ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অনির্ধারিত বিরতি | আখতার মাহমুদ

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৫
অনির্ধারিত বিরতি | আখতার মাহমুদ

ই মুহূর্তে তানিশার নিজেকে সুখী মনে হলো। যদিও নিজেকে প্রায়শই সুখী মনে হয় তার।

সুখী হওয়ার জন্য সে জীবনের কাছে দুর্লভ সব বায়না ধরে বসে থাকেনি। যা পেয়েছে তাতেই খুশি থেকেছে। বাড়তি কিছু বা আরেকটু বেশি চাওয়া কখনোই তার ছিল না। হয়ত তার সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র এটাই। সীমিত চাওয়া। এই মুহূর্তে তার সুখী হওয়ার কারণ নিহাল। নিহাল তার স্বামী। মাস দুয়েক হয় ওদের বিয়ে হয়েছে। নিহাল সাধারণ একজন মানুষ। মাঝারি একটি চাকুরি করে ঢাকায়। বয়স পঁয়ত্রিশ। বয়সটা নিজের চেয়েও প্রায় বছর দশেক বেশি হলেও তানিশার আপত্তি ছিল না। ছেলেদের একটু ভারিক্কি না দেখালে স্বামী হিসাবে মানানসই লাগে না। আর ভারিক্কি ভাব আসার জন্যে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সটাই পারফেক্ট!



গাড়ির জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকছে হুড়মুড়িয়ে। ভাগ্যিস আজ চুল বিনুনী করে রেখেছিল, নইলে তো কাকের বাসা হয়ে যেত মাথাটা। ভাবল, তানিশা। ওরা হানিমুনে যাচ্ছে রাঙ্গামাটি। পথে যেতে যেতে যতসব মেয়েলী ভাবনা—ঘুরেফিরে মনে আসছিল। ভাবছিল, বাসার ফ্রিজের রঙটা ক্যাটক্যাটে কমলা না হয়ে সাদা কিংবা টকটকে লাল হলে ভালো হতো



নিহালের কাঁধে হেলান দিয়ে, তানিশা চোখ বুঁজেছিল। কত কত স্বপ্ন উঁকি-ঝুকি মেরে যায় মনে! ভেবে হাসে ও। নিহাল নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, “হাসছো যে?”
“না এমনিই। ” বলেই মাথা তুলে বাইরে তাকায়। কড়া রোদ বাইরে। তবে গরমের আঁচ তেমন লাগছে না। গাড়ির জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকছে হুড়মুড়িয়ে। ভাগ্যিস আজ চুল বিনুনী করে রেখেছিল, নইলে তো কাকের বাসা হয়ে যেত মাথাটা। ভাবল, তানিশা। ওরা হানিমুনে যাচ্ছে রাঙ্গামাটি। পথে যেতে যেতে যতসব মেয়েলী ভাবনা—ঘুরেফিরে মনে আসছিল। ভাবছিল, বাসার ফ্রিজের রঙটা ক্যাটক্যাটে কমলা না হয়ে সাদা কিংবা টকটকে লাল হলে ভালো হতো। ড্রয়িংরুমের শো-পিস স্ট্যান্ডটা একদম কোণার দিকে না রেখে দরজার কাছাকাছি ডানে বা বামে রাখা গেলে ভালো হতো, যাতে মানুষ ঘরে ঢুকেই ওটা দেখতে পায়। ওটাতে ওদের বিয়ের দিনের বাঁধানো ছবির ফ্রেম আছে। খুব পছন্দ হয়েছিল ছবিটা। তাই শো-পিস স্ট্যান্ডে রেখেছে।
নিহাল প্রাণভরে হেসে বলেছিল, “তোমার আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই? ড্রয়িংরুমে কেউ বিয়ের দিনের ছবি রাখে?”
তানিশা জবাব দিয়েছিল, “খুব রাখে!”

