ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ইউটার্ন | শাহ ইয়াছিন বাহাদুর

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৫
ইউটার্ন | শাহ ইয়াছিন বাহাদুর

শেষবার যখন তোমার সাথে আমার অথবা বলা যায় আমার সাথে তোমার দেখা হয়েছিল মানে তোমার আদেশে মাসলওলা পাণ্ডারা আমার বাম হাতটা ভেঙে দেয়ার পর যখন ডান হাতে ভাঙা হাতটা আলগি দিয়ে এদিক ওদিক একটা খালি রিকশা খুঁজছিলাম আর তুমি ছাই রঙের গাড়ির কাচ নামিয়ে আমার দিকে বা আমি তোমার গাড়ির দিকে তাকিয়েছিলাম, তখন থেকেই, সত্যি বলছি, প্রতিশোধপরায়ণ মন বা ভেঙে যাওয়া হাতে অপেক্ষমান প্লাস্টারের দুর্ভাবনা থেকে নয় কিংবা ঠিক কী কারণে জানি না, একটা গাড়ি আমি কিনতে চেয়েছি।

গাড়ি কেনার নেপথ্যের গল্পটা আমি তাই তোমাকে বলতে বলতে উপভোগ করতেই পারি।

কিন্তু গল্প যে বলব, গল্প তো গল্পই। জানিয়ে রাখি, আমার অভিজ্ঞতার বাইরে থেকে ধার করে আনা গল্প আমি কখনোই বলি না আবার যখনই বলতে যাই তখন যথাসম্ভব সত্য গোপন রেখেই উপস্থাপন করি। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই, আমি মিথ্যা বলি না আবার সত্যের আইলেও এই পা রাখি তো এই সরিয়ে নিই।



‘গাড়ি কিভাবে কিনলাম’ জানতে চেয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে যে তীর্যক চাহনি দিয়েছো এতে যে শুধু গাড়ির কথাই ভাসান দিচ্ছে তা নয়, আমি বুঝতে পারি। গাড়ি মানেই তো এটা রাখার জন্য একটা গ্যারেজ। গ্যারেজের জন্য একটা বাড়ি বা নিদেন পক্ষে একটা ফ্ল্যাট আর বাড়ি বা ফ্ল্যাট তো আট ডিজিটের বিপুল টাকার ধাক্কা! তবে শোনো, এই দেশে সবই সম্ভব। যেমন তুমি আর তোমার পাণ্ডারা আমার হাত ভেঙে দিয়ে, ক্রমাগত ভয় দেখিয়ে আমাকে ক্যাম্পাসছাড়া করার পরও তোমাদের নামে সালিশ বসেনি



ধরা যাক, আবার প্রবাসী বান্ধবী, তার কথাও অবশ্য তোমাকে বলা যায়, সে আমাকে হঠাৎ বলল, “তুমি কি এখনো সিগারেট খাও?” সিগারেট ধরার পর থেকেই নানা কারণে ধরা-ছাড়ার চোর-পুলিশটা চলেই। এর ভেতরেই ও হয়ত একটু শুনল, ক’দিন ধরে সিগারেটটা খাচ্ছি না। সেই ছাড়ার লাগামটার কী কন্ডিশন তা জানতে চাইলে খেয়াল করলাম, গত দু’মাস আমি টানার উপরেই আছি। এমন কি, যে অভ্যাসটা আগে ছিল না, সকালে বাথরুমে যাবার আগেই বিছানায় চোখ খুলতে খুলতে সিগারেট দিয়ে ঘুম তাড়াবার বিশ্রী ব্যাপারটা রুটিনে সয়ে যাচ্ছে—তখন আমি ‘সিগারেট খাই কিনা’ প্রশ্নের পিঠে হয়ত বলব, “আরে, সিগারেট খেয়ে আর কী হয়!” অথবা সত্যের আরেকটু কাছাকাছি হয়ত যাব, “সিগারেট না খাওয়াই ভালো। ”

