ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বুদ্ধদেব বসু: সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিশীলতা | ফজলুল হক সৈকত

সমালোচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৫
বুদ্ধদেব বসু: সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিশীলতা | ফজলুল হক সৈকত

মানুষ কেন লেখে? কী লাভ হয় লিখে? পাঠকসমাজই বা কী পায় লেখা পড়ে?—এসব জিজ্ঞাসার চূড়ান্ত কোনো মীমাংসা যদিও হয়নি, তারপরও বলা যেতে পারে, চিন্তার কিছু খোরাক, মনের কিছু প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কোনো এক গলিপথে আলোর সন্ধান দিয়ে চলেছেন সাহিত্যসাধকরা—তাদের লেখার ভেতর দিয়ে। আর প্রতিভা, মনন এবং সৃজনশীলতার জোরে সাহিত্যের বাজারে টিকে থাকার প্রশ্নটা যেমন বারবার সামনে এসেছে, তেমনই পাশাপাশি এই কথাও কম ওঠে যে, কে বড় সাহিত্যিক? বাংলা সাহিত্যের কথাই যদি ধরি, কম লোক তো সাহিত্যচর্চা করেননি।

এখনো তো প্রচুর লোকে লিখছেন। কিন্তু সমকালের সীমানা পেরিয়ে উত্তরকালের প্রজন্মের কাছে কার কার লেখা পৌঁছেছে এবং পৌঁছুবে? অবশ্য উত্তরকালে যে লেখার মেসেজ পৌঁছুতেই হবে, তাও বোধ করি জরুরি কোনো প্রসঙ্গ নয়। সমকালেও তো লেখক প্রভাব বিস্তার করতে পারেন।


আমরা কিভাবে বিবেচনা করি লেখককে? তার চিন্তা ও প্রকাশের রীতি আমাদের কেন আকৃষ্ট করে? অথবা লেখক অন্য কোনো লেখক সম্বন্ধে কী ভাবেন—কী রকম মূল্যায়ন করেন তার সমকালের কিংবা পূর্ব ও উত্তরকালের সাহিত্যিককে? প্রসঙ্গত, এইসব ভাবনা বিবেচনায় রেখে, আমরা আজকে বুদ্ধদেব বসুর (জন্ম: ৩০ নভেম্বর ১৯০৮; মৃত্যু ১৮ মার্চ ১৯৭৪) উপন্যাস-ভাবনা এবং নজরুল বিষয়ে তার চিন্তা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।



উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার চিন্তাধারা বা মানসিকতাকে নয়, বুদ্ধদেব সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন চরিত্রের প্রকাশ-অসাধ্য অনুভূতিকে। সাহিত্যের শব্দ-বিন্যাসের যে জাদু, তা প্রয়োগ করে তিনি নায়ক-নায়িকার অনুভূতিকে প্রকাশের ভাষারূপ দিয়েছেন। আর এই কৌশলের জন্য তাকে ধার করতে হয়েছে ফরাসি কবি বোদলেয়ার-মালার্মে এবং পল ভ্যালেরির প্রকাশশৈলি। বুদ্ধদেব উপন্যাসে বিশেষ করে অনুভূতিশীল মানুষের বিচারশীল বুদ্ধিকে বিবেচ্য রেখেছেন



বুদ্ধদেব যখন লিখছেন, তখনকার বাঙালি তরুণসমাজের কাছে ‘হাঙরি জেনারেশন’, ‘অস্তিত্ববাদ’, ‘ফ্রয়েড’, ‘শ্লীলতা-অশ্লীলতা’—এসব প্রসঙ্গ অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠেছিল। এছাড়া প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে ‘লঘুভাষা’ বলে একটা কথাও বেশ প্রচলিত ছিল। আমরা জানি, লেখক যে-কালে লেখেন, পাঠকরা ওই কালের সামাজিক-নৈতিক প্রশ্ন এবং বিতর্কগুলোকে বিবেচনায় রাখেন। সমকালের দাবির প্রেক্ষিতেই বোধ হয় বুদ্ধদেব বসুর রচনায় বিশেষ করে উপন্যাসে আমরা পাই রোমান্টিক মনোভাব এবং বুদ্ধিধর্মিতা। অল্প বয়সে জনপ্রিয়তা লাভ, খ্যাতি প্রাপ্তি প্রভৃতি ঘটনা বুদ্ধদেবের সাহিত্য কিছুটা শিথিল করে তুলেছিল কিংবা তার কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির পথে খানিকটা হলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে সমকালে কেউ কেউ মনে করেছেন। ‘ট্যালেন্ট’ সাহিত্যিক বুদ্ধদেব শেষপর্যন্ত ‘জিনিয়াস’ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন কিনা, সে প্রশ্নও রয়েই গেছে। তবে তিনি তার কালে প্রতিনিধিত্বকারী সাহিত্যিক হতে পেরেছিলেন বটে। বুদ্ধিধর্মিতার সাথে শাণিত ব্যঙ্গ প্রয়োগে, নাগরিক-রোমান্টিকতার প্রখর সংবেদনশীলতায়, ইমপ্রেশনিস্টিক বা অনুভূতিব্যঞ্জক রচনারীতিতে, ভাষার আধুনিকীকরণে এবং সর্বোপরি যৌন-কেন্দ্রিক বিষয়বস্তুর অবতারণায় তিনি বিশিষ্ট। আর রাজনীতি ও সংস্কারবিমুখতা দেবের সাহিত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য।


উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার চিন্তাধারা বা মানসিকতাকে নয়, বুদ্ধদেব সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন চরিত্রের প্রকাশ-অসাধ্য অনুভূতিকে। সাহিত্যের শব্দ-বিন্যাসের যে জাদু, তা প্রয়োগ করে তিনি নায়ক-নায়িকার অনুভূতিকে প্রকাশের ভাষারূপ দিয়েছেন। আর এই কৌশলের জন্য তাকে ধার করতে হয়েছে ফরাসি কবি বোদলেয়ার-মালার্মে এবং পল ভ্যালেরির প্রকাশশৈলি। বুদ্ধদেব উপন্যাসে বিশেষ করে অনুভূতিশীল মানুষের বিচারশীল বুদ্ধিকে বিবেচ্য রেখেছেন। প্রসঙ্গত, দেবের ‘তিথিডোর’ উপন্যাস থেকে খানিকটা পাঠ নিচ্ছি: “ছুটির দিনের শাঁ শাঁ দুপুর বেলায় হঠাৎ মাঝে মাঝে কী এক আশ্চর্য ভালো-লাগা ছড়িয়ে পড়ে—সিনেমা বেড়ানো হৈ চৈ, আর কিছুতেই তো সে রকম হয় না—আর তাই যদি না হলো, যত ভালোই হোক, কিছুই কি ভালো? আকাশ গান করে তার কানে কানে, পৃথিবীটাই রেলগাড়ি, স্টেশন নেই, কেবল চলছে, দিনে রাত্রে কখনো থামে না গান। আমরা শুনি না, কেউ শোনে না, আমি শুনি শুধু, আর শুনি যদি, সব সময় শুনি না কেন?”

অন্য একটি উপন্যাসেও আমরা পাচ্ছি এরকম অনুভব আর বুদ্ধির সংমিশ্রণ: “সাগর দুই হাত বাড়াইয়া দিতেই সমস্ত আকাশ তাহার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল; তাহার শরীরে রাত্রির স্পর্শ, তাহার চেতনায় বিশ্বের চুম্বন; হাওয়ার উষ্ণতা তাহার রক্তে, তারার আবর্তন হৃদপিণ্ডে। ওই চুল তো আকাশের অন্ধকার, ওই শাদা শাড়ি তো ছায়াপথ—আর সে, সে-ই তো ওই আকাশ, এই রাত্রি, আর হাওয়ার এই অসম্ভব উদ্দামতা, চিত্ত তার রুদ্ধ, সত্তা লুপ্ত, অস্তহীন মুহূর্ত, চিরন্তন জীবন। এই উন্মাদ বিশ্ববিদারণ যাত্রার কি শেষ নাই, কখনো কি শেষ নাই, কোনোখানে সীমা নাই? কিন্তু শেষ আছে, সীমা আছে, আশ্রয় আছে হ্যারিসন রোডের ফুটপাথের পাথরে। ” (সাড়া)

বুদ্ধদেবের উপন্যাসে কাব্যধর্মিতা, নিটোল সৌন্দর্য-জগত রচনার চেষ্টা, বিষণ্ণতা, অনির্দেশ কামনা—এসব বিষয় পাঠককে আনন্দ দিয়েছে (এখনো যে দেয় না, তা বলছি না)। কিছুটা কৃত্রিমতা-প্রীতিও তার কথাসাহিত্যের বিষয় হয়ে উঠেছিল। কেননা, প্রেম এবং প্রেমজনিত বিকার দেবের উপন্যাসের মূল ভাবনা-পরিসর। প্রেমভাবনা প্রকাশে সম্ভবত তিনি ‘আউটডোর’-এর চেয়ে ‘ইনডোর’-এর দিকে বেশি মনোযোগ স্থাপন করেছিলেন। আর এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও তরুণ পাঠকের কাছে তার লেখা বিশেষভাবে আগ্রহের জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছিল।


