ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

স্নিগ্ধার টেলিফোন | মাহতাব হোসেন

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৫
স্নিগ্ধার টেলিফোন | মাহতাব হোসেন

কানে টেলিফোনের রিসিভার লাগিয়ে তব্দা খেয়ে গেলাম। কলকাতা থেকে ফোন করেছে স্নিগ্ধা।

আমার মোবাইলফোন নম্বর ওর কাছে থাকার কথা না। তাই বলে অফিসের টেলিফোনে? অবশ্য বুদ্ধি থাকলে সবই হয়। স্নিগ্ধা, আহা! কত রোমাঞ্চ!

একদিন বৃষ্টি হলো, প্রচণ্ড বৃষ্টি। ঝড়ে স্টেশন রোডের কিছু পুরনো গাছ উপড়ে যাওয়ার পর প্রচণ্ড বৃষ্টি। হাঁটু জল জমে যাওয়া বৃষ্টি। ঝড়-বৃষ্টিতে কলেজে আটকে যাওয়ায় স্নিগ্ধাকে আনতে সৈকতের ওপর দায়িত্ব পড়ে। প্রেমিকের দায়িত্ব নয়, প্রতিবেশির দায়িত্ব, সহপাঠীর দায়িত্ব। একই কলেজ যদিও, কিন্তু সৈকত সেদিন কলেজে যায় নি। স্নিগ্ধার আম্মু সৈকতের ওপর বেশ নির্ভর করত। পারলে সিন্ধুকের চাবিও সৈকতের হাতে তুলে দেয়। স্নিগ্ধার মায়ের একটা আদেশ পালনের জন্য আমার মতো অজস্র সৈন্য প্রস্তুত, কিন্তু আমাদের নিরাশ হতে হয়। সেদিন কেমন বৃষ্টি হয়েছিল সেটা আমার চেয়ে ভালো মনে রেখেছে সৈকত। আমার মনে রাখার কোনো কারণ নেই। তবুও আমার বৃষ্টির দিনগুলোর কথা কেমন করে যেন মনে গেঁথে যায়। হোক না তা ২০০৫ সালের কোনো বৃষ্টি।



সৈকতের স্বীকারোক্তিতে আমি অবাক হই না। সেদিনের কথা আমারও খুব মনে আছে। স্টেশন এলাকায় কোনো একটা কাজে গিয়েছিলাম। সেটা সেদিনকার দ্বিতীয়বারের মতো ভেজা আমার। সৈকত ভ্যান থেকে স্নিগ্ধাকে নিয়ে নামছে। আমার সামনে দিয়ে ও চলে গেল, আমাকে খেয়াল করল না। আজ জানলাম, সেদিন ঠিকই খেয়াল করেছিল সৈকত। আসলে, স্নিগ্ধার প্রেমে সবাই পড়তে পারে। সৈকতের জন্য আমারও কষ্ট হয়



ঢাকায় চলে আসার পর, মেডিনোভার সামনের লেকের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে চা খাওয়ার সময় স্নিগ্ধার প্রতি ভালোবাসার কথাটা সৈকত বলেছিল। সহজ স্বীকারোক্তি।
“দোস্ত, আমি প্রেমে পড়ে গেছি। ”
“তাই নাকি, ভালো তো... কার?”
“স্নিগ্ধার। ”
“স্নিগ্ধা!”

বৃষ্টির ফোঁটা চায়ের কাপে জমা হচ্ছে। অনেক আগেই ভিজে গেছি। সামনের লেকের জলে বৃষ্টির মিশে যাওয়া দেখতে দাঁড়িয়েছি। বৃষ্টিসন্ধ্যা বিকেল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি—
“স্নিগ্ধার দেখা পেলি কোথায়?”
“স্নিগ্ধাকে যেদিন আমি কলেজ থেকে নিয়ে এসেছিলাম। মনে আছে তোর? সেদিন রিক্সা ভ্যানের পেছনে বসে পুরো রাস্তা ও আমার হাঁত ধরে এসেছে। নিজে ভিজেছে। আমাকেও ভিজিয়েছে। সেদিন আমি প্রথম মেয়েদের মুখের দিকে তাকাই, স্নিগ্ধার বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া পা, চিবুক, টোলবেয়ে নেমে আসা জল... এসবই আমাকে ভিজিয়েছে। আমার মনে বৃষ্টি জমে গিয়েছিল আমি বুঝি নি। এইরকম বর্ষার দিন আমাকে অস্থির করে দেয়। ”

