ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

জুলাই ৭১ | তানবীরা তালুকদার

মুক্তিযুদ্ধের গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
জুলাই ৭১ | তানবীরা তালুকদার

রাত বাজে মাত্র সাড়ে আটটা। বিকেলের আলো মরেছে বেশিক্ষণ হয় নি।



জুলাই মাসে সাড়ে আটটা তেমন কোনো রাত নয়। কিন্তু চারধার সুনশান, রাস্তায় ধরতে গেলে কোনো মানুষ নেই। ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো জ্বলছে কেমন মরে মরে, তাতে চারদিকে উজ্জ্বলতার বদলে এক বিষণ্ণতা মেখে আছে যেন, এ-বিষণ্ণতা জীবনানন্দের শীতের নয়, বোধহয় দান্তের ইনফার্নোর। কোন দূর প্রান্তর থেকে মাঝে মাঝে নরকের কুকুর ডেকে উঠে পরিবেশটা আরো ভৌতিক করে তুলছে। মাঝে মাঝেই মিলিটারির জিপ এই সুনশান নীরবতার কাচদেয়াল চৌচির করে দিয়ে শহরের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে।

খুব জরুরি প্রয়োজন না থাকলে আজকাল কেউ রাতে তো দূরের কথা, দিনেও বাড়ি থেকে বের হয় না। মকবুলের সেই উপায় নেই। বাঁধা চাকুরি নেই যে মাস গেলে মসৃণভাবে বেতনটা আসবে। ছোটখাট ব্যবসা করে পরিবার নিয়ে চলে। তার আয়ের ওপরে অনেকে নির্ভরশীল। মাল সাপ্লাই দিয়েছে সেই কবে, তারপর থেকে টাকার জন্যে ঘুরে যাচ্ছে। ব্যবসা মানেই বাকি।



খানসেনারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে, কী করবে তাদের সবাইকে নিয়ে। কেউ কেউ বলছে, গুলি করে মেরে ফেলে যেতে। কেউ বলছে এখানে না মেরে, অন্য কোথাও নিয়ে মারতে। কেউ বলছে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে। এই আলোচনা সবাই শুনতে পাচ্ছে। নিজেদের নিয়তির আলাপ শুনছে তারা, নিজেদের কানেই। শেষে সিদ্ধান্ত হলো, এই টানাটানির কোনো মানে হয় না, এখানেই গুলি করা হোক সবাইকে। কাল মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি এসে পরিষ্কার করে ফেলবে



আজ সন্ধ্যের দিকে যেতে বলেছিল দোকান মালিক, মন্দা চলছে এখন অকৃপণ, বেচাবিক্রি নেই তারপরও যা পারে দেবে। সেই সামান্য আদায়পত্র নিয়ে সে এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে, তার ফেরার অপেক্ষায় ঘরবার করবে তার মা, স্ত্রী। দেশের এই অবস্থায় ছেলে বাড়ি না-ফেরা পর্যন্ত আম্মা তসবিহ হাতে হাঁটতে থাকে, পানিও ছুঁয়ে দেখে না। মকবুল বাড়ি ফিরবে তারপর ওজু করে শুকরিয়া নামাজ আদায় করে বসবে, খাবে সেই বৃদ্ধ মমতাময়ী।

মকবুল সামনে আগাতেই দেখতে পেল, মিলিটারির দুটি জিপ থেমে আছে ক্রুদ্ধ ওঁৎ-পেতে থাকা দানবের মতো।

সাত আট জন খানসেনা হাতে বন্দুক নিয়ে কয়েকজন পথচারীকে আটকে তাদের ডান্ডি কার্ড পরীক্ষা করছে। কথা বলছে, ফাঁকে ফাঁকে বন্দুক দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে, তাদের মানিব্যাগ নিয়ে নিয়েছে, খুলে নিয়েছে হাতঘড়ি। দূর থেকে লক্ষ্য করেই মকবুলের সারা শরীর ভিজে গেলো ঠাণ্ডা ঘামে।

বেশ কয়েকবার এধরনের পরিস্থিতির শিকার সে হয়েছে এবং মায়ের অশেষ দোয়ার বরকতে জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছে। প্রতিবার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আম্মা আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে, মাথায় ফুঁ দিয়ে দেন। কিন্তু দোয়া যে সবসময় কাজ করবে এমন কোনো কথা নেই। মকবুল চেষ্টা করল তার উপস্থিতি অন্যকে জানতে না দিয়ে নিঃশব্দে সেখান থেকে দ্রুত সরে যেতে। তাড়াতাড়ি পাশের অন্ধকার গলিতে ঢুকে অন্ধকারে মিশে যেতে চাইল সে। যুদ্ধের এই দিনে অন্ধকারই যেন আশ্রয়, মাতৃগর্ভের মতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন খান সেনা দেখে ফেলে হাঁক দিল,
হেই, হেই ইধার আও, ইধার...ইস তারাফ...
 