সিগারেটে ও আমাকে প্রশ্রয় বা বারণ কোনোটাই কোনোদিন করেনি তবু আঙুলের ফাঁক দিয়ে বাইন মাছের মতো সুকৌশলে সত্যকে আমি পিছলে ফেলে দিই। সোজা কথায়, সত্য এড়িয়ে যাই। আমার কথা বলার ধরনটাও হয়েছে এমন আর এ কারণেই সতের বছর পর তোমার সাথে দেখা হওয়ায় বা এই যে আমারই গাড়ির ভেতরে পাশাপাশি বসে আমার নাকে বারবার সুগন্ধি ছড়িয়ে দিচ্ছো আর ধরে ফেলেছি, একটু মুটিয়ে গেলেও নাভিতে তোমার মেদ জমেনি, সেই সুগন্ধি বা মেদহীন নাভির গুরুত্ব আমার কাছে যাই থাকুক বা না থাকুক, তোমাকে সত্য বলার চেষ্টাটা আমি করব।

গত দু’দিন তোমার গল্পে গল্পে গেছে। তুমি বলেছো, উড়ন্ত আগুনে পোড়ার নিদারুণ এক শখে কিভাবে নেশাটা ধরলে। আর ওই এক পাণ্ডা, যে আমার বাম হাতটা ভেঙে দিতে দিতে আমার মাকে যা তা বলে গালি দিচ্ছিল, যে এই শহরেই চিপাচাপায় ধান্ধা করে, ইচ্ছা করলেই যাকে আমি পুলিশে দিয়ে, পুলিশের হাতে বান্ডিল দিয়ে ওর দুটো হাতই এখন ভেঙে দিতে পারি, তার খপ্পরে সব হারিয়ে তুমি ঘুমে ঢুলঢুলু চোখে মরা রক্তের একটা স্থায়ী রেখা টেনে ফেলেছো।

সেই তুমি, বিত্তবান পিতার বখে যাওয়া ত্যাজ্যকন্যার গল্পগুলো বিশ্বাস করতে চেয়েও নিজের সত্য গোপনের প্রতিষ্ঠিত অভ্যাসের কথা মনে হতেই চলন্ত গাড়ির গ্লাসে সন্দেহের একটা উটকো প্রেত আমার দিকে তাকিয়ে ভেঙচি দিল, মনে হলো। এত বছর সেই পাণ্ডাদের কথা একরকম ভুলেই থেকেছি। তবু মাঝে মাঝে টেলিভিশনে ক্রিকেটারদের দেখলে বাম হাতটায় চোখ চলে যায় আর ‘ক্রিকেটটা খুব ভালো খেলতাম’ ভাবার সঙ্গে সঙ্গে তোমার ভয়ঙ্কর সুন্দর চেহারা বা মদে ভরা নেশাতুর স্বাস্থ্য, তোমার চঞ্চল হেঁটে যাওয়া বা হঠাৎ বেণী নাড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোয় যে কয়েক টুকরো আততায়ী আগুন জ্বলে উঠত, সেই আগুনের কথা মনে পড়ে। আর কী আশ্চর্য! মনে না করতে চাইলেও অবধারিতভাবে পাণ্ডাদের মারমুখি মুখগুলো আমি স্পষ্ট দেখতে পাই।

আমার সংসার বলতে ছিল কেবল এক সৎ মা আর তোমাদের তো সবই ছিল এবং যা ছিল তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি। সেই তোমরা, প্রায় সবাই কী করে এভাবে ধ্বংসের মাতাল স্রোতে ভাসলে! তোমাদের এই অধঃপতিত পরিণতির কথা ভাবলে অবশ্য আমার ভাঙা হাতটাকে সান্ত্বনা দিতে আর খারাপ লাগার কথা নয়। তো তোমার কাছে সব বলব বলে যেভাবে শুরুটা করতে চাইছিলাম, তুমি বা তোমার পাণ্ডাদের হঠাৎ মনে হয়ে যাওয়ার কারণে যদি গল্পটা এদিক ওদিক খানিকটা ডাইভার্ট হয়ে যায়, কিছু মনে করো না যেন!

