওদের নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে আবৃত্তি করে ওদের শিখিয়ে দিয়ে আসুন।

আমার এই কথায় এবং ছাত্রীদের অনুরোধে জীবনানন্দবাবু শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে রাজি হলেন। তখন তিনি সসংকোচেই ছাত্রীদের নিয়ে সেই ঘরটায় গেলেন।

খানিক পরে ফিরে এসে বললেন - কবিতা না হয় কিছু লিখতেই পারি, তাই বলে আবার আবৃত্তিও করে দেখানো, এই সব কি পোষায় মশায়। যাক কোনো রকমে দেখিয়ে দিয়ে এসেছি। এখন বাঁচলাম। ”

শনিবারের চিঠি পত্রিকার সম্পাদক সজনীকান্ত দাস দীর্ঘকাল ধরে জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে তাঁকে আক্রমণ করে এসেছেন। সেই আক্রমণ শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যেতো প্রায়শই। জীবনানন্দ দাশের নাম লিখলেও ব্রাকেটে তিনি ব্যঙ্গ করে জীবানন্দ নহে বা জিহ্বানন্দ নহে লিখে দিতেন। সেই তিনিও শেষের দিকে জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রশংসা করতেন। তিনি একবার জীবনানন্দকে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশ তাঁর ‘মানুষ জীবনানন্দ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, "একবার কোনও এক জায়গায় কবির স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির কথা ছিল। তাঁর সেদিন শরীরটা খুবই খারাপ ছিল। তিনি সজনীবাবুকে (সজনীকান্ত দাস) অনুরোধ জানালেন যে, তাঁকে যেন আবৃত্তির কাজটা প্রথম দিকেই সেরে নিতে দেওয়া হয়। সজনীবাবু চটে গিয়ে বললেন, -‘‘আপনি তো বেশ লোক মশাই! আপনাকে প্রথম দিকে আবৃত্তি করতে দিয়ে শেষে আমি চেয়ার বেঞ্চ নিয়ে বসে থাকি। ’’ শেষে হাসতে হাসতে বললেন-‘‘কিছু মনে করবেন না জীবনানন্দবাবু, আমি জানি যে, আপনার কবিতা শোনার পরে ছাত্রদলকে কিছুতেই আর আটকে রাখা যাবে না। সুতরাং আজ একটু কষ্ট করতেই হবে। "

লাবণ্য দাশের বরাতে সজনীকান্ত দাসের এই বক্তব্য থেকেও আসলে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না আবৃত্তির বিষয়ে। দর্শক হয়তো ভালো কবিতা হিসাবেই জীবনানন্দ দাশের কবিতা আগ্রহ নিয়ে শুনতো, তাঁর আবৃত্তি করার ভালো ক্ষমতার জন্য নয়।

তিনি আবৃত্তি ভালো করুন আর খারাপ করুন, এটা সত্যি যে তাঁকে প্রায়শই রেডিও থেকে ডাকিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো স্বরচিত কবিতা পাঠ করার জন্য। বহুবারই তিনি রেডিওতে কবিতা পাঠ করেছেন। এমনিতে নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন তিনি। সভা-সমিতিতে যেতে চাইতেন না। মঞ্চে উঠে বক্তৃতাও দিতে চাইতেন না তিনি। তবে, একেবারেই যে যেতেন না, তাও নয়। খুব বেশি অনুরুদ্ধ হলে বাধ্য হয়েই যেতেন। বিশেষ করে স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর হলে বেশ আগ্রহভরেই তিনি যেতেন।

তাঁর আবৃত্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করেছেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তাঁর ‘জীবনানন্দঃ জীবন ও কবিতার আলোচনা’বইতে লিখেছেন, "স্বরচিত হোক বা রবীন্দ্রনাথের কবিতাই হোক, তিনি কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন অতি চমৎকার। তাঁর উচ্চারণ ভঙ্গি ছিল যেমন নিখুঁত ও স্পষ্ট, তাঁর গলার স্বরও ছিল তেমনি ভারী ও মিষ্ট। আর তিনি নিজে পণ্ডিত ও কবি মানুষ ছিলেন বলে কবিতা পাঠে বা আবৃত্তিতে ছেদ বা বিরামের তারতম্য, ভাবাবেগের প্রয়োগ, স্বরের উত্থান-পতন অর্থাৎ স্বর কখন উচ্চগ্রামে উঠবে, কখন মধ্যগ্রামে থাকবে, আর কখন বা নিম্নগ্রামে নামবে- এ সবই তিনি ভালভাবে জানতেন। তাই তাঁর কবিতা আবৃত্তি একটা শুনবার মতো জিনিস ছিল। "

দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বক্তব্যের সাথে অবশ্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সিনেট হলে জীবনানন্দের কবিতা পাঠের বর্ণণার সাথে মেলে না। সুনীল উল্লেখই করেছেন যে, যতিচিহ্নকে উপেক্ষা করে বিরাম না দিয়ে দ্রুতগতিতে একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করে গিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ সেদিন।

সিনেট হলের সেই কবি সম্মেলন বিষয়েও দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা বক্তব্য পাওয়া যায়। সেখানেও তিনি উল্লেখ করেছেন যে, জীবনানন্দকে সেদিন দর্শকরা সাদরে বরণ করে নিয়েছিল। তাঁর ভাষায়, "১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৮শে ও ২৯শে জানুয়ারি কলকাতায় সিনেট হলে এক কবি সম্মেলন হয়েছিল। এর প্রথম দিনে স্বরচিত কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রিত হয়ে জীবনানন্দ সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি মনস্থ করেছিলেন- তাঁর বনলতা সেন কবিতার বই থেকে‘বনলতা সেন’ও অন্য আর একটি কবিতা পাঠ করবেন। তাই তিনি ঐ বইটি হাতে করেই সভায় গিয়েছিলেন।

সভায় যথা সময়ে তিনি তাঁর কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন। তাঁর কবিতা আবৃত্তি শুনে শ্রোতারা সকলেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি তাঁর স্থির করা কবিতা দুটি আবৃত্তি করে থামলে, শ্রোতাদের মধ্যে থেকে প্রচুর হাততালি এবং সমস্বরে তাঁদের মুহুর্মুহু ‘আর একটা কবিতা পড়েন’ ধ্বনি উত্থিত হ’ল।

‘বনলতা সেন’হাতে দণ্ডায়মান জীবনানন্দ শ্রোতাদের অনুরোধে আবার একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। শেষ হ’লে আবার সেই হাততালি ও সেই অনুরোধ। জীবনানন্দকে সেদিন শ্রোতাদের এইরূপ বারবার অনুরোধে অন্তত ৫/৬টি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতে হয়েছিল। "

জীবনানন্দ দাশ কেমন মানের আবৃত্তিকার ছিলেন, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসাটা আসলেই কষ্টকর। তাঁর অনেক আগে জন্ম নেওয়া এবং অনেক আগে পৃথিবীর মায়া কাটানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি বা গানের রেকর্ড আমাদের কাছে আছে। আছে নজরুলের নিজস্ব কণ্ঠের গান এবং কবিতা পাঠ, কিন্তু জীবনানন্দ দাশের নিজের কণ্ঠে কোনো আবৃত্তি পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলে আর পরের মুখে ঝোল খেতে হতো না আমাদের। আমরা নিজেরাই এই বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারতাম সহজেই।

# ফরিদ আহমেদ:কানাডা প্রবাসী লেখক

বাংলাদেশ সময়:...ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৭

জেএম

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।