ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ক্ষণজন্মা সুকুমারে বাংলা সাহিত্য সম্ভার (ভিডিও)

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৫
ক্ষণজন্মা সুকুমারে বাংলা সাহিত্য সম্ভার (ভিডিও)

ঢাকা: ‘চলে হনহন/ ছোটে পনপন/ ঘোরে বনবন/ কাজে ঠনঠন/ বায়ু শনশন/ শীতে কনকন/ কাশি খনখন/ ফোঁড়া টনটন/ মাছি ভনভন/ থালা ঝন ঝন’। ছড়াটি লেখকের নিজেকে নিয়ে নয়! লিখেছেন ছোটদের আনন্দ দিতে।

বাংলাসাহিত্যের উদ্ভট সব বিষয়ে বিচরণ, আর নিখাদ আনন্দ দিতেই তিনি লিখে গেছেন। আসলেই তাই। ছেলেবেলায় এই ছড়া পড়িনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া ঢের ভার।

কতো না স্মৃতি, কতো ছেলেবেলার দুরন্তপনার সঙ্গে জড়িয়ে এই লেখাটি। একটু কল্পনা করে দেখলেই তা স্পষ্ট। তিনি পেরেছিলেন স্মৃতিপটে এঁকে দিতে। কারণ, তিনি পারেন- সত্যিই তা দেখিয়েছেন বাংলা সাহিত্যকে।

তিনি সুকুমার রায়। ক্ষণজন্মা এক সাহিত্যকর্মী।
 
আরও আছে- ‘বাবুরাম সাপুড়ে,/ কোথা যাস বাপুরে/ আয় বাবা দেখে যা,/ দুটো সাপ রেখে যা –...’।

মজা এখনও বাকি অনেক। এই যেমন- ‘হলদে সবুজ ওরাং ওটাং/ ইট পাটকেল চিত্পটাং/ গন্ধ গোকুল হিজিবিজি/ নো অ্যাডমিশান ভেরি বিজি’।

বাংলাসাহিত্য গবেষকরা বলে থাকেন, শিশুসাহিত্যে সার্থকতা এনেছেন সুকুমার রায়। তিনি নতুন করে দিয়েছেন বাংলা শিশুসাহিত্যের নতুন পথ।

বিখ্যাত এই লেখকের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর। কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে। বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল রত্ন উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর পরিবারে তার জন্ম। মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে।

শুক্রবার সুকুমারের ১২৮তম জন্মবার্ষিকী।

বাংলা শিশুসাহিত্য ও ভারতীয় সাহিত্যে ‘ননসেন্স রাইমের’ প্রবর্তক সুকুমার রায়। তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্য রচনাকার, নাট্যকার, অঙ্কনশিল্পী ও গীতিকার। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর সন্তান। তার জেঠা সারদারঞ্জন ছিলেন আঠারো শতকের বাংলায় প্রথম ক্রীড়া সংগঠক, বাংলায় ক্রিকেট খেলার জনক। সুকুমার রায়ের স্ত্রীর নাম সুপ্রভা রায়। তাদের ছেলে সত্যজিৎ রায় বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৯৮৭ সালে বাবার ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা করেন সত্যজিৎ।

পারিবারিক উত্তরাধিকারে সমৃদ্ধ সুকুমার রায় তার স্বল্পায়ু জীবনে শিশুসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ হয়ে ওঠেন। শুধু তিনিই নন, তার বড় বোন সুখলতা, ছোট বোন পূণ্যলতা, শান্তিলতা, ভাই সুবিনয় এবং দূর সম্পর্কের বোন লীলা মজুমদার শিশুসাহিত্যে পরিচিত লেখক-লেখিকা।

সুকুমারের লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হযবরল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা ‘ননসেন্স’ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়।

সুকুমার রায় সিটি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়নে অনার্সসহ বিএসসি (১৯১১) পাস করেন। পরে ফটোগ্রাফি ও প্রিন্টিং টেকনোলজিতে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ’ নিয়ে ইংল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি প্রথমে লন্ডন এবং পরে ম্যাঞ্চেস্টারে স্কুল অব টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেন।
 
বিলেতে থাকা অবস্থায় সুকুমার রায় বিভিন্ন বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। সুনাম কুড়ান সেখানেও। পরে ১৯১৩ সালে দেশে ফিরে তিনি বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্সে’র হাল ধরেন।
 
সুকুমার রায় একাধিক গুণের অধিকারী ছিলেন। অল্প বয়স থেকেই তিনি বাবার অনুপ্রেরণায় মুখে মুখে ছড়া রচনা ও ছবি আঁকার পাশাপাশি ফটোগ্রাফিরও চর্চা করতেন। কলেজ জীবনে তিনি ছোটদের হাসির নাটক রচনা এবং তাতে অভিনয়ও করেছেন।