আমি তখন মেসে থাকি, সাইকেলে চেপে পাঁচ কিলোমিটার দূরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যাই আর ফাঁকা ঘণ্টায় বাড়িবাড়ি টিউশনি করি। ভাঙা হাত নিয়ে যে সন্ধ্যায় আমি রুমে ফিরি, সে সন্ধ্যায়, আমার স্পষ্ট মনে আছে, শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসছিল আর এত দূরের হোস্টেলের কোনো বন্ধু আমার পাশে শেষতক থাকতে পারছিল না। সেই সন্ধ্যায় আচমকা কেডিএ স্যার মানে কাজী দীদারুল আলম স্যার ঝড়ের মতো ‘বাবলু’ বলে ভরাট কণ্ঠে আমার নাম ধরে একবার ডেকে উঠলেন আর মুহূর্তে আমার রুমের সামনের সমস্ত অন্ধকার যেন তাঁকে পাশ কেটে কেটে চলে যাচ্ছিল। আমি উঠে তাঁকে সালাম করতে পারছিলাম না কারণ প্রচণ্ড শরীরব্যথায় আমি প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলাম। কেডিএ স্যার আমার মাথায় হাত রাখলেন। খেয়াল করলাম, স্যারকে আমি যত ভয় পাই, আমার জ্বর হয়ত আরো বেশি পাচ্ছিল, আর এ কারণেই মাথার আসন ছেড়ে খুব দ্রুত পালাতে চাইছিল।

সৌভাগ্যবশত স্যারের বাসা আমার রুমের কাছেই ছিল। এই ঘটনার পর থেকে ভয়ঙ্কর রাগী এই স্যারের বাসায় সাহস করে যেতে শুরু করলাম। কেডিএ স্যার কী পরিমাণ রাগী ছিলেন তা নিশ্চয় তোমার মনে আছে। একবার যন্ত্র প্রকৌশলের এক ছাত্রকে দিয়েছিলেন এক থাপ্পড়। সে টাল সামলাতে না পেরে জানালার কাছে গিয়ে পড়েছিল। সেই স্যার, যাঁর রেসলারের মতো মাসল, পড়ন্ত বয়সেও ক্যাডস-গ্লাস পরে ক্লাসে নিজেকে আমাদের চেয়েও তরুণ বানিয়ে রাখতেন, তাঁর বাসায় গিয়ে আবিষ্কার করলাম, তিনি ভয়ানক নিঃসঙ্গ। আরো নিঃসঙ্গ তাঁর চুনরঙা একতলা বাড়ি ও বাড়ির ছাদে দক্ষিণমুখো চেয়ে থাকা এক বিশাল স্যাটেলাইট এন্টেনা। তিনি বছরের পর বছর আরএফ সিগনালের আশায় এন্টেনা পেতে রেখেছেন। তাঁর অগাধ বিশ্বাস, কেউ একদিন সাড়া দেবে। তাঁর বিরক্ত রিসিভারের অপেক্ষা শেষ হবে। তিনি ভীনগ্রহের কোনো দুষ্প্রাপ্য সিগনাল আশা করছিলেন। আশা করছিলেন, অন্য গ্রহের সাথে যোগসূত্র তৈরির তিনি পথিকৃৎ হবেন। নিজের দেশে বা বিশেষত সংসারে যে একলা থাকে  তার কি গ্রহান্তরেই যাবে চোখ?

এখন বলতে পারো, তাহলে আমি কী করলাম বা স্যারের প্রসঙ্গই বা হঠাৎ কেন? আমি অন্য গ্রহের সন্ধান করিনি সত্য তবে অনেকের মাঝেও নিজেকে আলগোছে সাইডে সরিয়ে আনার বা স্পেশালি বলতে গেলে নিঃসঙ্গ রাখার কৌশলটা কিন্তু কেডিএ স্যারের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। যিনি কথা বললেই আমাদের যন্ত্রে ঠাসা বিশাল ক্লাসরুম কেঁপে কেঁপে উঠত, সেই স্যার রাত হলেই ছিপি খুলে বোতল সাবাড় করে দিতেন আর প্রতিবার ঠোঁট থেকে গ্লাস সরাতে সরাতে মুখ বিকৃত করে পৃথিবীকে চূড়ান্ত ঘৃণা করতে চাইতেন। তিনি বলতেন, “যন্ত্রে মন দে। ক্লাসমেট প্রতারণা করতে পারে, যন্ত্র করে না। ”

আমার সাথে তিনি স্যাটেলাইটের খুঁটিনাটি আলাপ করতেন। দেখতাম, প্রচণ্ড পান করেও তিনি মাতাল হতেন না। পরে জানলাম, তাঁর ছেলেটা দক্ষিণ আফ্রিকায় আততায়ীর হাতে গুলি খেয়ে মারা পড়েছে। ফিনল্যান্ড যাওয়া মেয়েটার খোঁজই নেই!

