ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

পাক ধরেছে চলনবিলের ধানে  

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
পাক ধরেছে চলনবিলের ধানে  

নাটোর: দেশের বৃহত্তম চলনবিল ও হালতিবিলের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ জুড়ে কেবলই ধান আর ধান। যেন হলুদ-সবুজের সমারোহ।

 

কোথাও কাঁচা, কোথাও আধা-পাকা আবার কোথাও বোরো ধান সম্পূর্ণভাবে পেকে গেছে।  

অর্থাৎ কাটা-মাড়াইয়ের উপযোগী হয়েছে। কোথাও কোথাও কাটা-মাড়াই শুরুও হয়েছে। আর মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জেলার সর্বত্রই পুরোদমে ধান কাটা, মাড়াই শুরু হবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

তবে স্থান ভেদে কিছুটা হেরফের হতে পারে। কেননা বোরোর চারা রোপণে স্থান ও সময় ভেদে কিছুটা আগে-পিছে হয়েছে। ফলে কোথাও আগাম ধান পেকেছে আবার কোথাও কাঁচাই রয়েছে ধান। সব মিলিয়ে ধান গাছ ভালো ও দানা ভালো হলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তীব্র তাপদাহ। বোরোর জমিতে অল্পতেই পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে সঠিক মাত্রায় জমিতে পানি ধরে রাখতে না পারলে ফলনে কিছুটা বিপত্তি ঘটতে পারে। তাই এবার বোরোর ফলন নিয়ে খানিকটা চিন্তিত কৃষকরা।

কেননা এবার বোরোর চারা রোপণের পর থেকে এখনও পর্যন্ত তেমনভাবে বৃষ্টিপাত হয়নি। পানির স্তুরও নিম্নমুখী, চাহিদা অনুযায়ী সেচ যন্ত্রে পানি মিলছে না। তার ওপর চলছে তীব্র তাপদাহ। আবার জমিতে পানি ধরে রাখাটাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ধানের পরাগায়ন। এছাড়া ধান পাকার উপযোগী সময়ে পর্যাপ্ত পানি না থাকা এবং অসহনীয় তাপমাত্রার কারণে ফলনের ওপর কিছুটা বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করলেও কষি বিভাগ বিষয়টিকে নাকচ করে দিয়ে বলছে- বিগত বছরের মতো এবারও বোরোর বাম্পার ফলন হবে। এ পর্যন্ত ২০ হেক্টর জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ১৫ মেট্রিক টন অর্থাৎ বিঘা প্রতি ফলন হচ্ছে ২২ মণ। কৃষি বিভাগের মতে এবার জেলায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় ৬১ হাজার ৩৭৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে চাষাবাদ হয়েছে ৬০ হাজার ৯৭৫ হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৫৯ মেট্রিক টন চাল। আর ধানের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন।

গত মৌসুমে জেলায় ৫৮ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও আবাদ হয়েছিল ৬১ হাজার ২০৪ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ ২ হাজার ৪৯৪ হেক্টর বেশি জমিতে চাষাবাদ হয়েছিল। অন্যদিকে মোট উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন চাল আর ৪ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন ধান।

সূত্র আরও জানায়, চলতি রবি মৌসুমে সদর উপজেলায় বোরোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৬৫২ হেক্টর, সেখানে চাষাবাদ হয়েছে ২ হাজার ৩০ হেক্টর, নলডাঙ্গা উপজেলায় ৮ হাজার ৭৭০ হেক্টরের বিপরীতে ৮ হাজার ৫৩০ হেক্টর, সিংড়া উপজেলায় ৩৬ হাজার ৫৯০ হেক্টরের বিপরীতে ৩৬ হাজার ৬২০ হেক্টর, গুরুদাসপুর উপজেলায় ৫ হাজার ৫৯৫ হেক্টরের বিপরীতে ৫ হাজার ৬১০ হেক্টর, বড়াইগ্রাম উপজেলায় চার ৬ হাজার ৩৮ হেক্টরের বিপরীতে ৫ হাজার ৮৯০ হেক্টর, লালপুর উপজেলায় ১ হাজার ৯০ হেক্টরের বিপরীতে ১ হাজার ৫৫ হেক্টর, বাগাতিপাড়া উপজেলায় ৬৪০ হেক্টর জমিতে বোরোর চাষাবাদ হয়েছে। এ জেলার সিংড়া, নলডাঙ্গা, বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলায় বেশি বোরো আবাদ হয়েছে।

সিংড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খন্দকার বাংলানিউজকে জানান, এবার ৩৬ হাজার ৫৯০ হেক্টরের বিপরীতে ৩৬ হাজার ৬২০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগ অর্থাৎ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে শুধুমাত্র একটিই জাত জিরাশাইল ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। যা একসঙ্গে রোপণ করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে আগামী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে পুরোদমে কাটা-মাড়াই শুরু হবে। দুই-একজন কৃষক এ জাতের ধান এরই মধ্যে কেটেছেন। তারা বিঘা প্রতি ২২ মণ হারে ফলন পেয়েছেন। অন্যান্য জাতের ধানের অবস্থাও অনেকটা ভালো পর্যায়ে রয়েছে।  

