ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ১৬)

ধারাবাহিক রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৫
ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ১৬)

পর্ব ১৫ পড়তে ক্লিক করুন

মেম সাহেবদের বাজার সদাই |
৮২০ সালের অক্টোবর মাস। শীতের হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া ইতোমধ্যেই কলকাতা শহরের অলিগলিতে বইতে শুরু করেছে।

কর্নেল ইগারটনের স্ত্রী সদ্য বিলেত থেকে এসেছেন। তার খুব শখ কলকাতার রাস্তায় বিলাতি পাড়ার দোকানপাটে গিয়ে বাজার সদাই করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। এক সন্ধ্যায় বিলেত থেকে নিয়ে আসা হালকা ‘সামার জ্যাকেট’ গায়ে জড়িয়ে ভারতীয় চাকরকে সাথে নিয়ে মিসেস ইগারটন পা বাড়ালেন কেনাকাটার উদ্দেশ্যে।

প্রথমেই তিনি ‘টেইলরস এমপোরিয়াম’ দোকানটির সামনে এসে দাঁড়ালেন। লক্ষ্য করলেন তার চারপাশে প্রচুর ইউরোপিয়ান এবং এংলোরা ঘুরঘুর করছে। কিছু ভারতীয়ও নতুন আগত এই বিলাতি মেমটির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। এদিকে দোকানীরা কলকাতার রাস্তায় নতুন এই অতিথিকে দেখে তাদের সুসজ্জিত দোকানে স্বাগত জানাল। তিনি দোকানের প্রায় প্রতিটা জিনিস দেখলেন, ঘ্রাণ নিলেন, নাড়াচাড়া করলেন এবং সবশেষে কয়েকটা ছবি বাঁধানোর কাঠের ফ্রেম, চিনামাটির কিছু তৈজষপত্র, ফুলদানীসহ আরো কিছু শখের জিনিসপত্র কিনলেন।



‘হার্টলি হাউজ’-এর লেখক আঠার শতকের দিকে ভারতের শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই পঞ্চাশটির মতো মানসম্মত দোকান ছিল বলে তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এসব দোকানে বিলাতি নারীরা মনের সুখে তাদের কেনাকাটা করতেন। ঊনিশ শতকের শুরুতেই সে সংখ্যা রাতারাতি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং প্রচুর আর্মি এবং নেভি, হল অ্যান্ড এন্ডারসন, হোয়াইট এওয়ে অ্যান্ড লেইডলো ইত্যাদি নামীয় বিলাতি দোকানপাটে কলকাতা ছেয়ে যায়



তারপর মিসেস ইগারটন গেলেন ‘আর্মি অ্যান্ড নেভি’র দোকানটিতে। দোকানটির সামনে এসে মিসে ইগারটনের চোখ তো ছানাবাড়া। “এ তো দেখি সাক্ষাৎ বিলেত! তাহলে সব কিছুই পাওয়া যায় ভারতে?”—কায়দা করে সঙ্গে নিয়ে আসা ভ্যানেটি ব্যাগে রাখা টাকার কথাটাও স্মরণ করলেন এই বিলাতি মেম। হুট করে সব টাকা শেষ করে ফেলা কোনো কাজের কথা না। তাছাড়া তিনি ভারতে নতুন। “কখন কোন দুঃসময় চলে আসে কে জানে!”—তবু তিনি ‘আর্মি অ্যান্ড নেভি’ দোকানটি থেকেও ঘরের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনলেন। বিশেষ করে শীতের কাপড় আর মিলিনারি টুপি। এবার ফেরার পালা।

কলকাতার রাস্তায় তখন সুনশান নীরবতা। ঘোড়ার গাড়িতে জিনিসপত্রগুলো নিয়ে উঠতে গিয়ে মিসেস ইগারটনের চোখ আবারো আটকে গেল রাস্তার পাশেই ‘বক্স ওয়ালা (Box-Wallah)’ নামের ছোট দোকানটিতে। আর কি! গাড়ি থেকে নেমে বক্স ওয়ালাতেও কিছুক্ষণের জন্যে মগ্ন হয়ে রইলেন এই বিলাতি মেম।