অনেকেই জানেন, কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রতিভা বসু প্রসঙ্গ বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বুদ্ধদেবের স্ত্রী প্রতিভার গানের প্রশিক্ষক ছিলেন নজরুল। আর বসু দম্পতির পারিবারিক বন্ধুও বটে তিনি। তাই, নজরুলের সাথে ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং তার সাহিত্যিক অবস্থান বিষয়ে বুদ্ধদেবের দৃষ্টি সমকালে এবং উত্তরকালে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বুদ্ধদেব সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকাটির ১৩৫১ পৌষ সংখ্যা ছিল ‘নজরুল সংখ্যা’। নজরুলের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে বলতে যেমন কার্পণ্য করেননি দেব, তেমনই তার সাফল্য বিষয়েও ছিলেন সতর্ক। আবার নানানভাবে নজরুলের মূল্যায়নের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন আন্তরিক। ১৯২১ সালে নোয়াখালীতে অবস্থানকালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ে বুদ্ধদেব আলোড়িত হয়েছিলেন। নজরুলের দেশপ্রেমের চেতনা আর নবযুগের বন্দনায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। কাব্যিক কলাকৌশল, নির্মাণশৈলি, রোমান্টিক ভাবপ্রবণতা, ব্যক্তিসাতন্ত্র্য প্রভৃতি কারণে নজরুলকে গুরুত্ব দিতেন বুদ্ধদেব। আর বিশেষ করে নজরুলের রাজনৈতিক কবিতার চিরন্তনতা বিষয়ে তিনি ছিলেন একেবারেই নিঃসংশয়।

প্রসঙ্গত, নজরুলের প্রতি বুদ্ধদেবের অসীম শ্রদ্ধার কথা স্মরণে রেখে, ১৯৪২-এর পরে বিদ্রোহী কবির অসুস্থতার কালে ‘কবিতা’ পত্রিকার ‘নজরুল সংখ্যা’র সম্পাদকীয় থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি: “নজরুল আজ কিছুকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে, তাঁর সম্বন্ধে সাময়িক বিস্মৃতির পরদা তাই দ্রুত নেমে আসছে। যা ভালো তা কখনো লুপ্ত হয় না, কোনো-না-কোনো সময়ে তা দীপ্ততর হয়ে ফিরেই আসে, কিন্তু এখনকার মতো এই পরদা সরিয়ে রঙ্গমঞ্চের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা ভালো। নজরুল মহাকবি নন, কিন্তু সত্যিকার কবি; তার সম্বন্ধে চিন্তা করলে সাহিত্যের মূল্যবোধ সাধারণের মনে ফিরে আসতে পারে, এবং অনেক ক্ষণ-যশস্বীও উপকৃত হতে পারেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধুসূদনের পরে নজরুলেরই বোধ হয় সবচেয়ে নাটকীয় জীবন; উজ্জ্বল, উদ্দাম জীবন-নাট্যের মধ্যপথেই ট্রাজিডির ঘন অন্ধকারও মধুসূদনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নজরুলের ব্যক্তিত্ব বরাবরই চড়া রঙের, বিশেষভাবে পরিদৃশ্যমান। নজরুলের জীবন সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি—সব প্রকাশ করাও এখনো সম্ভব নয়—কিছু কিছু তথ্য এই সংখ্যার বিভিন্ন প্রবন্ধে পাওয়া যাবে। মনে হয় জীবনচরিতকারের পক্ষে নজরুল একটি অত্যন্ত লোভনীয় উপাদান। তাঁর জীবনে এত বৈচিত্র্য, এত ঘটনা, এত উত্থান-পতন যেটা সাধারণত বাঙালি কবির ভাগ্যে ঘটে না, এবং এই ঘটনাবলীর সুসজ্জিত নির্বাচনে একটি মনোরম গ্রন্থ লেখা হতে পারে। আশা করি কোনো একদিন সে-বই লেখা হবে। ”


কবি হিসেবে তিরিশোত্তর কাব্যধারায় অনন্য নাম বুদ্ধদেব বসু। ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে কবি ও কবিতার প্রতি বিরাট দায় স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন এই দাপুটে সাহিত্যিক। কথাসাহিত্য কিংবা প্রবন্ধে তার সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিশীলতা পাঠক-সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। নতুন কবিতা সৃষ্টিতে কিংবা কবিদের প্রতিভা ও গ্রহণযোগ্যতা মূল্যায়নেও বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। বুদ্ধদেবের মতো বহুমুখী প্রতিভার মানুষ বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি আসেনি। কেবল লিখেই নয়, লেখাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে এবং বিশেষত অনুদ্ঘাটিত বিষয়াদি অনুসন্ধান করে জনসমক্ষে প্রকাশ করার ব্যাপারে তার নিষ্ঠা আজও ঈর্ষণীয় এবং অবশ্য-অনুকরণীয়।



বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।