কেডিএ স্যারের কাছে বেশিদিন টিকতে পারলাম না। তুমি আর তোমার পাণ্ডাদের তখন সত্যি ভয় পেতাম। প্রকৌশলের বিদ্যা ছেড়ে আমার নিরুদ্দেশ বা অন্তরীণের এটাই কারণ, বিশ্বাস করো। তোমাদের প্রতি প্রতিশোধের একটা স্পৃহা তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। এ কারণেই হয়ত কেডিএ স্যারের মতো ভীনগ্রহে নয় বরং আমি এই অসমান গ্রহটাকেই খুলে দেখতে চেয়েছি। সাহস করে মস্তিষ্কে একটি এন্টেনা আমিও বসিয়ে ফেললাম আর কী আশ্চর্য! ভাগ্য ভালো বলতে হবে বা ভাগ্য আমার খুলতে শুরু করেছিল কেননা হুড়মুড় করে আমার রিসিভারে সব কিছু ধরা পড়তে শুরু করল।

যা চাইলাম তা তো পেতে থাকলামই, যা চাইলাম না নির্বিচারে তাও আসতে থাকল। তোমার সাথে সতের বছর পর হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া বা এই যে তোমাকে নিয়ে কুমিল্লার দিকে হাইওয়ের কোনো রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চ করব বলে লংড্রাইভে বেরিয়ে পড়েছি, এটা কিন্তু চাইনি বা কোনো এক সময় অজ্ঞাতে হয়ত চেয়েছি, বুঝতে পারিনি, সেই চাওয়া না চাওয়ারই বাস্তবতা যা আমার রিসিভারে ধরা পড়েছে। এই সত্যিটা তোমাকে মানতে হবে।

‘গাড়ি কিভাবে কিনলাম’ জানতে চেয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে যে তীর্যক চাহনি দিয়েছো এতে যে শুধু গাড়ির কথাই ভাসান দিচ্ছে তা নয়, আমি বুঝতে পারি। গাড়ি মানেই তো এটা রাখার জন্য একটা গ্যারেজ। গ্যারেজের জন্য একটা বাড়ি বা নিদেন পক্ষে একটা ফ্ল্যাট আর বাড়ি বা ফ্ল্যাট তো আট ডিজিটের বিপুল টাকার ধাক্কা! তবে শোনো, এই দেশে সবই সম্ভব। যেমন তুমি আর তোমার পাণ্ডারা আমার হাত ভেঙে দিয়ে, ক্রমাগত ভয় দেখিয়ে আমাকে ক্যাম্পাসছাড়া করার পরও তোমাদের নামে সালিশ বসেনি যদিও তোমাদের বিচার হওয়া প্রয়োজন ছিল। না, প্রকৃতির বিচার যা তোমরা পেয়েছো তা আমার প্রাপ্য বিচার বলব না। প্রকাশ্যে অপদস্থ হওয়ার সাজা প্রকৃতি অপ্রকাশ্যভাবে, তা যত কঠিনই হোক, দিলে আমি মানব কেন? যা হোক, একইভাবে সতের বছরেই কপর্দকশূন্য একটি যুবকের এই বিলাস, এই ঝকমকানি কাম্য ছিল না কিন্তু হয়ে গেছে। এই দেশে সবই সম্ভব কিনা বলো?