ডাক শুনে তার পুরো শরীর এক অজানা আশঙ্কায় থরথর করে কেঁপে উঠল। শীতল স্রোত নেমে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে।

প্রথমে মকবুল ভাবল উঠে দৌড় দেবে কিনা। এক মিনিটের মধ্যে ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিল, না বোকামি হবে সেটা, তাহলে নির্ঘাত গুলি করবে। ভীরু পায়ে আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে সামনের দিকে আগাল। পায়ে জোর পাচ্ছে না তাই এলোমেলো পায়ে আগাচ্ছে সে। প্রতি পদক্ষেপে কমে আসছে কি তার সাথে মৃত্যুর ব্যবধান?
 
অধৈর্য খানসেনার চিৎকার, ইতনা টাইম কিঁউ লেতা হ্যায়, চালনা ভুল গ্যায়ে ক্যায়া? যতটা সম্ভব পা চালিয়ে সামনে এসে দাঁড়ানো মাত্র রাইফেল দিয়ে বুকে খোঁচা মেরে একজন জিজ্ঞেস করল, নাম বাতা!

ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বলল সে হাঁপ টানতে টানতে, মকবুল।

মকবুল, মকবুল ক্যায়া?

মকবুল হোসেন।

মুসলমান হ্যায় ক্যায়া?

জি, জানাব। ব্যবসার কারণে উর্দু ভাষা বলতে আর বুঝতে পারত, সেটুকু ভরসা ছিল তার।
 
কাম ক্যায়া কারতা হ্যা তু?

ছোটা সা কারোবার হ্যায়।

আচ্ছা? চাল ঘাড়ি নিকাল, জেব ম্যায় ক্যায়া হ্যায় নিকাল।

সব নিয়ে নেয়ার পর বলল, যা আব লাইন ম্যায় খাড়ে হো যা।

নিঃশব্দে মকবুল খানসেনাদের সব কথা মেনে নিল। আরো জনা দশেক বিভিন্ন বয়সের মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, জিপের আলোতে দেখা যায় মৃত মানুষের চোখ নিয়ে সবাই প্রাণপণে যার যার সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে যাচ্ছে। কারো চোখে মুখেই সজীবতা নেই, আসন্ন আতঙ্কের কালো ছায়া সেখানে।

খানসেনারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে, কী করবে তাদের সবাইকে নিয়ে। কেউ কেউ বলছে, গুলি করে মেরে ফেলে যেতে। কেউ বলছে এখানে না মেরে, অন্য কোথাও নিয়ে মারতে। কেউ বলছে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে। এই আলোচনা সবাই শুনতে পাচ্ছে। নিজেদের নিয়তির আলাপ শুনছে তারা, নিজেদের কানেই।

শেষে সিদ্ধান্ত হলো, এই টানাটানির কোনো মানে হয় না, এখানেই গুলি করা হোক সবাইকে। কাল মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি এসে পরিষ্কার করে ফেলবে। হুঙ্কার দিল তারা, এ সারে লোগ, লাইন পে আ যা!

অর্ধমৃত মানুষ বা মানুষের মতো অবয়বগুলো লাইন ধরে দাঁড়ায় ধীর পায়ে। অধৈর্য খানসেনারা অশ্লীল গালি দেয় তাদের, দ্রুত ক্যাম্পের নিরুপদ্রব আশ্রয়ে ফিরতে চায় তারা। মকবুলও যন্ত্রের মতো পায়ে পায়ে দাঁড়ায় পাশাপাশি। বোধহয় মাঝ বরাবরই দাঁড়িয়ে ছিল সে, কিন্তু মধ্যবিন্দু নির্ণয় করে কে এখন?

খানসেনারা তাদের কাছাকাছিই দাঁড়ায় মুখোমুখি হয়ে। অজগরের মতো শীতল আর হিংস্র অস্ত্রটা তুলে নেয় তারা, তাক করে। মকবুলের মনে হয় তার মাথার ভেতরে একটা হিমঠাণ্ডা সিনেমার পর্দা খুব আস্তে আস্তে ভারীভাবে বয়ে চলেছে। সে সিনেমাটা দেখছে। তার সব অনুভূতি খুব ছোট একটা বিন্দুতে গুটিয়ে আসছে। সে স্বপ্ন দেখছে। সে সিনেমা দেখছে।

মনে হলো পাশে কে কঁকিয়ে উঠল, মা! কারো কি বমির শব্দ হলো? সময়টা খুব থমকে গেছে, প্রতিটা সেকেন্ড যেন একেকটা ঘণ্টা।

