ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ১৮)

ধারাবাহিক রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৫
ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ১৮)

পর্ব ১৭ পড়তে ক্লিক করুন

পোকামাকড়ের সাথে ঘর সংসার |
ভারতের বন জঙ্গলে যত পোকামাকড়ের বাস—তারাও একসময় বিলাতি নারীদের জন্য ত্রাস হয়ে উঠেছিল। ঘরে বাতি জ্বাললেই শত শত পোকা উড়ে এসে বাতির ওপর, সারা ঘরে হামলে পড়ে।

রাতের খাবারের ওপর, গায়ে, জামা কাপড়ে—সর্বত্রই পোকামাকড়ের আক্রমণে অতীষ্ট হয়ে ওঠে বিলাতি নারীরা। কোনো কোনো পোকা আবার তীব্র কটুগন্ধ যুক্ত। কিছু পোকা ভন ভন শব্দ করায় পারদর্শী।

বিলাতি নারী মিস ক্লেমসের কথাই ধরুন না! মাদ্রাজে—নিজ বাড়িতে আয়েশ করে বৈকালিক রোদ লাগাচ্ছিলেন পিঠে। ঠিক তখনই আবিষ্কার করলেন বিরাট এক হলুদ-কালো ডোরাকাটা মাছি তার পিঠে এসে বসেছে। মিস ক্লেমসের মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হলো। তিনি তার স্মৃতি কথায় লিখলেন, “অসাধারণ ভয়ঙ্কর বড় বড় চোখের একটা বিশ্রী মাছি গোটা ঘরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ”



এক স্মৃতিকথায় লেডি ফকলেন্ড লিখলেন, “আহা! অসাধারণ সুন্দর এইসব পতঙ্গেরা! একটি প্রজাপতি দেখলাম যার শরীরের মূল রঙটা সবুজ আর ডানা দুটো রুপোলি রঙে কাজ করা। কী সুন্দর! কোনো কোনো পতঙ্গ দেখতে অদ্ভুত। মনে হয় কোনো মুখ নেই। কিছু কিছু মাছির রঙ সত্যি প্রাণ কাড়ার মতো। বুকটা রুবির মতো নীল



মিস ক্লেমসের মতো সবাই যে পোকা ভয় পেত—তাও নয়। লেডি ফকলেন্ড এদিক থেকে অনেক সাহসী একজন বিলাতি নারী। থাকেন বোম্বের এক আলিশান বাড়িতে। সন্ধ্যার পরপরই বাড়ির জানালা দিয়ে পতঙ্গের দল তার ঘরের বাতিকে ঘিরে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে। ফকলেন্ড আরাম করে পড়ার চেয়ারে বসে সেইসব পতঙ্গের ওড়াউড়ি উপভোগ করেন। তিনি এসব নামগোত্রহীন পোকামাকড়দের নিজেই অনেক সময় দিতেন। এক স্মৃতিকথায় লেডি ফকলেন্ড লিখলেন, “আহা! অসাধারণ সুন্দর এইসব পতঙ্গেরা! একটি প্রজাপতি দেখলাম যার শরীরের মূল রঙটা সবুজ আর ডানা দুটো রুপোলি রঙে কাজ করা। কী সুন্দর! কোনো কোনো পতঙ্গ দেখতে অদ্ভুত। মনে হয় কোনো মুখ নেই। কিছু কিছু মাছির রঙ সত্যি প্রাণ কাড়ার মতো। বুকটা রুবির মতো নীল। ”