এরকম হাজারটা মেয়েলী ভাবনা মনে আসাতেই আপনমনে হাসছিল সে। হানিমুনে বেরিয়ে কি কেউ এসব ভাবে? আচ্ছা কী ভাবা উচিত? হানিমুনের প্ল্যান? কিন্তু সবসময়ই যে মাথায় গিজগিজ করে ঘর সাজানোর ভাবনা? বেড়ানো আনন্দের বিষয় ঠিক আছে, কিন্তু যে ঘরে নিহালের সাথে সারাটা জীবন থাকবে, নিজের মনের মতো সেই ঘর সাজানোর ভাবনা কী করে ভুলে থাকবে সে? যতই তাড়াতে চায় মাথা থেকে, ততই, যেন দুষ্টু ছেলের দলের মতো মাথার চারপাশে ঘুরতে থাকে মিষ্টি ভাবনাগুলো। নিহালের দিকে তাকাল সে। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজেছে নিহাল। ঘুমানোর চেষ্টা করছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। আহা বেচারা! অফিসের ঝামেলায় দিন-রাত ছুটে বেড়ায়। একটু প্রাণভরে ঘুমোতেও পারে না। আলতো করে স্বামীর কপালের ঘাম মুছে দিল শাড়ির আঁচল দিয়ে।

বাস বিরামহীন ছুটছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ধরে। দুপুরটা যখন ধীরে ধীরে বিকেলে সাজিয়ে নিচ্ছিল নিজেকে, তখনই বিকট শব্দে গাড়ির টায়ার ফাটল। বাসের গতি খুব বেশি ছিল না, নইলে হয়ত একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত। বাসটা রাস্তার পাশে একটুকরো খালি জায়গায় দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার যাত্রীদের জানাল, “চাকা ফাংচার হয়ে গেছে। ” বদলাতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। এই ফাঁকে চাইলে যাত্রীরা বাস থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করতে পারে। তবে বাস থেকে বেশি দূরে যেতে নিষেধ করল।

নিহাল ঘুমিয়ে পড়েছিল। কুম্ভকর্ণ একটা! টায়ার ফাটার শব্দেও ঘুম ভাঙেনি। তানিশা কয়েকবার নাড়া দিতেই জাগল।
“কী?” চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞেস করল।
“বাসের চাকা পাংচার হয়ে গেছে। ঘণ্টাখানেক লাগবে বলেছে ড্রাইভার। চলো না একটু নেমে হেঁটে আসি। ”
“চলো। ” নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তানিশাকে নিয়ে নামল। ঘুম ঘুম ভাব তাড়াতে আড়মোড়া ভাঙল বেশ কয়েকবার।
“এটা কোন জায়গা?”
একটা সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত ছিল নিহাল। তানিশার প্রশ্নটা শোনেনি। “হুম?” একরাশ ধোঁয়া আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিছু বললে?”
“এটা কোন জায়গা?”
আশেপাশে কোনো সাইনবোর্ড নেই। কেবল একটা সরু মেঠোপথ হাইওয়ে থেকে সাপের মতো ছুটে গেছে কাছের কোনো গ্রামে। জায়গাটা নিহালের চেনা বুঝতে পারল ওর চোখ দেখেই। কিন্তু অবাক হলো নিহালের ঠোঁটের কোণে একটা ক্রূর হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল দেখে। অমন করে কেন হাসল নিহাল?
“এটা কুমিল্লার কোটবাড়ির কাছাকাছি একটা জায়গা। ”
স্মৃতিতে কোথাও একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল যেন তানিশার। জ্ঞান হবার পর থেকে কখনো ঢাকার বাইরে পা রাখেনি সে। তবু কোটবাড়ি, কুমিল্লা শুনে স্মৃতিতে হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগল কেন? তানিশা দ্বিধায় পড়ে যায়। দ্বিধা চেপে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি চেনো জায়গাটা?”
“নাহ, তবে প্রায় বছর দশেক আগে চারবন্ধু মিলে বেড়াতে এসেছিলাম। ওই একবারই এসেছিলাম। ”
“বাহ, তোমার স্মৃতিশক্তি তো দারুণ। দশবছর আগে বেড়াতে আসার কথা মনে আছে!”
“মনে থাকার কথা নয়, তবে দারুণ কিছু আনন্দের ঘটনা ঘটেছিল সেইসময়, তাই মনে আছে। এমনকি এও মনে আছে আমি সবুজ একটা পাঞ্জাবী পড়েছিলাম। ” ঠোঁটের কোণে মুহূর্তের জন্য আবারো ক্রূর হাসিটা খেলে গেল ওর।