‘হার্টলি হাউজ’-এর লেখক আঠার শতকের দিকে ভারতের শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই পঞ্চাশটির মতো মানসম্মত দোকান ছিল বলে তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এসব দোকানে বিলাতি নারীরা মনের সুখে তাদের কেনাকাটা করতেন। ঊনিশ শতকের শুরুতেই সে সংখ্যা রাতারাতি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং প্রচুর আর্মি এবং নেভি, হল অ্যান্ড এন্ডারসন, হোয়াইট এওয়ে অ্যান্ড লেইডলো ইত্যাদি নামীয় বিলাতি দোকানপাটে কলকাতা ছেয়ে যায়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দোকানগুলো যারা চালাতেন তারা সবাই ছিলেন বিলাতি বা ইউরোপিয়ান জনগোষ্ঠীভুক্ত। তবে দোকানের অন্যান্য কর্মচারীরা ছিলেন কেউ ইউরোশিয়ান, কেউ এংলো অথবা কেউ ভারতীয়। সেই সময়ে ভারতের প্রতিটা প্রধান শহরেই ছিল ‘বাজার’। কলকাতার বউ বাজার(Bow Bazar) সেই সময় খুব বিখ্যাত ছিল। কলকাতার চায়না টাওনে অবস্থিত এই বাজারে চিনে ব্যবসায়ীরা তাদের নানারকম মনোহরি চিনা তৈজষপত্র, সিল্কের কাপড়, আসবাবপত্র, সৌখিন ঘর সাজাবার জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিলাতি মেমরা ছিলেন তাদের প্রধান খদ্দের।

ভারতে বিলাতি রাজ্য কায়েম হওয়ার পর বিভিন্ন সময় বিলাতিরা তাদের নিত্যদিনের বাজার সদাইয়ের জন্যে ‘বাজার’ তৈরি করেছিল। মাদ্রাজের মুর মার্কেট, বোম্বের ক্রোফোর্ড মার্কেট, কলকাতার হুগ মার্কেট(নিউমার্কেট)সহ এরকম কয়েকটি হলো বিলাতিদের তৈরি করা ভারতের জনপ্রিয় মার্কেট। মাদ্রাজ কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট জর্জ মুর ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে এই মার্কেটটি তৈরি করেন। সেই সময়ে বিলাতি খাবার দাবারকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হলেও পরবর্তীতে মার্কেটটিতে বই, পেইন্টিং, শখের জিনিসপত্র ও পোষা প্রাণীসহ সবকিছুই পাওয়া যেত। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে মুর মার্কেট দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র পাওয়ার অন্যতম একটি জায়গা হিসেবে বিবেচিত হতো।

স্যার স্টুয়ার্ট হুগ ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এবং তিনি ১৮৭৪ সালে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে একটি বৃহৎ মার্কেট তৈরি করেন। মার্কেটটির নামকরণ হয় ‘স্যার স্টুয়ার্ট হুগ মার্কেট’। পরবর্তীতে মার্কেটটিকে স্থানীয় ভাষায় ‘হুগ সাহেবের বাজার’ বলা হতো যা কালের বিবর্তনে বর্তমানে ‘নিউ মার্কেট’ নামেই বেশি পরিচিত।

এ তো গেল শহরের কথা। যেসব হতভাগ্য বিলাতি নারী শহর থেকে দূরে, উপশহরে অর্থাৎ ‘Mofussil’-এ দিনাতিপাত করতে হতো তাদের কী দশা হতো? তাদের একমাত্র আস্থার জায়গা ছিল স্থানীয় দোকানপাট এবং ডাকযোগে বাজার সদাই। তৎকালে ভারত থেকে প্রকাশিত ‘দ্যা পাইয়োনিয়ার’ এবং ‘সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেট’ পত্রিকায় বিলাতি নারীদের ঘর গৃহস্থের বিভিন্নরকম জিনিসপত্রের মনোহরি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো। বিজ্ঞাপন দেখে সেখান থেকে পছন্দের জিনিসপত্র অর্ডার দিতে পারতেন বিলাতি নারীরা। পত্রিকায় প্রকাশিত ক্যাটালগ দেখে বাজার সদাই করতেন তারাই—যাদের শহরে গিয়ে কেনাকাটার কোনরকম সুযোগ থাকত না। তবে সেই সময়ে ডাকযোগে জিনিসপত্র কেনাও খুব সহজ কোনো বিষয় ছিল না।