প্রকৌশল কলেজে মেয়েদের সংখ্যা হাতে গোনা। আমাদের ডিপার্টমেন্টে তুমিসহ সংখ্যাটা ছিল মোটে চার। অন্য তিনজনের স্মৃতিপটে এখন কেবলই কুয়াশা কিন্তু তুমি, ধনবান পিতার কন্যা ছাইরঙা গাড়ি করে আসতে-যেতে। তোমার হেঁটে চলার প্রতিটি কদমে কয়েক টন দাপট ঘুরে বেড়াত। ক্লাসে যতক্ষণ তুমি থাকো, আমি একতরফাভাবে তোমাতে মজে থাকি। অনর্থক ভালোবেসে ফেলি। আমার অতি সারল্য, অন্ধ বিশ্বাস, মূর্খমি আর নির্বুদ্ধিতা যে আমাকে ক্রমশ সাংঘর্ষিক পথে চালিত করছিল, বুঝি নি। বুঝতে পারলাম, যখন তোমার পাণ্ডারা আমার হাতটা ভেঙেই দিল। ততদিনে টিকে থাকায় আমার আত্মবিশ্বাসের কলসি থেকে শেষ জলকণাটাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সহৃদয় কেডিএ স্যার এতটুকু জানলেন না, জানলে না তোমরাও। আমি বইখাতা থেকে ইউটার্ন নিলাম। আর এটাই সম্ভবত সতের বছর পরও তোমার সাথে আমার দেখা হওয়ার একটা অবিশ্বাস্য নেটওয়ার্ক তৈরি করে দিয়েছে।

এখন তুমি আমার কাছে আশ্রয় চাইছো মানে চাইছো ‘কিছু একটা’ কাজ। আসলে কী, বিত্তের কাছে সবাই আশ্রয় চাইতে আসে! আমিও হয়ত তোমার কাছে চেয়ে বসতে পারতাম, এ কারণেই আমাকে শায়েস্তা করেছিলে কিন্তু এত কিছুর পরও আমি তোমাকে নিরাশ করব না ভাবছি। বললাম, “কাজ? কী কাজ করবে তুমি?”
তুমি বললে, “যেমন খুশি কাজ। উঠে দাঁড়াবার মতো। ”
আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম, “পর্নোগ্রাফি! করবে?”
তোমার ঠোঁটে সিগারেট কাঁপল নাকি সিগারেটের নিচে ঠোঁট কেঁপে উঠল বুঝলাম না। একটু চুপ থেকে চোখে বিস্ময়ের পর্দাটা খানিক নামিয়ে বললে, “এইটা বুঝি উঠে দাঁড়াবার মতো কাজ?”
এই প্রশ্নে আমি একটু মচকেছি সত্য তবু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “আমি তো উঠেছি!”

গল্পকথার এই পর্যায়ে তুমি আর কথা বলো না। কথা শুনতেও চাও না। গাড়ি কুমিল্লার দিকে চলতে থাকে, চলতেই থাকবে। তুমি বিশ্বাস করতে পারছো না জানি। দেখো, অবিশ্বাস কী চিজ! বিশ্বাস আমিও করতে পারিনি যে, তোমার আদেশে চিরকালের জন্য আমি আমার একটা হাতের সুস্থতা হারাব। এখন তুমিও যদি বিশ্বাস না করো, আমি তোমাকে সত্য-মিথ্যার মিশেল বা সত্য এড়িয়ে যাবার যে অভ্যাসের কথা বলেছি তা যদি বিশ্বাস করো তবে দ্বিধা বাড়বে, বাড়বে অবিশ্বাসও। তুমি আমাকে যতই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখো, নিরীক্ষণ করো, আমার গাড়ি কুমিল্লার হাইওয়ের রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত যাবে, আমরা ওখানে বসে লাঞ্চ করব। এই শিডিউল চলতেই থাকবে। আমি তোমাকে আরো কিছু দেখাতে চাই। যা আছে বা সম্ভাব্য যা আমি চাইতে ও করতে পারি তেমন কিছু। কিন্তু হঠাৎ তুমি বড়বড় চোখে কথা বললে, “আমার দিকে একটু তাকাও তো। ”

আমি তাকিয়ে খেয়াল করলাম, এত বছর পর এই প্রথম তোমার চোখে সেই আগুনের ফুলকি ফুটে উঠেছে। সীমাহীন আবেগ আর স্বপ্ন দেখার কোমল বয়সটায় যা আমাকে অঙ্গার করে দিয়েছিল। আমি তাকাতে পারছিলাম না। গাড়ি দ্রুতবেগে ছুটছে, ছুটলেই ভালো। অর্ধেক খুলে দেওয়া গ্লাসের উপর দিয়ে আসছে হাওয়া। তোমার চুল উড়ছে। সচেতন কিশোরীর মতো সাবধানে ওড়নাটা টেনে নিয়ে প্রশ্ন করলে, “একটা কথা বলি, উত্তর দিবে?”