আবারও স্মৃতিতে বিদ্যুৎ চমক। তানিশা চরম দ্বিধায় পড়ে যায়। হঠাৎ কী হচ্ছে এসব। স্মৃতিতে আলোড়ন উঠছে কেন? নিহালের ওই ক্রূর হাসিটা কেন বুকে কাঁপন ধরাচ্ছে। আর সে ওভাবে হাসছেই বা কেন? মাথা ধরে গেল ওর। মনে হচ্ছে যেন মনের অন্ধকার গহ্বরে চাপা পড়ে থাকা কোনো স্মৃতি আলোতে উঠে আসতে চাইছে। কী স্মৃতি, কিসের স্মৃতি?

“চলো, সামনের গ্রাম থেকে হেঁটে আসি। ” এলোমেলো ভাবনা তাড়িয়ে প্রস্তাব দেয় তানিশা।
নিহাল বলে, “বাস ড্রাইভার না বাস ছেড়ে দূরে যেতে মানা করেছে বললে?”
“বেশি দূর তো নয়। ওই যে দেখা যায়। একঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব। ”
“চলো। ” নিহাল তানিশার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতেই আইফোন সিক্স বের করে নিজেদের  কিছু সেলফি তুলল নিহাল।
নিহালের প্রায় বুকের কাছে মিশে গিয়ে সেলফিগুলোতে নানান রূপে মুখের ভঙ্গি বদলে বদলে বৈচিত্র্য আনল তানিশা। তা দেখে নিহাল বলল, “তোমরা মেয়েরা পারোও বটে। এত বিদঘুটে সব এক্সপ্রেশন পাও কই?”
উচ্ছল হাসে তানিশা। “মেয়েদের পেতে হয় না। ওসব এক্সপ্রেশন ন্যাচারালি আসে। ”
“তাই?”
“হুম, তাই!”
“কী প্ল্যান করলে, রাঙামাটি গিয়ে কী দেখবে?”
“তোমাকে!” মিষ্টি হাসির আলো ছড়িয়ে বলে সে।
গলা ছেড়ে হাসে নিহাল। “তবে আর পয়সা খরচ করে এতদূর যাচ্ছি কেন? বাসায় বসে বসেই দেখতে পারতে। ”
“পাহাড়ে-সবুজে তোমাকে কেমন দেখায়, সেটা ঘরে বসে বুঝব কী করে?”
“এক সুযোগে রাতে পাহাড়ে প্রেম করতে বেরুব, তখন ভালো করে দেখে নিও, কী বলো?”
একরাশ লাল আভা জড়ো হয় তানিশার দুগালে। “অসভ্য!”
আবারও গলা ছেড়ে হাসে নিহাল।

কথা বলতে বলতে আর সেলফি তুলতে তুলতে বেশ অনেকটুকু এগিয়ে যায় ওরা। বিকেলের কাঁচা রোদে হাঁটতে ভালোই লাগে ওদের। ভুলেই যায়, দেরি হলে হয়ত বাস মিস হয়ে যেতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ডানদিকে তাকিয়ে থমকায় নিহাল। ডানদিকে সরু নির্জন একটা পথ চলে গেছে। নিহালের চোখে ফুটে ওঠে সুস্পষ্ট কোনো স্মৃতিচিহ্ন। আবারো সেই ক্রূর হাসিটা ছড়িয়ে পড়ার আগেই মিলিয়ে যায়।
“থামলে কেন?” তানিশা জিজ্ঞেস করে। নিহালের চোখ অনুসরণ করে নির্জন পথে দৃষ্টি রাখে। হঠাৎ আবারও স্মৃতিতে বিদ্যুৎ চমক। একটা ঝাঁকি খায় সে। যেন শক খেয়েছে। এবার অস্পষ্ট হলেও কিছু একটা ঘুরঘুর করতে শুরু করে, মনের অবচেতন অংশ। যেন দুয়ার খুঁজছে, চেতনায় ঢুকে পড়ার।