সৈকতকে বলি, “স্নিগ্ধার কথা বলে লাভ কী? সে তো দেশে নেই। শুনলাম তুইও নাকি দেশের বাইরে চলে যাবি?”
“ভালোবাসা বুঝি ফেলে দিতে হয়? বুকের মাঝে বহন করে নিয়ে যাওয়া যাবে না? এয়ারপোর্ট কাস্টমসে আটকাবে নাকি?”—ওর কথায় হেসে ফেলি।

ইন্টারমিডিয়েট লাইফটা অদ্ভুতভাবে কেটেছে। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন, ঘোরের মধ্যে। স্নিগ্ধার মুখ দেখার জন্য বিকেলটা ওদের বাড়ির সামনের রাস্তায় কাটত। একদিন বিকেলে স্নিগ্ধার মা বাসায় ডেকে নিয়ে গেল। আমার বুকের ভেতর কাঁপন। এত কাছ থেকে স্নিগ্ধাকে দেখব। বুকটা উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছে। যে ঘরে এনে বসালো, সেখানে স্নিগ্ধার বইখাতা সাজানো, ওয়ালে পেইন্টিং। যে সোফায় বসেছি তার কুশনে চমৎকার নকশা। আলমিরা ভরতি বই। উফ কী দারুণ! আমি জানি না, আমাকে কেন ডেকে আনা হয়েছে। একটু পরেই স্নিগ্ধা রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করে—

“তুমি তো লাইব্রেরির সদস্য, তাই না?”

উপজেলার মোটামুটি বড় ইয়াংস্টার গণকেন্দ্র পাঠাগার। আমি সেটার সদস্য। শুধু আমি না, আরো বেশ কয়েকজন বন্ধুকেও সদস্য বানিয়েছি। প্রায় প্রতিদিনই লাইব্রেরিতে যাই। পড়ি, সাথে বই নিয়ে আসি।

“জ্বি হ্যাঁ, হ্যাঁ। ”
“আমার নেরুদার একটা কবিতার বই লাগবে, পাবলো নেরুদার। এনে দিতে পারবে?”
“অবশ্যই পারব”...
‘আমাদের একটা আবৃত্তি ফাংশন আছে। আর তোমাদের কেমিস্ট্রি সাজেশনটাও দরকার আমার। দিতে পারবে?”

আমি ডিগ্রি কলেজে পড়ি। ও ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। আলাদা কলেজ। এরপর কয়েকবার ওদের বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। প্রতিবারই খাবারের মেনু চেঞ্জ হয়ে যেত। স্নিগ্ধার মা যে কী অমায়িক মানুষ, বুঝেছিলাম সেই ক’দিনের অল্প সময়ে। আমি সাজেশন ফটোকপি করে আমার নিজেরটা দিয়ে এসেছি। নেরুদার ‘রেসিডেন্স অন আর্থ’ নতুন কপি কিনে দিয়ে এসেছিলাম। তারপর থেকে ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যখনই স্নিগ্ধা দেখত, আমাকে জানালা দিয়ে ডেকে বলত, “এই সমুদ্র, লাইব্রেরিতে বইটা ফেরত দেবে না? অনেকদিন হয়ে গেল তো!” আমি ব্যস্ততার ভান করে বলতাম, “আজ লাইব্রেরিতে যাচ্ছি না স্নিগ্ধা। যেদিন যাব সেদিন নিয়ে যাব। ”

মেয়েটা এত বোকা কেন? ও কি একদমই বোঝে নি ওটা লাইব্রেরির বই না। লাইব্রেরির বই হলে তো সিল মারা থাকত। অবশ্য তখন বয়সই বা আর কত আমাদের?