সুকুমার রায় শান্তিনিকেতনে একবার  রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘গোড়ায় গলদ’ নাটকে অভিনয় করেছেন। স্বদেশি আন্দোলনের সময় তিনি বেশ কিছু গান রচনা করেন। যা তিনি নিজে গেয়েছেনও।
 
বাবা উপেন্দ্র কিশোরের মৃত্যুর পর তিনি পিতৃপ্রতিষ্ঠিত সন্দেশ পত্রিকা পরিচালনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে বিলেতে থাকা অবস্থায় পত্রিকার জন্য নিয়মিত গল্প, ছড়া, কবিতা ও নিজের আঁকা ছবি পাঠিয়ে সক্রিয় ছিলেন তিনি।
 
সুকুমার রায় প্রেসিডেন্সিতে ছাত্র থাকাকালে ‘ননসেন্স ক্লাব’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, যার মুখপত্র ছিল সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা। বিলেত থেকে ফিরে তিনি গঠন করেন ‘মানডে ক্লাব’। এখানে আলোচনা ও পাঠের সঙ্গে থাকতো খাদ্য ব্যবস্থাও। তাই ব্যঙ্গ করে কেউ কেউ একে বলতেন ‘মন্ডা ক্লাব’।
 
সুকুমার রায়ের প্রধান অবদান শিশু-কিশোর উপযোগী বিচিত্র সাহিত্যকর্ম। ছড়া, কবিতা, নাটক, গল্প, ছবি সবকিছুতেই তিনি সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ ও কৌতুকরস সঞ্চার করে গেছেন। তার কাব্যে হাস্যরসের সঙ্গে সমাজচেতনাও সমানভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

সুকুমার রায়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা হলো- আবোল তাবোল (১৯২৩), হ-য-ব-র-ল (১৯২৪), পাগলা দাশু (১৯৪০), বহুরূপী (১৯৪৪), খাইখাই (১৯৫০), অবাক জলপান, শব্দকল্পদ্রুম, ঝালাপালা ইত্যাদি।

এছাড়া বাংলা ও ইংরেজিতে রচিত তার কিছু গুরুগম্ভীর প্রবন্ধও রয়েছে। ডায়েরির আকারে রচিত হেসোরামের ডাইরি নামে তার একটি অপ্রকাশিত রম্য রচনা আছে।

মাত্র ৩৬ বছর বয়সে অকাল প্রয়াত সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩) লিখেছেন ১০৩টি কবিতা, ৮৮টি নানা ধরনের ছোট গল্প, ১২২টি প্রবন্ধ, ৩৭টি জীব-জন্তু বিষয়ক লেখা, ১৬টি জীবনীমূলক কাহিনী, ৮টি নাটক ও ২টি বড় গল্প। এছাড়া এঁকেছেন পত্রিকার সমস্ত ছবি। আরও রয়েছে বড়দের জন্য তার একমাত্র বই ‘বর্ণমালা তত্ত্ব’, ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত ফটোগ্রাফি বিষয়ক প্রবন্ধ, লন্ডনের ‘জার্নাল অব ফটোগ্রাফি’তে ছাপা একটি প্রবন্ধ, ‘কোয়েস্ট’ পত্রিকায় ‘দ্য স্পিরিট অব রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধ ও দু’টি ধর্ম সংগীত। তাই তো বলা যায় ক্ষণজন্মা সুকুমারে বাংলাসাহিত্য সম্ভার। তিনি এই স্বল্প সময়ে যাই বা লিখেছেন তাই হয়েছে সেরা। হয়েছে রসে-মানে-গুণে ভরপুর লেখা।

১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কলকাতার ১০০নং গড়পার রোডের পৈত্রিক বাড়িতে সুকুমারের মৃত্যুর ৯ দিন পর তার প্রথম বই ‘আবোল তাবোল’ প্রকাশিত হয়। সারাজীবন যিনি লিখে গেছেন শত আবোল তাবোলের বিরুদ্ধে, ছড়ায়-ছন্দে, গল্পে তুলে ধরেছেন বাস্তবতা তারই জীবনে এমন পরিণতি বাস্তবে। তাতে কী, যতোদিন রবে বাংলাসাহিত্য যতোদিন পাঠ হবে ভাষা বাংলায়। ততো দিনই রয়ে যাবেন স্মৃতিপটে সুকুমার রায়।

কোনো অন্তমিলে নয়, একটু ছন্দে যদি বলা যায় তবে-
যতোদিন রবে বাংলা সাহিত্য
বাংলায় মন দেবে সায়
ততোদিন স্মৃতিপটে
রয়ে যাবে সুকুমার রায়।



বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৫
আইএ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।