নিহাল বলে, “দশ বছর আগে যখন আমরা চারবন্ধু এসেছিলাম, তখন এই পথ দিয়ে গিয়েছিলাম। এখনো একইরকম আছে। তাই চিনতে পারলাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটলে ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে একটা বাগান আছে। সেই বাগান থেকে অনেক আম চুরি করে খেয়েছিলাম আমরা। আর একটা বেশ বড়সড় কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। রক্তলাল ফুলে ছেয়ে ছিল গাছটা। ”

দশবছর আগে...বাগান...কৃষ্ণচূড়া... দুয়ার খুলে দেয় কোথাও একটা, আর একে একে এসে ঢুকে পড়ার অপেক্ষায় ভিড় করতে থাকে অন্ধকার গহ্বরে চাপা পড়ে থাকা স্মৃতির দল। তানিশা মুহূর্তেই যেন নেশায় ধরা মানুষের মতো হয়ে ওঠে। সে নিহালের হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়, ডানদিকের সরু মেঠোপথ ধরে। ঘোরে পড়া মানুষের মতো। এক অমোঘ আকর্ষণে যেন টানছে ওকে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ।
নিহাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছো?”

তানিশা জবাব দেয় না। ওর এখন বর্তমান নেই। চলে গেছে স্মৃতির পৃথিবীতে। যতই এগোচ্ছে, ততই আলোতে আসছে অন্ধকারের স্মৃতিরা। কৈশোর...স্কুল পিকনিক...কোটবাড়ি, কুমিল্লা...কাছের গ্রাম...বান্ধবীর নানা বাড়ি...স্কুলের হাসি-খুশি শিক্ষক...বান্ধবীর নানা বাড়িতে বিশ্রাম...একফাঁকে গ্রাম ঘুরতে বেরুনো...হারিয়ে যাওয়া...টুকুরো টুকরো এলোমেলো সব স্মৃতি। পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিটা দেখতে পায় না বলে তীব্র যন্ত্রণায় তানিশার চোখে জল জমতে থাকে। অসহ্য সব স্মৃতিরা কিলবিল করছে মাথায়। সে আরো দ্রুত হাঁটতে থাকে। নিহাল ক্রমাগত ওকে পেছনে টানছে ফিরে যাবার জন্যে। কিন্তু অন্ধকারের স্মৃতিরা যে এই মুহূর্তে নিহালের চেয়েও দামি! সে নিহালের হাত ছাড়িয়ে প্রায় ছুটতে শুরু করে...

ছুটতে ছুটতে চোখ মোছে আর স্মৃতির পাজল মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কী করে ভুলে ছিল সে! ছুটতে ছুটতেই একটা বাগানে প্রবেশ করে। জৌলুসহীন অযত্নে পড়ে থাকা একটি বাগান। বাগানের একপাশে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। মলিন, ফুল-পাতাহীন। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়ে যাবার অপেক্ষায়। গাছটা চোখে পড়তেই যেন অদৃশ্য কোন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে যায় তানিশা। একটা জোর বাতাস বয়ে যেতেই কৃষ্ণচূড়া গাছটা শত বলিরেখার ভাঁজ পড়া বৃদ্ধের মতো নড়েচড়ে ওঠে, আর মুহূর্তেই স্মৃতির পাজল মিলে যায় ওর!