সৈকতের স্বীকারোক্তিতে আমি অবাক হই না। সেদিনের কথা আমারও খুব মনে আছে। স্টেশন এলাকায় কোনো একটা কাজে গিয়েছিলাম। সেটা সেদিনকার দ্বিতীয়বারের মতো ভেজা আমার। সৈকত ভ্যান থেকে স্নিগ্ধাকে নিয়ে নামছে। আমার সামনে দিয়ে ও চলে গেল, আমাকে খেয়াল করল না। আজ জানলাম, সেদিন ঠিকই খেয়াল করেছিল সৈকত। আসলে, স্নিগ্ধার প্রেমে সবাই পড়তে পারে। সৈকতের জন্য আমারও কষ্ট হয়। তাকে প্রবোধ দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না।

তারপর তো আমরা ঢাকায় চলে এলাম। সেও কয়েক বছর হয়ে গেছে। মেডিনোভার সামনের রেলিংয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা নামে। দুইবন্ধু পা ঝুলিয়ে আড্ডা দিই, এই তো রুটিন। খুব কাছের দুয়েকজন ছাড়া কারো সাথেই যোগাযোগ নেই। স্নিগ্ধার কথাও আমরা বেমালুম ভুলে গেছিলাম। ভোলা হয় না যদিও সবটুকু। তারপর সৈকতও ব্যস্ত হয়ে ওঠে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে। একমাত্র ওর সাথেই সুঁতোর টানটা লেগে ছিল। চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।

কানাডার ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটিতে একটা স্কলারশিপ পেয়েছে সৈকত। আমিও আমার পত্রিকার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছি। বাড়ি যাওয়াও কমে গেছে। বাড়ির কথাটা উঠলে মায়ের পরেই স্নিগ্ধার ছবি ভেসে ওঠে। অথচ স্নিগ্ধা আমার কেউ ছিল না, কখনো না। ছেলেমেয়ে নামের যে বন্ধুত্বটুকু হয়, হয়ত সেটুকুই, তাও অল্প সময়ের জন্য ছিল আমাদের মধ্যে, কিংবা ছিল না। ও ছিল পুরোটাই সৈকতের অথবা সৈকতই ছিল স্নিগ্ধার। সবই ভুলে গেছি। খবর পেয়েছিলাম, স্নিগ্ধারা ভারত চলে গেছে। অবশ্য আরো আগেই স্নিগ্ধাদের ভারত চলে যাওয়ার কথা ছিল। ‘এনিমি প্রপার্টিজ’ নিয়ে ঝামেলা। শেষখবর পেয়েছিলাম ও যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।

এই যে সাতমসজিদ রোড, মেডিনোভার সামনের উন্মুক্ত লেক, এখানে মাঝে মাঝে না বসলে হয়ত এইসব পিছুটান কখনোই সজাগ হতো না।

“আচ্ছা সৈকত, স্নিগ্ধাকে কি একদমই ভুলে যাবি, নাকি বুকে ধারণ করে রাখবি?”

সৈকত আমার কথা না শোনার ভান করে, গভীর করে পলপলে পাতলা প্লাস্টিকের চায়ের কাপে চুমুক দেয়। এত পাতলা তরল এত গভীর করে চুমুক দেওয়ার কিছু নেই। তারপরেও সে দেয়। উত্তরীয় বাতাসে আমার বড় হয়ে যাওয়া চুল এলোমেলো হতে থাকে। এই যে ভর সন্ধ্যা, এই যে বন্ধুত্ব। দূরের মসজিদের মিনারের চূড়ার আলো। সব মিলিয়ে এই সন্ধ্যা খুব মায়া ছড়িয়েছে। শেষ অধ্যায় হয়ত এখানেই ছিল। জানা ছিল। সৈকত আমার দিকে ঘুরে তাকায়—