তিনি বলেন, চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলায় বর্তমানে ৬০ ভাগ ধান কাটার উপযোগী হয়েছে, ৩০ ভাগ পরিপক্ক এবং ১০ ভাগ ফুল আসা পর্যায়ে রয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে সার্বিকভাবে ধানের ভালো ফলন হবে।  

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফৌজিয়া ফেরদৌস বাংলানিউজকে জানান, এ উপজেলায় ৮ হাজার ৭৭০ হেক্টরের বিপরীতে ৮ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে বোরোর চাষাবাদ হয়েছে। হালতিবিলসহ এ উপজেলায় শতকরা ৬০ ভাগ ধান নরমদানা, শক্তদানা এবং পাক ধরেছে। গেল সপ্তাহ ধরে কাটাও শুরু হয়েছে এবং বিঘা প্রতি ফলন ২২ মণ হারে হচ্ছে।  

তিনি বলেন, উপজেলায় বোরো ধান আগাম চাষাবাদ হওয়ায় তীব্র তাপদাহ তেমন একটা প্রভাব ফেলবে না। কারণ ফুল আসা পর্যায় অনেক আগেই পার হয়েছে। শতকরা ৪০ ভাগ জমিতে ফুল আসা পর্যায় বিরাজ করছে। এতে ওই কৃষকদের জমিতে ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার স্তর পর্যন্ত পানি ধরে রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এটা করতে পারলে কোনো সংকটে পড়তে হবে না কৃষকদের। তবে এবারও বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছি।

স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন, এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে পানির স্তর নিম্নমুখী ছিল। ফলে সেচের ক্ষেত্রে কৃষকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সেচ খরচও বেশি পড়েছে। তবে এবার কোনো ধরনের পোকার আক্রমণ দেখা দেয়নি এবং এখনও ফসলের অবস্থা সন্তষজনক রয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে কিংবা প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় না হলে সঠিক সময়ে তারা ফসল ঘরে তুলতে পারবেন এবং ফলনও ভালো হবে বলে আশা করছেন। তবে গেল কয়েকদিন ধরে চলা প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে কৃষকদের মধ্যে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে।

হালতিবিলের খাজুরা গ্রামের কৃষক মো. সাদেক আলী জানান, এবার তিনি ৪০ বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছেন। ফলনও ভালো হচ্ছে।  

দুর্লভপুর গ্রামের জহুরুল ইসলাম সুরুজ জানান, ৬০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছেন। ধান কাটা-মাড়াই শুরু করেছেন, ফলন ভালো হয়েছে।

পাটুল গ্রামের কৃষক মহির উদ্দিন জানান, ফসলের অবস্থা ভালো হলেও এবার সেচ নিয়ে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তীব্র তাপদাহের কারণে শেষ মুহূর্তে এসে পানির স্তর নিম্নমুখী হয়ে গেছে, সেচযন্ত্রে পানিই উঠছিল না সেভাবে। তবে শেষ পর্যন্ত কাটার উপযোগী হয়েছে ধান। দুই-একদিনের মধ্যে কাটা ও মাড়াই শুরু করবেন।

চলনবিলের কান্তানগর গ্রামের কৃষক মহিদুল, আফসার জানান, এবার বৃষ্টিপাত হয়নি। সেচ নিয়ে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। তবে তাদের ফসলের দানা ভালোই হয়েছে। প্রাকৃতিক দুযোর্গ না হলে সময়মতো তারা ধান কেটেরে ঘরে তুলতে পারবেন। এজন্য তারা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।

এদিকে চলনবিলের কান্তানগর, তাজপুর, সাতপুকুরিয়া, জোড়মল্লিক, হালতিবিলের খোলাবাড়িয়া, পাটুল, একডালা, দুর্লভপুর ও খাজুরা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ খোলা বা চাতাল প্রস্তুত করছেন, শ্রমিক ঠিক করছেন।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বাংলানিউজকে জানান, তীব্র তাপদাহ চলছে, এটা একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার। এ অবস্থায় যেসব বোরো ধানের গাছে দেরিতে ফুল আসছে, সেগুলোতে তাপদাহের কারণে সামান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখতে পারলে কোনো সমস্যা থাকবে না। বিষয়টি নিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, জেলার সবখানেই বোরো ধান ভালো হয়েছে। অনেকে কাটা-মাড়াই শুরু করেছেন। এবার বিঘা প্রতি ২২ থেকে ২৩ মণ হারে ফলন হচ্ছে। এ অবস্থা বিরাজ করলে এবং প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় না ঘটলে বিগত বছরের মতো এবারও বাম্পার ফলন হবে।

এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সেচযন্ত্রে পানি তোলা নিয়ে কৃষকদের মধ্যে বিড়ম্বনা ছিল, তবে তা কেটে গেছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ও বিশেষ করে চলনবিল ও হালতিবিলে বোরো ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে পুরোদমে কাটা শুরু হবে। তবে কোথাও কোথাও বোরোর চারা দেরিতে রোপণ করায় ফুল আসতে দেরি হয়েছে। কিন্তু তাতে সার্বিক উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে না।  

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
এসআই  
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।