স্পষ্ট দেখতে পায়—ওই যে, গাছটার নিচেই জলভরা চোখে দাঁড়িয়ে কিশোরী তানিশা! চোখে-মুখে পথ হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক। ভয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠতেই কোত্থেকে যেন চারটি যুবক এসে হাজির হয়। মানুষের দেখা পেয়ে কিশোরীর চোখ চকচক করে ওঠে আশায়। হয়ত এরা পথ বাতলে দেবে। আশান্বিত হয়ে দু’পা এগোতেই দেখতে পায় তাদের চোখে চকচকে লোভ। এবার দু’পা পেছায়। বুঝতে পারে এরা পথ দেখানোর দলের নয়। সবুজ পাঞ্জাবী পরা একটি যুবক অন্যদের চোখ টিপে বলে, “জটিল মাল!”
আরেকজন বলে, “আশেপাশে কেউ নাই। ”
বাকি দুজন চাপা গলায় গর্জন করে, “ধর!”
ওই গর্জনটা শুনে তানিশার মনে হচ্ছিল শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে কুকুর ঘেউ করে আওয়াজ দিল। সে ফিরে দৌঁড়াতে শুরু করে। দৌঁড়...দৌঁড়...দৌঁড়...কিন্তু...সবুজ পাঞ্জাবী পরা যুবকটি ওকে ধরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে এনে আঁচড়ে ফেলে আর ঠোঁটের কোণে ক্রূর হেসে ভীত তানিশার জামা ছিঁড়তে থাকে। চিৎকার করে ওঠার আগেই মুখ বেঁধে ফেলে আরেকজন।

দু’ঘণ্টার নারকীয় উৎসব শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ওরা চলে যায়। জ্ঞানহীন তানিশা পড়ে থাকে কৃষ্ণচূড়ার নিচে। যে কৃষ্ণচূড়ার গা ঢাকা ছিল রক্তিম সুন্দর চাদরে। নিশ্চুপ ঝরে পড়ে তানিশাকে ঢেকে রাখার বৃথা চেষ্টা করছিল যেন রক্তলাল ফুলেরা। আরো আঁধার নেমে এলে টর্চ হাতে কারা যেন খুঁজে পায় মৃতপ্রায় তানিশাকে। এরপর...ঢাকা...হাসপাতাল...ডাক্তার...সবকিছু ভুলে যাওয়া...মা-বাবার মলিন মুখ...মানসিক হাসপাতাল...চিকিৎসা...অতীত মুছে নতুন জীবন...

চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে তানিশা। এত জল কোথায় ছিল কে জানে! জলে ভেসে যাবে যেন সে। কৃষ্ণচূড়ার সামনে হুমড়ি খেয়ে উচ্চকিত স্বরে কাঁদতে কাঁদতে স্মৃতি মুছতে চেষ্টা করে, পাগলিনীর মতো। মাটিতে ঘষে ঘষে দু’হাতে মুছতে চেষ্টা করে হঠাৎ আলোতে চলে আসা স্মৃতিগুলো। “আমি ভুলে যেতে চাই...আমি আবার ভুলে যেতে চাই!” চিৎকার করে সে।

নিহাল হতভম্ব হয়ে দেখছিল তানিশার অদ্ভুত আচরণ। দু’হাতে ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে জোর করে নিজের দিকে ফেরায়। “কী হয়েছে তোমার, কী হয়েছে!”

নিহালকে সামনে দেখতে পেয়ে মুখে একদলা থুতু যেন জমে যায় আচমকাই। সে নিহালকে ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে দেয় ওগুলো। নিহালের বিস্ময় বাড়ে। চোখে-মুখে লেপ্টে যাওয়া থুতু মুছতেও ভুলে যায়। চোখে দিশেহারা প্রশ্ন নিয়ে তাকায় তানিশার চোখে।

চোখে অশ্রু আগুন ঝরিয়ে তানিশা বলে, “দশবছর আগে ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে পড়ে থাকা সেই মেয়েটি ছিলাম আমি!”

হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হলো নিহালের। হৃদপিণ্ডটা যেন খামছে ধরেছে কেউ। থরথর করে কেঁপে উঠে তানিশার চোখ থেকে চোখ নামিয়ে হাঁটু গেঁড়ে তানিশার পায়ের কাছে মাটিতে থুতু মাখা মুখ লুকায় নিহাল।



বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।