জুলিয়া কুরটিস নামের এক বিলাতি নারী ক্যাটালগ দেখে শখ করে কিছু শীতের কাপড় অর্ডার দিয়েছিলেন। কিন্তু তা ভুল করে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জুলিয়া কুরটিস এ নিয়ে একটি অভিযোগপত্রও লিখেছিলেন। পরবর্তীতে ভারতের রাস্তায় প্রচুর ফেরিওয়ালার আবির্ভাব ঘটে এবং বিলাতি নারীরা খুব সহজে তাদের পছন্দের পণ্যটি কেনার সুযোগ পেয়ে যান। বিলাতি নারী ওয়ালেস ডানলোপের বর্ণনায় ফেরিওয়ালাদের বাক্সে তাদের পছন্দের জিনিসপত্রের একটি তালিকা পাওয়া যায়। “আঁচার, সার্ডিন, পারফিউম, কাঁচাবাজার, চিনামাটির পাত্র, টুপি, পোশাক, জুতা এবং মনোহরি জিনিসপত্র। ” কোনো কোনো ফেরিওয়ালার বাক্সে শ্রিগনর থেকে আসা পেপার টাওয়েল, বাহারি রঙের খেলনা, সিল্কের কাপড়, কাশ্মিরি শাল ইত্যাদি পাওয়া যেত।

ক্রেতা হিসেবে যেহেতু বিলাতি নারীদের বেশ নাম ছিল, তাই অনেক সময় স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও জঙ্গল থেকে বাহারি গাছ, অর্কিড এবং কখনো কখনো বন্য জন্তু পশুপাখি বিলাতি বাংলোতে নিয়ে আসতেন এবং বিক্রি করতেন। রোসামুন্ড লরেন্স নামের এক বিলাতি নারীর বর্ণনায় সেরকম একটি চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বলছেন, “ফেরিওয়ালা একটার পর একটা সুন্দর সিল্কের কাপড়গুলো তার বাক্স থেকে বের করছিল এবং বিক্রি করার জন্যে আমাকে ক্রমাগত উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছিল। ”

শহরতলিতে থাকলে যেমন হয়। শহরের সবরকম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া। বিলাতি নারীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। অনেকেরই ইচ্ছে থাকলেই শহরে থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। শখ করে কোনো বিলাতিই মফস্বলে আসতে চাইত না। ১৬৫০ সালের একটি ঘটনা এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে:

এরন বেকার নামের একজন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা কোম্পানিকে শর্ত দিল, সে ভারতের মাদ্রাজের একটি মফস্বল শহরে যেতে রাজি আছে যদি তার স্ত্রী এলিজাবেথকে তার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এরন বেকার সে সময়ের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন বিশ্বস্ত এবং দক্ষ কর্মচারী হওয়ায় কোম্পানি তার সে ইচ্ছায় অনুমোদন দেয়। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায়, এরন বেকার ভারতের মাদ্রাজে তার নতুন কর্মস্থলে পৌঁছলেও স্ত্রী এলিজাবেথ ভারতের মফস্বলের ভয়ে আর কখনোই ভারতের বন্দরে পৌঁছতে পারেন না। তিনি বিলেতের মাটিতেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেন্ট মেরির চার্চের রেকর্ড অনুযায়ী তার মৃত্যুসন আগস্ট ৫, ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দ (The Incumberances' British Women in India 1615 - 1856. Author: Joan Mickelson Gaughan. Oxford University Press)

মেম সাহেবদের বাজার সদাইয়ের দিকে আবার মুখ ফেরানো যাক। যদি কেউ ভাবেন শুধুমাত্র বিলাতি মেম সাহেবদের জন্যই ভারতে এসব মার্কেট তৈরি হয়েছিল তাহলে বড্ড ভুল করবেন। বরং অন্য একটি কারণকে সামনে রেখে ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে মার্কেটগুলো তৈরি করা হয়। প্রথমে কারণটি ছিল একচেটিয়াভাবে বিলাতি পণ্য ভারতের বাজারে বিক্রি করা। পরবর্তীতে দেখা গেল ভারতীয় পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ করে তা বিলেতে পাচার করার জন্যেও মার্কেট একটি উপযুক্ত স্থান।



পর্ব ১৭ পড়তে ক্লিক করুন

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।