লেডি ফকলেন্ড সন্ধ্যা হলেই ‘স্পিরিট ল্যাম্পে’র পাশে বসে পতঙ্গদের জীবনের নানান বাঁক নিয়ে গবেষণায় বসে যেতেন। পতঙ্গদের সাথে তার অলস জীবনের একটা বড় সময় বেশ ভালোভাবেই কেটেছিল। তবে মনে রাখতে হবে সব পতঙ্গই সহজ সরল আর নিরীহ গোছের নয়। কিছু ভয়ঙ্করদর্শনেরও—যেমন বিছা, মাকড়সা এবং মাছি বিলাতি নারীদের জন্য ছিল সাক্ষাৎ যমদূতের মতোই। এ অভিজ্ঞতা হয়েছিল বিলাতি নারী ফেনি পার্কের। ফেনি পার্ক উত্তর ভারতে একটি বাংলোতে থাকাকালে ঘরের বাথরুমে বিশাল আকৃতির একটি মাকড়শা দেখতে পান। এ নিয়ে তখন গোটা ঘরে লঙ্কাকাণ্ড! মুহূর্তেই সেপাই, দারোয়ান, তার দেখভালের জন্য নিয়োজিত ভারতীয় আয়া—সবাইকে ডাকা হলো।

চলুন সেই অভিজ্ঞতার কথা তার মুখ থেকেই শোনা যাক। “১৮ মে, ১৮৭৯। ঠিক সন্ধ্যার সময় ঘটনাটা ঘটল। ঘরের বাথরুমের মেঝেতে একটা মাকড়শা এইমাত্র সবাই মিলে মারল। সে এক এলাহি কাণ্ড! মৃত এই মাকড়শাটাকে আমি আমার ব্যক্তিগত শখের জাদুঘরে জমা করে আসলাম। ”

লিখিত ভাষ্যে—পতঙ্গ নিয়ে সবচেয়ে বড় ঝামেলায় পড়েছিলেন বিলাতি মেম লেডি ডুফেরিন। সে এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা।   ১৮৮০’র মাঝামাঝি কোনো এক সময়। রবিবারের এক সুন্দর সুনশান সকালে সবাই ভালো কাপড়চোপড় পরে এলাহাবাদের একটি খ্রিস্টান চার্চে সমবেত হলেন। মূল প্রার্থনা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তেই দেখা গেল চার্চের বাইরে এক বিশাল হট্টগোল। ভেতর থেকেও অনেকে চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে বের হয়ে যাচ্ছেন। লেডি ডুফেরিন তার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন এভাবে, “হঠাৎ দেখতে পেলাম চার্চের ভেতরে প্রার্থনায় থাকা সব মানুষজন চার্চের দরজা জানালা বন্ধ করতে শুরু করেছেন। সবাই যে যার মতো করে চার্চ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। আমি সব দেখে-শুনে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ঘটনাটা কী ঘটছে। কিন্তু হঠাৎ মানুষের মুখ থেকে বিড়বিড় করে একটা শব্দই শুধু কানে এলো—‘মৌমাছি!”

ভারতবর্ষের সর্বত্রই যে পতঙ্গটি বেশ দাপটের সাথে বিচরণ করত সেটি হলো মশা। মশার উৎপাতে বিলাতি নারীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত আর কি! শীত নেই, গরম নেই—সব ঋতুতেই এর উৎপাত। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে স্যার রবার্ট রস আবিষ্কার করেছিলেন, এই মশা থেকেই ম্যালেরিয়া জ্বরের উৎপত্তি। সেই সময় ম্যালেরিয়া ছিল একটি আতঙ্কের নামবিশেষ! ম্যালেরিয়া মানেই সাক্ষাৎ যমদূত। বিলাতি নারীদের জন্য মশা ছিল একটি কঠিন আর বিশ্রী রকমের পতঙ্গ। লেডি ফকলেন্ড মশাকে বলতেন ‘লোভি মশা’।

রক্তলোভী এসব মশার হাত থেকে বাঁচতে বিলাতি নারীরা তাদের পোশাক আশাকেও পরিবর্তন এনেছিল। রাতে এমন লম্বা জামা কাপড় পরে তারা ঘুমাতে যেতেন, যাতে মশাকুল বিলাতি রক্তের স্বাদ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। সে পোশাক মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখত। কখনো কখনো ঘুমানোর সময়ও তারা ক্যানভাসের জুতা পরে বিছানায় যেতেন। তা সত্ত্বেও বিলাতি নারীদের শেষ রক্ষা হতো না। সেই সময় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ছিল সাধারণ একটি ঘটনা। যদিও ততদিনে কুইনাইন (quinine) আবিষ্কৃত হয়েছে, তারপরও ম্যালেরিয়া রোগ মানেই এক ভয়াবহ আতঙ্ক। বিলাতি নারী মনিকা লাং তার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এইভাবে—“কোনো রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলাম। রাতের খাবারের পর প্রথম টের পেলাম যে আমার গোটা শরীর যেন কোনো অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় ভেঙ্গে মুচড়ে যাচ্ছে। তারপর দীর্ঘ রোগভোগ। আমি শুধুমাত্র কুইনাইন আর এসপিরিন খেয়ে ধীরে ধীরে সেরে উঠলাম। ”