“আচ্ছা সমুদ্র, একটা কথা বলবি, আমি বেশ কয়েকবার বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি। ভাবতে চাই নি, তারপরেও আমার মাথায় চলে এসেছে। যতবারই ভেবেছি মনে হয়েছে এটা একটা নিষিদ্ধ চিন্তা, অবশ্য ততবারই আরো বেশি করে মাথায় জেঁকে বসেছে। ”
“বল। ”
“আচ্ছা, তোর কি স্নিগ্ধার প্রতি দুর্বলতা ছিল, বিন্দুমাত্র হলেও? আমাকে ভুল বুঝিস না। বল। ”

আমি জানি সৈকত আমার কত কাছের, কত ভালো বন্ধু। আমি নিশ্চিত নই, তবে আমার ধারণা, স্নিগ্ধার সঙ্গে নিজেই ইচ্ছে-দূরত্ব তৈরি করেছিল ও। এবং সেটা আমার জন্য, তাও অনুমান করতে পারি।   দুজনের কাছে একটা বইয়ের একটা পাতা, না পড়ে পরের পাতায় চলে যাওয়ার মতোই কাজ করেছে সৈকত। আমি সৈকতকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। আমাকে এড়িয়ে যেতে হবে। মাথা কাজ করে না। আমাদের বামপাশের টেবিলে নতুন এক জুটি এসেছে। পুতুল পুতুল চেহারার মেয়েটা কী যেন অনুরোধ করছে ছেলেটার কাছে। হয়ত ফুচকা খেতে দেবে না ছেলেটা। কয়েক সেকেন্ডে পরেই মেয়েটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। চিৎকার করে বয়কে ডাকে। সন্ধ্যার স্নিগ্ধতার মতোই সুন্দর দৃশ্য। প্রেমিকজুটি জিভে শব্দ করে টক মেখে ফুচকা খাচ্ছে। চোখেমুখে হাসির ঝিলিক।

মনে পড়ে স্নিগ্ধার সাথে আমার কবে শেষ দেখা হয়েছিল। স্টেশনেই দাঁড়িয়েছিলাম। সৈকতের সাথে নেমে হেঁটে আসছিল। আমি তাদের না দেখার ভান করে একটু পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সৈকত আমাকে ধরে ফেলে। দুজনেরই কলেজ ড্রেস। স্নিগ্ধার নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কলেজে ওদের বিদায় অনুষ্ঠানের প্রোগ্রাম ছিল। আমাদের গরীব কলেজে এসব অনুষ্ঠান হয় না।

সৈকত চলে গেছে কানাডায়। সেও বছরখানেক আগের কথা। আর হঠাৎ করেই স্নিগ্ধার ফোন। স্নিগ্ধা টানা ৩৫ মিনিট কথা বলে ফোন রাখে। আমার নামে-ছাপা একটা খবর পড়ে সে বুঝতে পারে, আমি পত্রিকায় কাজ করি। তাই অফিসের টেলিফোনেই ডায়াল করে বসে। আমাকে খুঁজে পাওয়া কত সহজ, বুঝলাম। খুঁজে পাওয়ায় স্নিগ্ধার সে কী উচ্ছ্বাস! আমার ফোন নম্বর তো নিয়েইছে, ফেসবুকে আমার একাউন্ট নাই কারণেও তার রাগ আর ধরে না! স্নিগ্ধা দেশে আসছে। বাংলাদেশের কোনো একটা কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে জয়েন করবে। স্নিগ্ধা সৈকতের কথা একবারও জিজ্ঞেস করে নি। স্বার্থপরের মতো আমিও সৈকতের প্রসঙ্গ তুললাম না। ফোনটা রাখার পর থেকেই বিষয়টা বুকের ভেতর খচখচ করছে। মনে হচ্ছে বড় ধরনের অন্যায় করে ফেলেছি।

আচ্ছা স্নিগ্ধা আগে দেশে আসুক। তারপর স্নিগ্ধাকে বলব ও যেন সৈকতকেই বিয়ে করে। তারপর সৈকতের সঙ্গে কানাডায় থাকবে। আচ্ছা, স্নিগ্ধার বিয়ে হয়ে যায় নি তো? আমি কানে রিসিভার লাগিয়ে তব্দা খেয়ে বসে থাকি।



বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।