আমি না-হ্যাঁ কিছুই বলি না। বলতে পারছি না। কিন্তু তোমার আগুনের মস্ত একটি গোলা আমার দিকে ঠিকই ধেয়ে আসে। বললে “সত্যি করে বলো তো, তুমি কি আমাকে সত্যি ভালোবাসতে!”

অসহায় বোধ করি। খুবই অসহায় বোধ করি। প্রচণ্ড অপরাধবোধে আমি তোমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিই। আমাদের গাড়ি হাইওয়ের রেস্টুরেন্টে এসে থামে। একটু স্বস্তি মিলবে ভেবে গাড়িটাকে একটা ধন্যবাদ দিই মনে মনে।

হাইওয়ের রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে তুমি খুব স্বাভাবিক ভাবে বললে, “শোনো, তোমার গাড়িতে আমি আর উঠছি না। আমি বাসে করে ফিরে যাব। ”

তোমার এ কথাটা আমি বিশ্বাস করি না। নিজের ওপর বিশ্বাস নেই বলে অন্যকেও সহজে তাই বিশ্বাস করতে পারি না। তবু এ কথা তুমি কেন বললে তা তো আমি জিজ্ঞেস করতেই পারি, কিন্তু তুমি এর যে জবাব দিলে তাতে সমস্ত শরীর আমার অবশ হয়ে আসে। তুমি বললে, “সে বছর তোমার একটা হাত ভেঙে দিয়ে আমার খুব অনুশোচনা হয়েছিল। তোমাকে বলা হয় নি। ভেবেছিলাম, কোনোদিন তোমার সাথে দেখা হলে সেই ঘটনাটার জন্য দুঃখপ্রকাশ করব। কিন্তু আমি আমার সেই ইচ্ছাটা তুলে নিলাম। দুঃখপ্রকাশ তো নয়ই বরং আজ মনে হচ্ছে, সেদিন তোমার ঐ হাতটাও ভেঙে দিলে আরো ভালো করতাম আমি। ”

আমি টেবিল ছেড়ে ধীরে ধীরে বেসিনের দিকে চলে যাই। ওর আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সব দিকে। সময় নিয়ে হাত ধুই। মুখে বারবার জলের ঝাপটা দিয়ে আয়নায় তাকাই, দেখি, কেডিএ স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা বোর্ডে স্যাটেলাইট স্টেশনের ছবি আঁকছেন। আর আমি ক্লাসের এক কোণায় ঝলমলে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। ভাবছি, অপূর্ব সুন্দরী আর অহংকারী মেয়েটি যদি একবার আমায় ভালোবাসতো!

গাড়ি থেকে ব্যাগ বের করে তুমি বাইরে এসে দাঁড়ালে। আমি একটু সহজ হতে তোমার কাছাকাছি দাঁড়ালাম, “এক কাজ করলে কেমন হয়?”

চোখে প্রশ্ন নিয়ে তুমি আমার দিকে তাকাও। বলি, “চলো, গাড়িটা ড্রাইভারকে দিয়ে দিই। ”

তুমি অবাক হলে, “মানে?”

আমি খোলাসা করি, “তোমাকে আবার ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। তোমাকে সত্যি বলতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছা করছে। ”

তুমি কথা বলো না। পায়ের কাছে ধুলোর দিকে তোমার দৃষ্টি। আবার বললাম, “আমি কি খুব বুড়িয়ে গেছি!”

ক্লাসের সেই নির্বোধ ছেলেটা আবার ফিরে আসছে দেখে তুমি কি একটু ভরসা পেলে? একটু ফিরে তাকালে আর একটু হাসিও কি ফুটে উঠল। বহু মূল্যের সেই হাসি! আর তখন আমাদের পাশ দিয়ে একটা গাড়ি এসে হঠাৎ হর্ন বাজালে তুমি ‘উহঃ’ বলে আমার একটা হাত শক্ত করে ধরে ফেললে।

তোমার দুটো হাতে আমার ভাঙা হাতটা এগিয়ে দিতে দিতে খেয়াল করলাম, ভেঙে যাওয়া হাতের বাঁকা অংশটা আর চোখে পড়ছে না!



বাংলাদেশ সময়: ১৮২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।