রসমাউন্ড লরেন্স নামের আরেক বিলাতি মেমও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের অভিজ্ঞতা তার প্রতিদিনের রোজনামচায় লিখে গেছেন। তার ভাষ্যমতে, “হাতের কাছে অসংখ্য গরম পানির বোতল, কম্বল, কার্পেট, মোটা কাপড় রাখা সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল যেন আমি শীতে কাঁপছিলাম। ” রসমাউন্ড লরেন্স দীর্ঘ একমাস ম্যালেরিয়ায় ভুগে ধীরে ধীরে সেরে উঠেছিলেন।

১৮৭০ সালে ভারতে অবস্থিত বিলাতি নামকরা ডাক্তার এডওয়ার্ড টিলট এর মতে, “রোগে আক্রান্ত হলে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। ” সেই সময় ডক্টর টিলট ভারতে অবস্থানরত বিলাতি নারীদের দৈহিক শক্তি এবং সম্ভাব্য রোগ বালাই নিয়ে বেশ কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখেন। তার মতে, “মেয়েদের নিয়মিত খাবার খাওয়া ও ব্যায়াম করা খুব প্রয়োজন। যখন তাদের মাসিক চলতে থাকবে সেই সময়টায় তাদের ঘোড়ায় চড়া, নাচানাচি এবং যত্রতত্র ঘোরাফেরা করা একেবারেই উচিৎ হবে না।

বহু সেরে ওঠার ঘটনার পাশাপাশি ভারতে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রচুর বিলাতি প্রাণ হারাতে থাকে। সে কারণে ম্যালেরিয়া শব্দটি বিলাতিদের কানে ভয়ঙ্কর একটি শব্দ। ১৮৮৮ সালে পায়োনিয়ার পত্রিকায় ডাক্তার এডওয়ার্ড টিলট সতর্কবাণী করেন, “এভাবে রোগ বালাই চলতে থাকলে আর মাত্র চারটি জেনারেশনের পরই হয়ত গোটা ভারত থেকে ভারতীয় বিলাতি সমাজ মুছে যাবে। ” এডওয়ার্ড টিলট ভারতে প্রচুর পরিমাণে রোগ বালাইয়ের কারণ হিসেবে দেশটির উষ্ণ আবহাওয়া এবং কীট পতঙ্গকে দায়ী করেছিলেন।

বিলাতি মেম ইমার গল্প দিয়ে শেষ করব। ১৮৩০ সালে ছোটবোনের অকাল মৃত্যুর পর ইমা ভারতে চলে আসেন এবং কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস ও ভারতের নানান বিষয়ের ওপর তৎকালীন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। বিশেষ করে ভারতীয় সংস্কৃতি, বিয়ে, ভারতীয় চোর-ডাকাত, কীট পতঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি লেখালেখি করতেন। ভারতীয় কীট পতঙ্গ নিয়ে তার মন্তব্য ছিল, “ভয়াবহ এবং জঘন্য। ” তার মতে, “বিলাতি নারীদের জন্য ভারতে বসবাস করার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এখানকার আবহাওয়া এবং কীটপতঙ্গগুলোর যন্ত্রণাকে মেনে নেওয়া। ” পরবর্তীতে ইমা ভারতে বিভিন্নরকম শিক্ষামূলক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৮৩৯ সালে এই বিলাতি মেম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মারা যান। ইমা অনেক বিলাতি মেমদের মতো সত্যিকারভাবেই ভারতের একজন হতে পেরেছিলেন।

পর্ব ১৯ পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।