এই অর্ধেক অন্ধকার আর আচ্ছন্নতা কিছুটা ভেঙে দিয়ে অজগরগুলো গর্জে উঠল। শব্দটা ঘোর ভেঙে দেয় খুব কর্কশভাবে। একটু আগের অর্ধমৃত দেহগুলোর কাটা কলাগাছের মতো পড়ে যাওয়ার ভোঁতা শব্দ হয় একে একে। পড়ে যায় মকবুলও চোখে নামতে-থাকা অন্ধকার আর কানে ভেসে-আসা আর্তনাদ নিয়ে।

বুটপরা কালো পাগুলো এগিয়ে আসে রাস্তায় ভারী শব্দ তুলে। অজগরগুলোর খুদে মাথা নামিয়ে তারা পড়ে-থাকা শরীরগুলো খোঁচায়, নাড়েচাড়ে। তারপর মিলিয়ে যায় পায়ের শব্দগুলো, বা বুটের। শিস দিতে দিতে গাড়িতে ওঠে তারা।

স্টার্ট নেয় ইঞ্জিন। তারপর মিলিয়ে যায় সেই শব্দও...

মকবুলের চোখেও নেমে আসে আঁধার।

গুলির শব্দ বিস্ফোরিত হওয়ার কিছু পর থেকেই একজন অন্যজনের ওপর পড়ছিল। তার পাশের জন তার ওপর লুটিয়ে পড়ার পর সে কিছু বোঝার আগেই পড়ে যায় মাটিতে।

কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আসে মকবুলের। তখনও মকবুল জানে না তার গায়ে গুলি লেগেছে কি লাগেনি। সে বেঁচে আছে কি নেই এই অনুভূতি তার হয় না। মরণ কতটুকু দূরে সে জানে না, বুঝতেই পারে না সে কিছু।

মকবুলের সারা শরীর তাজা গরম রক্তে ভেসে যাচ্ছে, চোখে নাকে তার বারুদের কটু গন্ধ। তার সারা শরীর অসাড়, পাশে অন্য মানুষগুলোর গোঙানির আওয়াজ। তারপর আবার সেই রাস্তার ধুলোয় উদাসীন নৈঃশব্দ চারধারে জায়গা করে নেয়। মকবুলের চোখ বন্ধ হয়ে আসে আবারও, সে কি মারা যাচ্ছে...?

বেশ অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর সে আবারও জেগে ওঠে। হাত পা নাড়ানোর চেষ্টা করে সে। পারছে। হয়ত সে মরে নি এখনো।

তার অনুভূতির জানালাগুলো খুলতে থাকে আস্তে আস্তে। সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে, আলো, শব্দ এগুলো বুঝতে পারছে। চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় সে নিজের পায়ে। প্রথম দিকে বেশ একটু চেষ্টা করতে হয় তাকে। মৃতদেহ ঠেলে, রক্তস্রোত উজিয়ে সে দাঁড়াতে পারে সিধে হয়ে।

চারধারে তাকায় সে, অন্ধকারেই দেখতে পায় বিভিন্ন ধরনের পোশাকপরা জনা দশেক মানুষ পায়ে মাথায় মিশে নিথর দেহে রাজপথে পড়ে আছে। আর তাদের রক্তে লাল হয়ে আছে পুরো পথ। বধ্যভূমিতে আর বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর সাহস বা প্রবৃত্তি কোনোটাই হয় না তার। রক্তমাখা জামাকাপড় গায়ে অন্ধকার গলিতে আশ্রয় নেয় সে।

যতটা সম্ভব রাজপথ ছেড়ে গলি, গলি থেকে তস্য গলি দিয়ে অন্ধকারের নিরাপদ ঠাঁইয়ে মিশে গিয়ে সে হেঁটে হেঁটে মনকম্পাস তাক করে বাড়ির দিকে। সেখানে নিরাপত্তা, সেখানে আম্মা, সেখানে শান্তি। অন্ধকারে মিশে মিশে মকবুল নিজের বাড়ির গেটে এসে থামে। বিকেলে আম্মার আয়াতুল কুরসি পড়ে তার সারা গায়ে ফুঁ দেয়ার কথা মনে পড়ে যায়।

মকবুল উন্মুখ চোখে তাকিয়ে দেখে গেটের ভেতরের অন্ধকার পেরিয়ে টানা বারান্দায় সাদা শাড়ি পরা কেউ একজন নীরব পায়ে হাঁটছে, যার হাতে অন্ধকারে উজ্জ্বল আলো দেয়া সবুজ রঙের তসবিহ অনবরত নড়ছে।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।